পাঠকের মতামত—রাফায় গণহত্যার নীরব দর্শক স্বঘোষিত উন্নত দুনিয়া

ধূসর বালি মাটির বুকে যতদূর চোখ যায় সাদা রঙের ছোট বড় তাঁবু দেখা যাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে একটা করে নীল রঙা তাঁবু নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব প্রকাশ করছে। প্রায় তিন মাইল ভূখণ্ড জুড়ে হাজার হাজার তাঁবু। রাতে পাতলা অন্ধকার, আর দিনের বেলায় ঝলমলে রোদ। কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর ভেসে আসছে বোমারু বিমান ও বুলেট শুটিংয়ের শব্দ। ভয় হয় এই বুঝি এক আধটা টুকরো এসে পড়ল। মধ্যে মধ্যে কেঁপে উঠছে পায়ের মাটি। এক একটি তাঁবুতে ৯-১০ জন গাদাগাদি করে কোনওভাবে বেঁচে থাকা। শিশুরা প্রত্যহ দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায় না। না, না, কোনও সিনেমার চিত্রনাট্য বা উপন্যাসের কল্পকাহিনী নয়, গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে প্রবল শীতের মধ্যে রাফার ঊষর ভূমিতে সাড়ে ১০ লক্ষ প্যালেস্টিনীয় উদ্বাস্তুর এই হচ্ছে বাস্তব জীবন। নিজভূমে পরবাসী এই বিপুল সংখ্যক গাজাবাসী রাফার দক্ষিণ সীমান্তে আজ মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে।

ইজরায়েল স্থলবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করার আগে প্যালেস্টিনীয়দের আরও দক্ষিণে (মিশরের সিনাই মরুভূমিতে) সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু মিশরের সীমান্তেও তো প্রহরী! ১০ দিকের মধ্যে বাকি ৯টি দিক ইজরায়েলি দখলদারি বাহিনীর দখলে। একবার কল্পনা করে দেখুন—অত্যাধুনিক এই মানবসভ্যতার বুকে শতাব্দীর যে অসভ্য, নির্মম ও বর্বরতম গণহত্যা ঘটতে চলেছে, আমরা সবাই তার ঐতিহাসিক সাক্ষী হয়ে থাকব।

হাজার হাজার মাইল দূরে প্যালেস্টিনীয়দের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী-জায়নবাদী ইজরায়েলের যুদ্ধ নামক এই গণহত্যার আঁচ সত্যিই কি আমাদের গায়েও এসে পড়ছে? এই যে দেশের প্রতিরক্ষার নামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা জুড়ে সারি সারি মিসাইল উৎক্ষেপণ কেন্দ্র তৈরির হাঙ্গামায় লক্ষ লক্ষ গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে জীবন-জীবিকা থেকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র চলছে, এর আঁচ কি আমাদের গায়ে লাগে? নাকি উগ্র মৌলবাদী প্রচার ও ভণ্ড দেশপ্রেমের ছলনায় আমরা প্রতারিত হচ্ছি?

দেশ মানে তো দেশের মানুষ। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের বাসস্থান ধ্বংস করে ও তাদের জীবিকাহীন করে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো কোন দেশকে রক্ষা করতে চাইছে? এই প্রশ্ন মনে ধাক্কা দেয় না? এই মিসাইল কোন কোম্পানি তৈরি করছে? তৈরি হয়ে কোথায় যাবে? কোন যুদ্ধে এই মিসাইল দিয়ে কোন দেশের মানুষকে খতম করা হবে?

ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রের মোদি সরকারের উদ্যোগে আদানি ও এলবিট জয়েন্ট গ্রুপ ভারতে তৈরি ২০টি কিলার ড্রোন (হার্মস ৯০০) ইজরায়েলকে বিক্রি করেছে। তারপর ইজরায়েল সেই ড্রোন দিয়ে নির্বিচারে প্যালেস্টিনীয় শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের বেছে বেছে হত্যা করছে। আর কোটি কোটি টাকার লাভ তুলছে আদানি গ্রুপ। এই বৃহৎ ভারতবর্ষ নামক ভূখণ্ডের মধ্যে পাশাপাশি দুটি দেশের চিত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কি? আদানির মতো বৃহৎ রাঘব বোয়ালদের রাজত্ব রক্ষা করার জন্যই তো মিসাইল উৎক্ষেপণ কেন্দ্র তৈরির এই সামগ্রিক পরিকল্পনা চলছে। ওদের লাভের জন্য ও দেশবাসীর মগজ ধোলাইয়ের জন্যেই এ দেশে মধ্যে মধ্যেই যুদ্ধ যুদ্ধ হুঙ্কার ওঠে। দেশ রক্ষার হুজুগ তুলে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের় ভয়ঙ্কর নাটক মঞ্চস্থ করেন ৫৬ ইঞ্চি ছাতির মহামহিম। এই কারণেই ইজরায়েলের সাথে অস্ত্র চুক্তি করেছে মোদি সরকার। অন্য দিকে কোটি কোটি ভারতবাসীর জন্যে একের পর এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে। ধর্ম-বর্ণ-জাতের নামে মগজে ঢেলে দিচ্ছে ঘৃণা ও দাঙ্গার উগ্র বিষ।

ওদের অঙ্ক হল, দেশ (বিজেপি, আরএসএস) খতরে মে হ্যায়, দেশের প্রতিরক্ষার (আদানি, আম্বানিদের রাজত্বের) জন্য কিলার ড্রোন, হিন্দুরা (বিজেপির ভোটবা’) সংকটে, দেশকা সাথ সবকা (আদানি, আম্বানি…) বিকাশ! এই গণিতটা, এই অঙ্কটাই ওদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার আসল মন্ত্র। আর দেশের আপামর জনতার মন্ত্র হল—ফ্যাসিবাদী ও সাম্রাজ্যলোভী যুদ্ধ নয়। দাঙ্গার আগুন আর নয়। যথার্থ স্বাধীন ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক শান্তি চাই। আসুন এই সব পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মালিকদের সর্বগ্রাসী মুনাফার এই বিধ্বংসী রাজত্বকে নিজের নিজের দেশের মাটিতে কবর দেওয়ার শপথ নিই। তবেই হয়তো আমাদের এতদিনের নীরবতার মুখে লেগে থাকা প্যালেস্টাইন থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত এই সর্বব্যাপী গণহত্যার পঙ্কিল দাগকে চিরতরে মুছে ফেলতে সফল হব।

দীপক কুমার গিরি

বেলদা, পশ্চিম মেদিনীপুর