পেট্রল-ডিজেল-কেরোসিন-রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ রাজ্য জুড়ে

কলকাতার এসপ্ল্যানেডে বিক্ষোভ শেষে প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুলে আগুন দিচ্ছেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য

পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এস ইউ সি আই (সি)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ১-৭ জুলাই প্রতিবাদ সপ্তাহ পালনের ডাক দেয়। রাজ্যের সব জেলাতেই অসংখ্য বাজার, গঞ্জ এলাকায় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। পোড়ানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুল। রাজ্য জুড়ে এই কর্মসূচিতে মানুষের মধ্যে প্রবল সাড়া পড়ে। ৬ জুলাই কলকাতার ধর্মতলায় প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেন দলের রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য। এ ছাড়াও ছিলেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেডস অশোক সামন্ত, তরুণ মণ্ডল, কলকাতা জেলা সম্পাদক কমরেড সুব্রত গৌড়ী এবং রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেডস রবি বসু ও অজয় চ্যাটার্জী। সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কুশপুতুলে অগ্নিসংযোগ করেন কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, বক্তব্য রাখেন কমরেড তরুণ মণ্ডল। কলকাতার ঢাকুরিয়ায় প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করে। কলকাতার নানা এলাকা সহ ওই দিন রাজ্যের সব জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখানো হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়।

বর্তমান সময়ে একদিকে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির বোঝা, অন্যদিকে করোনা অতিমারির কবলে সারা দেশের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। কত পরিবার যে তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে, কত পরিবার করোনা চিকিৎসা করাতে গিয়ে পথের ভিখারি হয়ে গেছে, তার সঠিক হিসাব নেই। টিকার চরম আকাল দেশ জুড়ে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতিতে চড়া দামে টিকা বিকোচ্ছে কর্পোরেট হাসপাতালে, গরিব মধ্যবিত্ত মানুষ টিকার জন্য হা-পিত্যেশ করে থেকেও তা পাচ্ছেন না।

এর মধ্যে মাত্র দু’মাসেই ২ কোটির বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। যাদের কাজ টিকেও আছে তাদের অনেকেরই কমেছে মজুরি। রোজগারের সমস্ত সুযোগ হারিয়ে কোটি কোটি মানুষ আজ চরম অসহায়।

বেহালা

এই পরিস্থিতিতে মানুষ ভেবেছিল, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একটু সুরাহার বন্দোবস্ত করবে। কিন্তু কোথায় সুরাহা? কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিতে পেট্রল-ডিজেলের দাম প্রতিদিন বাড়তে বাড়তে প্রায় ১০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলেছে। রান্নার গ্যাসের দামও প্রায় হাজার টাকা ছুঁতে চলেছে। এমনকি গরিব মানুষের প্রয়োজনীয় জ্বালানি কেরোসিনের উপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়ায় তার দামও আকাশছোঁয়া। তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথেই সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে ব্যাপক হারে। সমস্ত ভোজ্য তেলের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। বেড়েছে চাল, ডাল সহ সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের দাম। দাম কমানোর কোনও চেষ্টা দূরে থাক, অতিমারির সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনকে দুর্বল করে দিয়ে ফরচুন, রিলায়েন্স, আইটিসির মতো কর্পোরেট কোম্পানির ধনকুবের মালিকদের লাগামছাড়া লাভের রাস্তা খুলে দিয়েছে। পেট্রোপণ্যের ব্যবসায় সরকার এবং দেশি-বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো এক বিপুল লুঠের কারবার খুলেছে। এ বছরই ১২ জুন পর্যন্ত ৪৮ বার তেলের দাম বেড়েছে। ২০১৪-২০২০– বিজেপি শাসনের এই ছ’বছরে পেট্রল-ডিজেলে সরকারের কর বেড়েছে ৩০০ শতাংশ (হিন্দুস্তান টাইমস, ২২ মার্চ, ‘২১)। তথ্য বলছে, কেন্দ্র ও রাজ্য মিলে এখন দেশে তেলের উপর ট্যাক্স আদায় করছে ৬৩ শতাংশ (দ্য হিন্দু ডট কম, ৩১ মে, ‘২১)। সরকারের পাশাপাশি মানুষকে লুটছে রিলায়েন্স, এসার, আদানি গোষ্ঠী সহ সরকারি তেল কোম্পানিগুলি। তাদের মুনাফা প্রতি তিন মাসে দ্বিগুণ, তিনগুণ হারে বাড়ছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম এখন ২০১৪ সালের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। এছাড়াও সরকারের মদতে তেল কোম্পানিগুলি বিপুল পরিমাণ তেল তিন-চার মাস আগেই স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভের নামে মজুত করে নিয়েছে। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল একেবারে তলানিতে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সামান্য দাম বাড়লেই, এমনকি না বাড়লেও তারা ভারতে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় তেলমন্ত্রী বলছেন এই বাড়তি লাভ নাকি তাঁরা করোনা চিকিৎসায় খরচ করছেন।

সাধারণ মানুষ লক্ষ করছেন কেন্দ্রীয় সরকার কাজ হারানো, খেটে-খাওয়া মানুষের হাতে ত্রাণ প্যাকেজ না দিয়ে ২০ লক্ষ কোটি টাকা দিয়েছে একচেটিয়া মালিকদের। শিল্পপতিদের এই তালিকায় এখন বড় বড় ব্যবসায়ীদেরও যুক্ত করেছে। মানুষ ত্রাণ প্যাকেজের দাবি জানালেও সরকার তা শুনছে না। সরকারি উদাসীনতা এত মারাত্মক যে, সুপ্রিম কোর্টকেও বলতে হয়েছে, গরিব মানুষের জন্য রেশনে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও দায়বদ্ধতাই অনুভব করছে না। এস ইউ সি আই (সি) দাবি, রেশনে পর্যাপ্ত চাল, গম, সরষের তেল বিনামূল্যে দিতে হবে।

করোনায় বিপর্যস্ত মানুষ প্রতিবাদ করতে পারবেন না, এই হিসাব কষে তারা জনবিরোধী কৃষি আইন, শ্রমিক বিরোধী শ্রম কোড, জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন, শিক্ষার উপর আঘাত হানা শিক্ষানীতি এই সময়েই চাপিয়ে দিয়েছে। একচেটিয়া মালিকদের হাতে বেচে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত নানা সংস্থা। প্রতিবাদ সপ্তাহে এই নীতিগুলির জনবিরোধী চরিত্র তুলে ধরেছে দলের নেতা-কর্মীরা।

এস ইউ সি আই (সি) বরাবরই বলছে, কোনও সরকার এসে সোনার বাংলা নাকি সোনার ভারত গড়বে, সেই খোয়াব দেখে ভোটের রাজনীতির চক্করে ফেঁসে গেলে এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মানুষের মুক্তি নেই। একমাত্র পথ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়। সমস্ত পেশার সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের সংঘবদ্ধ গণকমিটি গড়ে তুলে এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে সরকারের এই লুঠের কারবার বন্ধ করা সম্ভব।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা