দীর্ঘ বন্দিজীবনে বিপ্লবী আদর্শনিষ্ঠা এবং বলিষ্ঠতার নজির কমরেড অনিরুদ্ধ হালদার ও কমরেড বাঁশিনাথ গায়েন

দলের কেন্দ্রীয় দফতরে কমরেড অনিরুদ্ধ হালদার, সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ও কমরেড বাঁশিনাথ গায়েন ( বাঁ দিক থেকে পরপর)

রাজ্যের পূর্বতন সিপিএম সরকারের সাজানো মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘ ১৮ বছর চার মাস জেলে কাটিয়ে অবশেষে হাইকোর্টের রায়ে ১৪ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেলেন এস ইউ সি আই (সি)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য ও জননেতা কমরেড অনিরুদ্ধ হালদার এবং দলের বিশিষ্ট সংগঠক কমরেড বাঁশিনাথ গায়েন। এ দিন কারামুক্তির পর দুই কমরেড বারুইপুর সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে কলকাতায় দলের কেন্দ্রীয় অফিসে পৌঁছান। সেখানে সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সহ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা তাঁদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানান। এরপর কমরেড অনিরুদ্ধ হালদার ও কমরেড বাঁশিনাথ গায়েন জয়নগরে দলের জেলা অফিসে গেলে সেখানেও নেতা-কর্মীরা তাঁদের স্বাগত জানান। পর দিন তাঁরা জয়নগর থেকে কুলতলির ঘটিহারানিয়ার দিকে রওনা হন। পথে দলের অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী, দরদি, সমর্থক, নেতা-কর্মী বিভিন্ন মোড়ে গাড়ি থামিয়ে পুষ্পস্তবক দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানান। অনেকে আনন্দে তাঁদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। ঘটিহারানিয়া পার্টি অফিসে কয়েকশো কর্মী-সমর্থক-দরদি তাঁদের স্বাগত জানান। তাঁরা সেখানে শহিদ বেদিতে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শোষণমুক্ত সমাজের লক্ষ্যে পরিচালিত বিপ্লবী আন্দোলনের দুই নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক এবং জননেতা কারামুক্ত হওয়ায় কুলতলি-জয়নগর এলাকায় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে।

১৯৮৫ সালের ১৪ জানুয়ারি কুলতলি বিধানসভায় চুপড়িঝাড়া অঞ্চলের রাধাবল্লভপুরে এস ইউ সি আই (সি) নেতা ও তৎকালীন স্থানীয় অঞ্চল প্রধান কমরেড বসুদেব পুরকাইতকে কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতীরা গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য একজন স্থানীয় মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। গুলির শব্দ এবং আহত ব্যক্তির চিৎকারে চতুর্দিক থেকে অগণিত মানুষ ছুটে আসেন। গণপ্রহারে দুই দুষ্কৃতীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু সংবাদপত্র এস ইউ সি আই (সি) বিরোধী কুৎসা চালায়। তৎকালীন শাসকদল সিপিএম ষড়যন্ত্র করে এই ঘটনায় কুলতলির তৎকালীন বিধায়ক প্রবোধ পুরকাইত সহ এস ইউ সি আই (সি)-র ১১ জন নেতা-কর্মী-সংগঠকের নাম জড়িয়ে দেয়।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি ও জয়নগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় এস ইউ সি আই (সি) দলের শক্তিশালী গণভিত্তিক সংগঠন ভাঙার জন্য কংগ্রেস যেমন সরকারে থাকার সময় তাদের পোষা ক্রিমিনালদের সাহায্যে এস ইউ সি আই (সি)-র নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ, মিথ্যা মামলা করে গেছে, সিপিএম এবং পরে তৃণমূল কংগ্রেসও সরকারে বসে একই কাজ করেছে। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে সিপিএমের এক মন্ত্রী এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিতে থাকেন।

