বিমান বসুর বক্তব্য বিস্ময়কর

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ৭ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন, গত ৫ এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনে বর্ষীয়ান সিপিআই(এম) নেতা কমরেড বিমান বসু ইলেক্টোরাল পলিটিক্সে বামফ্রন্টের সঙ্গে এসইউসি যাবে না, এটা তাদের ঘোষিত নীতি’ বলে যে মন্তব্য করেছেন তা আমাদের অত্যন্ত বিস্মিত করেছে।

প্রথমত, ‘নির্বাচনী লড়াইয়ে আমরা সিপিএমের সাথে যাব না’ এ রকম কোনও ঘোষণা যে আমাদের নেই এবং গণআন্দোলনের স্বার্থে আমরা যে সংগ্রামী বামপন্থার ঐক্য চাই, যা কংগ্রেসকে সাথে নিয়ে হতে পারে না– আমাদের এই বক্তব্য বিমানবাবুর অজানা থাকার কথা নয়।

লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে কমরেড বিমান বসু আমাকে ফোন করে লোকসভা নির্বাচনে একসাথে কিছু করা যায় কি না– সে বিষয়ে আলোচনার কথা বলেন। দলীয় কাজে আমি কলকাতার বাইরে থাকার কারণে ফিরে গিয়ে এই বিষয়ে বিস্তৃত ভাবে কথা হবে বলে ওনাকে জানাই। তারপর থেকে গত ৫ এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে আর কোনও ধরনের যোগাযোগ হয়নি।

দ্বিতীয়ত, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর সিপিআই(এম)-এর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রকাশ কারাত আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের সাথে আলোচনার জন্যে কলকাতায় আসেন এবং দেশব্যাপী যুক্ত বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হয়। এই আলোচনার ভিত্তিতেই সিপিআই(এম), সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআই(এমএল) এবং এসইউসিআই(সি) এই ৬টি দলের বামজোট গড়ে ওঠে। এই জোটের পক্ষ থেকে কিছু বিবৃতি দেওয়া হয় এবং যৎসামান্য কিছু কর্মসূচি পালিত হয়। কিন্তু দেশব্যাপী কার্যকরী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রশ্নে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ বারবার সিপিআই(এম) নেতাদের কাছে চিঠি দিলেও তার কোনও উত্তর দেওয়া দূরের কথা, চিঠি প্রাপ্তির সৌজন্যটুকুও তাঁরা দেখাননি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য ৬টি বামপন্থী দলের এই জোটের আন্দোলন প্রসঙ্গে এ-ও সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ‘দেশব্যাপী এই জোট যৌথ বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করবে।’ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছর সিপিআই(এম) ফ্রন্ট সরকারের বিভিন্ন জনস্বার্থবিরোধী অবাম নীতির কারণে সৃষ্ট জনরোষের ফলে পশ্চিমবঙ্গে আপাতত আমরা কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বামপন্থী দলগুলির যুক্ত আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করব। সেই ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচিতে আজও আমরা সামিল আছি। এটা নিঃসন্দেহে এই কর্মসূচিগুলিতে পাশাপাশি থাকা বিমানবাবুরও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।

তৃতীয়ত, ২০১৯-এর ৫ আগস্ট আমরা হঠাৎ লক্ষ করলাম, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপ প্রসঙ্গে আমাদের সাথে কোনও আলোচনা ছাড়াই সিপিআই(এম) সহ বাকি ৫টি দল সংবাদমাধ্যমে যৌথ বিবৃতি দিল। বিমানবাবুর কাছে এর কারণ সরাসরি জানতে চাইলেও কোনও সদুত্তর আজও আমরা পাইনি। আসলে কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী জোট গড়বার স্বার্থেই ৬টি বামপন্থী দলের ঐক্যকে তারা নিজেরা ভেঙেছিলেন– এ কথা কি তাঁরা অস্বীকার করতে পারবেন? প্রায় অনুরূপ ভাবে গত শতাব্দীর সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইন্দিরা কংগ্রেসের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়ে এসইউসিআই (সি)-র সাথে সিপিএম ঐক্য ভেঙেছিল।

চতুর্থত, নির্বাচনী লড়াই-এ আইএসএফ এবং কংগ্রেসের সাথে তাদের ঐক্য প্রসঙ্গে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও অবস্থান কোনও ভাবেই কমরেড বিমান বসু সহ অন্যান্য বাম দলগুলির নেতৃত্বের অজানা থাকার কথা নয়। কারণ, এ নিয়ে নানা ভাবে আলোচনাও হয়েছে।

আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, পুঁজিপতি শ্রেণির অন্যতম বিশ্বস্ত দল কংগ্রেস সবচেয়ে বেশি দিন কেন্দ্রীয় সরকারে থেকে জরুরি অবস্থা জারি সহ ফ্যাসিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতির ঘৃণ্য রাজনীতির চর্চা করেছে–সেই কংগ্রেসের সাথে ঐক্য করে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসীন সাম্প্রদায়িক ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী আর একটি দল বিজেপির বিরুদ্ধে সত্যিকারের সংগ্রাম কোনও ভাবেই গড়ে উঠতে পারে না। একই ভাবে রাজ্য সরকারে আসীন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ও অতীতের সরকারগুলির মতোই পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও যথাযথ লড়াইও সম্ভব নয়। অন্য দিকে, সিপিআই(এম)-কংগ্রেসের জোটের বিশ্বাসযোগ্যতাও তো ধুলোয় মিশে গিয়েছে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জোটে জেতা বিধায়কের তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করার দ্বারা। আবার, যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন বলে তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য করছেন–দুঃখজনক হলেও একটা কথা কি অস্বীকার করা যায় যে, গত লোকসভা নির্বাচনে ‘আগে রাম পরে বাম’–এই ধরনের আওয়াজ তুলে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তাঁরাই বিজেপির মতো শক্তির এতখানি উত্থানে সহায়তা করেছেন? একদিন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বামপন্থী আন্দোলনের গৌরব। নির্বাচনের স্বার্থে সেই কংগ্রেসের সাথে ঐক্য, এমনকি আইএসএফ-এর মতো শক্তির সঙ্গে ঐক্য গঠনের প্রচেষ্টার দ্বারা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যত কথাই তাঁরা বলুন–তা একদিকে বামপন্থার আদর্শকে জনসাধারণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করছে এবং অপরদিকে প্রকৃত বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

একজন বর্ষীয়ান নেতা হিসাবে কমরেড বিমান বসুর এই সমস্ত কিছুই অজানা থাকার কথা নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক সম্মেলনে এস ইউ সি আই (সি) সম্পর্কে তাঁর বিবৃতি অপ্রত্যাশিত এবং আমাদের তা হতবাক করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সকল মানুষকে, বিশেষ করে বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষকে বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখার জন্য আবেদন করছি।