বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ কেমন আছেন

২০১৯-এর ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ নামের দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। উপত্যকাবাসীর বিরোধিতাকে উপেক্ষা করেই তা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বন্দুকের মুখে সাধারণ মানুষকে রেখে এই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তাদের যুক্তি ছিল, এর ফলে অনুন্নয়নে মোড়া উপত্যকায় উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। শিল্পে লগ্নি বাড়বে, বেকার যুবকদের চাকরি হবে, দুর্নীতি বন্ধ হবে। এক কথায় জনজীবন নিশ্চিন্ত এবং স্বাভাবিক হবে।

৩৭০ ধারা অবলুপ্তির পর ৪ বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। কেমন আছেন জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের মানুষ? সরকারের দাবি, জনজীবন স্বাভাবিক হয়েছে। পর্যটকদের ঢল নেমেছে। লগ্নিতেও নাকি জোয়ার এসেছে। দুর্নীতি নামক শব্দটি নাকি ভ্যানিশ হয়ে গেছে। সরকারি পদে নিয়োগ হয়েছে।

উপত্যকাবাসীদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় অবশ্য আলাদা ছবি ফুটে উঠেছে। চাকরি নেই। এমনকি পর্যটনের ব্যবসায় এতদিন যেটুকু রোজগার হত কাশ্মীরী যুবকদের, আঁটোসাঁটো প্রশাসনিক নিরাপত্তার অজুহাতে চলাফেরার উপর নিয়ন্ত্রণের কারণে তাও বিপন্ন। ফল এবং অন্যান্য ব্যবসার অবস্থাও ক্রমশ খারাপের দিকে চলেছে। নাগরিকদের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। মানবাধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিপন্ন। দুর্নীতিও চলছে রমরমিয়ে। 

২০১৯-এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত ৫০ জনের বেশি সরকারি কর্মীকে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে মিথ্যা অপরাধে অভিযুক্ত করে ছাঁটাই করা হয়েছে। এখন সরকার যে আইন ব্যবহার করছে, তাতে কোনও কারণ না দেখিয়েই যে কোনও সময় যে কোনও সরকারি কর্মীকে সরকার ছাঁটাই করে দিতে পারে। অনিশ্চিত জীবনই তাদের ভবিতব্য হয়ে উঠেছে।

জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের বিপন্নতা বেড়েছে

৩৭০ প্রত্যাহারের পরে সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং তাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে নিখোঁজের সংখ্যা। সন্ত্রাসবাদীদের হাতে হিন্দু পণ্ডিত ও পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর বহু ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯-২০২২, এই সময়ের মধ্যেই ৭১ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। প্রশাসনিক দমন-পীড়নে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। জম্মু-কাশ্মীরের জনসাধারণ তাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকার থেকে বঞ্চিত। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের নেতাদের উপর নজরদারি ও সিবিআই হানা চলছে বারবার। মিটিং-মিছিল, পদযাত্রা করার উপর নিষেধাজ্ঞা চলছে একটানা। মহিলা ও শিশুদের উপর অত্যাচারের হার বেড়েছে কয়েক গুণ। বেকারির হার দাঁড়িয়েছে ২৩.১ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের প্রায় তিন গুণ। প্রায় ৫৫ হাজার সরকারি পদ ফাঁকা। জম্মু-কাশ্মীর সিলেকশন বোর্ড একটি ভুঁইফোড় কোম্পানিকে ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগের বরাত পাইয়ে দেওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এখানকার মন্দিরগুলির জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। জম্মু-কাশ্মীরের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। হোটেলগুলির লিজ না বাড়ানোর ফলে এই ব্যবসাও বন্ধ হতে বসেছে। সরকার নতুন জমি নীতি চালু করার ফলে হোটেল মালিকরাও হোটেলের জমিকে স্থানীয় প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়ার নোটিশ ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। সেই জমি কাদের জন্য সংরক্ষিত করা হচ্ছে? বাইরের ধনকুবেরদের কাছে চড়া দামে কাশ্মীরের জমিকে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এর ফলে ব্যবসা বন্ধের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় হোটেল ও নানা ক্ষেত্রের ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিক ভাবেই জনজীবন স্বাভাবিক হওয়ার যে দাবি সরকার করছে, কোনও দিক থেকেই তার ছবি চোখে পড়ছে না।