১৯৯৭ সালে বিশিষ্ট জননেতা কমরেড আমির আলী হালদার, দেবীপুরে পাঁচ জন দলীয় কর্মী, মধুসুদনপুরে রহিমব’ সর্দার প্রমুখ শহিদ হন। ২০০২-তে কমরেড অশোক হালদার ও মোসলেম মিস্ত্রী সহ বেশ কয়েকজন কমরেড খুন হন। এস ইউ সি আই (সি) দলের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর জন্য সিপিএম নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ ভাবে পুলিশ-প্রশাসনকে পরিচালিত করে। রাধাবল্লভপুরের মামলায় তিনবার চার্জশিট বদল হয়। পুলিশের সর্বাত্মক অপচেষ্টা এবং ষড়যন্ত্রে ট্রায়াল কোর্টে দলের ৬ জন নেতা-কর্মীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও ৯ বারের বিধায়ক জননেতা কমরেডপ্রবোধ পুরকাইত, তৎকালীন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সদস্য এবং কুলতলি বিধানসভার বিশিষ্ট সংগঠক কমরেড অনিরুদ্ধ হালদার, নলগোড়া অঞ্চলের প্রধান ও চুপড়িঝাড়া হাইস্কুলের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক কমরেড বাঁশিনাথ গায়েন প্রমুখ নির্দোষ প্রমাণিত হন। কিন্তু সিপিএমের ষড়যন্তে্র প্রায় ২০ বছর বাদে ২০০৫-এ আকস্মিকভাবে হাইকোর্টে মামলা ওঠে এবং কার্যত শুনানিতে অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়েই ট্রায়াল কোর্টের় রায় বাতিল করে প্রবোধ পুরকাইত, অনিরুদ্ধ হালদার, বাঁশিনাথ গায়েন, হরিসাধন মালি সহ অন্যদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

২০১৫-র আগস্টে কমরেড প্রবোধ পুরকাইত মুক্তি পান। দীর্ঘ কারাবাসের ধাক্কায় তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে, তিনি অল্পদিনের মধ্যেই প্রয়াত হন। কমরেড হরিসাধন মালি এবং কওসর বৈদ্য কারান্তরালেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সাজার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর অন্যান্য কমরেডরা মুক্ত হলেও সুপ্রিম কোর্টের রায় সত্ত্বেও এতদিন কমরেড অনিরুদ্ধ হালদার ও কমরেড বাঁশিনাথ গায়েনকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছিল না।

মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দল এস ইউ সি আই (সি)-র এই দুই লড়াকু সৈনিক দলের কারাবন্দি অন্যান্য নেতৃস্থানীয় কমরেডদের সঙ্গে মিলে জেলের অভ্যন্তরেও কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে নিয়ে গেছেন। দীর্ঘ কারাজীবনে হতাশা ও গ্লানি তাঁদের কখনও গ্রাস করেনি বরং কারাভ্যন্তরে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে কী ভাবে মার্ক্সবাদকে বন্দিদের মধ্যে নিয়ে যাওয়া যায় তার নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। সমাজের নানা সমস্যাকে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সাধারণ বন্দিদের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। জেলে কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়ম, বন্দিদের উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন এমনকি বন্দিদের দ্বারা বন্দিদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধেও জেলের ভিতরে তাঁরা বন্দিদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলেন কারাব্যবস্থায় দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী হয়েও অধিকাংশ কারাকর্মী এবং অন্যান্য সহ-বন্দিদের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। জেলের অভ্যন্তরে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী শহিদদের আত্মোৎসর্গ দিবস, মনীষীদের স্মরণ অনুষ্ঠান, দলের প্রতিষ্ঠা দিবস, সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের স্মরণ দিবস যেমন পালন করেছেন তেমনই যৌথভাবে দলের প্রচার পুস্তিকা পাঠ ও চর্চা করতেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে পরিচালিত এই সংগ্রাম ও মহত্ত্ব লক্ষ করে বহু কারাকর্মী ও বন্দি অনুপ্রাণিত হয়েছেন, আকৃষ্ট হয়েছেন। বহু সাধারণ বন্দি ছাড়া পাওয়ার পর দলের সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীতে পরিণত হয়েছেন।

কমরেড অনিরুদ্ধ হালদারের কারাবাস কালে তাঁর পারিবারিক জীবনে ঘটে গেছে একাধিক সন্তানের মৃত্যু সহ একাধিক গভীর মানসিক আঘাত পাওয়ার মতো ঘটনা। কিন্তু কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে ব্যক্তিগত শোককে তিনি শক্তিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। জেলে থাকাকালীনই তিনি দলের রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

জেলবন্দি জীবনেও কমরেড অনিরুদ্ধ হালদার এবং কমরেড বাঁশিনাথ গায়েনের বলিষ্ঠ ভূমিকা সকল কর্মীর বিপ্লবী জীবনসংগ্রামে গভীর অনুপ্রেরণার বিষয় হয়ে থাকবে।