৩৭০ ধারা বিলোপের সাথে ৩৫-এ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের জমি ভারতের অন্য প্রান্তের বাসিন্দারা, এমনকি বিদেশিরাও কিনতে পারবে বলে সরকার ঘোষণা করে। সরকার বলছে, বাইরের পুঁজি এলে উপত্যকার উন্নয়ন হবে। যদিও অনলাইন পোর্টালে বিজ্ঞাপন দিয়ে বহুদিনের লিজে জমি বিক্রির কথা বললেও বাইরের লগ্নি দূর অস্ত, কোনও লগ্নিই আসছে না। সরকার ঘোষণা করেছিল, কোল্ড স্টোরেজ, কাঠ-শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, শিক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেসরকারি মালিকরা পুঁজি বিনিয়োগ করবে। কিছু কর্মসংস্থানের আশা দেখেছিল উপত্যকার মানুষ। তাও বিশ বাঁও জলে। একদিকে সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে কাশ্মীরবাসীকে মিলিটারির বন্দুকের ভয় দেখিয়ে, অন্যদিকে নানা নিয়ম-নীতির ফাঁসে রুদ্ধ করে তাদের অবদমিত করতে চাইছে প্রশাসন। এক কথায় হাতে এবং ভাতে দুক্সদিক দিয়েই তারা কাশ্মীরের মানুষকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করেছে।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিপন্ন

মানুষের সব অধিকার যখন ভয়ঙ্কর রকম ভাবে বিপন্ন, তখন গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমই পারত কিছুটা হলেও তা মানুষের সামনে তুলে ধরতে। কিন্তু এমন কোনও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম নেই, যার উপর ও তার সাংবাদিকদের উপর বীভৎস আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়নি। মুখ বন্ধ করতে এমনকি গুম, খুন পর্যন্ত করা হয়েছে। ‘রাইজিং কাশ্মীর’-এর প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক সুজাত বুখারিকে হত্যা করেছে দুষ্কৃতীরা।

২০১৯-এর পর থেকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চূড়ান্ত ভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নানা পত্রপত্রিকার ১২ জনেরও বেশি সাংবাদিককে ‘ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত’ এই অজুহাত দিয়ে তাঁদের পাসপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে, না হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে প্রশাসন। যখন-তখন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের অফিস-বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। মানবাধিকার সংগঠনগুলিও আক্রমণের শিকার।

তিন জন সাংবাদিককে কঠোর আইন ইউএপিএতে গ্রেপ্তার করে জেলে পোরা হয়েছে। জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন এরকম সাংবাদিকদের আবার সঙ্গে সঙ্গে জনসুরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে দু’বছর বন্দি রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। প্রায় কোনও স্বাধীন সংবাদপত্র নেই কাশ্মীরে। পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সানা ইরশাদ মাট্টোকে পর্যন্ত বিদেশে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। বাকস্বাধীনতা বলে কিছু নেই। সরকারের সমালোচনা দূরের কথা, প্রশংসা না করলেই সে সব সংবাদমাধ্যমের উপর খড়গহস্ত হচ্ছে প্রশাসন। দুই সাংবাদিককে জামিন দিতে গিয়ে এই কথা সরকারকে আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্ট।

শান্তির সংজ্ঞা প্রশাসন ও উপত্যকাবাসীর কাছে আলাদা

বিজেপির দাবি, তাদের জমানায় কাশ্মীরে শান্তি ফিরে এসেছে। নেতাদের মতে, ধমর্ঘট, পাথর ছোঁড়া, সরকারবিরোধী স্লোগান নেই। ফলে শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে কাশ্মীর। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চেহারা তো আগেই দেখা হয়ে গেছে! শান্তি বলতে তাঁরা কী বোঝাতে চাইছেন? তা কি শ্মশানের শান্তি? 

৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার সময়ই এস ইউ সি আই (সি)-র বিশ্লেষণ ছিল, ৩৭০ প্রত্যাহার কাশ্মীরের জনগণকে দেশের মূল স্রোত থেকে আরও দূরে ঠেলে দেবে, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলিকেই বাড়তি শক্তি দেবে। এই বিশ্লেষণ কত অভ্রান্ত তার প্রমাণ বর্তমানের কাশ্মীর। কংগ্রেসের ধারাবাহিকতায় বিজেপি সরকারের নির্মম দমন-পীড়ন কাশ্মীরের জনগণের মন জয় করার পরিবর্তে বিরাট অংশের জনসাধারণকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে।