কর্ণাটকে বিজেপি পরাস্ত কিন্তু এতে তার দুষ্ট রাজনীতি পরাস্ত হবে না

‘সরকার যদি গ্যাসের দাম এভাবে বাড়িয়ে চলে, মন্দির আর আমাদের কী উপকার করবে?’– দিনের পর দিন বিপুল সাম্প্রদায়িক প্রচারের বন্যা সত্ত্বেও কর্ণাটক নির্বাচনে বিজেপির শোচনীয় হারের মূল কারণ এক কথায় বলতে গেলে রামনগরের বাসিন্দা কুমার গৌড়ার এই প্রশ্নটিকে বিনা দ্বিধায় বেছে নেওয়া যায়। ‘শোলে’ সিনেমাখ্যাত পাথুরে শিলাস্তরে ঘেরা কর্ণাটকের সেই রামনগর, যেখানে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে হাওয়া দিতে সদ্যপ্রাক্তন বিজেপি সরকার একটি ‘রাজকীয়’ রাম-মন্দির তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই প্রসঙ্গে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ওই পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন স্থানীয় মানুষটি। বাস্তবে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, দৈনন্দিন রুটি-রুজি সংক্রান্ত জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি সমাধানে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত বিজেপি সরকারের উদাসীনতা ও অপদার্থতাই কর্ণাটক নির্বাচনে বিজেপির এই লজ্জাজনক পরাজয়ের পিছনে কাজ করেছে।

দুর্নীতিকে সঙ্গী করেই পথচলা শুরু বিজেপি সরকারের

নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই বিজেপি সর্বশক্তি নিয়ে প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কর্ণাটকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে সেখানে ১৯টি জনসভা, ৬টি রোড শো করেছেন। সাম্প্রদায়িক উস্কানিকে মূল হাতিয়ার করে প্রতিটি ভাষণের শেষে ‘জয় বজরংবলী’ হুঙ্কার দিয়েছেন। দিনের পর দিন মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন অমিত শাহ, জেপি নড্ডার মতো তাবড় বিজেপি নেতারা। সাম্প্রদায়িক বিভাজন, জাতপাত, সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে বিভেদের বিষ ছড়িয়েছেন তাঁরা। ভুয়ো প্রতিশ্রুতির লম্বা তালিকাও বিলিয়েছেন। কিন্তু ভোটের ফল স্পষ্ট করে দিল যে, রাজ্যের মানুষ সে সব প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেখা গেল, ২২৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৬৬টি। ১৩৫টি আসন পেয়ে সরকার গড়ার সুযোগ পেয়েছে কংগ্রেস।

গত বিধানসভা নির্বাচনের পর কর্ণাটকে সরকার গড়েছিল কংগ্রেস-জেডিএস জোট। এক বছর যেতেই দেদার টাকা ছড়িয়ে ক্ষমতালোভী বিধায়কদের কিনে নিয়ে নতুন সরকার গড়ে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হন ইয়েদুরাপ্পা। সরকারি গদি দখলের সেই কৌশলের গালভরা নাম ছিল ‘অপারেশন লোটাস’। শুরু থেকেই বিজেপি সরকারের অঙ্গ হয়ে যায় ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ। দুর্নীতির অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর-এর নির্দেশ দেয় কোর্ট। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে তড়িঘড়ি বাসবরাজ বোম্মাইকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসাতে বাধ্য হয় বিজেপি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বদল হওয়ার পর দুর্নীতি কমার বদলে আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে। বিল মেটাতে সরকারি প্রশাসন ৪০ শতাংশ কমিশন চায়, এই অভিযোগ জানিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখেন এক কন্ট্রাক্টর। বোম্মাই সরকারের নামই হয়ে যায় ‘৪০ পার্সেন্ট সরকার’। এক ক্যাবিনেট মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিজেপি সমর্থক ঋণগ্রস্ত এক কন্ট্র্যাক্টর আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। এবারের নির্বাচনে রাজ্যের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সেই বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে কর্ণাটকের মানুষের ক্ষোভ ফেটে পড়েছে।

সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা মেনে নেয়নি মানুষ

বিজেপিও জানত মানুষের ক্ষোভের আগুন চাপা দেওয়ার সাধ্য তাদের নেই। তাই দলের রাজ্য সভাপতি নলিন কুমার কাটিল প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, উন্নয়ন নয়– এবারের ভোটের মূল ইস্যু করতে হবে ‘লাভ জিহাদ’কে। টিপু সুলতানকে হিন্দুবিদ্বেষী সাজিয়ে ইতিহাসের নামে নতুন করে গল্প ছড়িয়েছিল বিজেপি। ভোটবাক্স  ভরানোর লক্ষে্য কর্ণাটকের প্রভাবশালী ভোক্কালিগা সম্প্রদায়কে খুশি করতে সেই সম্প্রদায়ের দুই কাল্পনিক নায়ককে টিপু সুলতানের হত্যাকারী হিসাবে খাড়া করার চেষ্টা করেছিল তারা। খোদ ভোক্কালিগাদের ধর্মগুরুরাই সেই মিথ্যা গল্পের বিরুদ্ধতা করেছেন। কর্ণাটকের বহু অঞ্চলেই টিপু সুলতান সম্পর্কে জনজীবনে যথেষ্ট সম্ভ্রম রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ তো দূর, খোদ বিজেপি-র কর্মী-সমর্থকদের একাংশও এই মিথ্যাপ্রচার ভাল ভাবে নিতে পারেননি। এমনকি ভোটের ঠিক আগে মুসলিমদের একটি অংশের থেকে সংরক্ষণের সুযোগ কেড়ে তা ভোক্কালিগা ও লিঙ্গায়েতদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার টোপও কাজ দেয়নি। সংখ্যালঘুবিদ্বেষ ছড়াতে বিজেপি সরকারের হিজাব ও হালাল-মাংসে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মেরুকরণের চেষ্টাও জনগণের ক্ষোভ চাপা দিতে পারেনি। বিজেপি সরকারের যে মন্ত্রী হিজাব পরে স্কুলে আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, সেই বিসি নাগেশ ভোটে হেরেছেন। এমনকি হালাল-মাংস নিষিদ্ধ করা নিয়ে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়ানোয় প্রবল উৎসাহী ছিলেন যে বিজেপি নেতা, সেই সিটি রবিরও এবার ভরাডুবি হয়েছে কোডাগু কেন্দ্রে। অথচ কর্ণাটকের যে অল্প কয়েকটি অঞ্চল হিন্দুত্ববাদীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত, কোডাগু কেন্দ্রটি সেখানেই।

শিক্ষা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে

স্কুলস্তরের ছেলেমেয়েদের দলীয় সংকীর্ণ ভাবধারায় জারিত করতে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু পাল্টে দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছিল বিজেপি সরকার। এই উদ্দেশ্যে আরএসএসের বেছে দেওয়া কয়েকজনকে নিয়ে তৈরি করেছিল ‘টেক্সটবুক রিভিশন কমিটি’। শহিদ ভগৎ সিং, নারায়ণ গুরু, ১২ শতকের সমাজ-সংস্কারক বাসবান্নাকে সিলেবাস থেকে বাদ দিয়েছিল কমিটি। নবজাগরণের কবি কুভেম্পু, আম্বেদকরের ভূমিকা সংক্রান্ত পরিচ্ছেদগুলি কাটছাঁট করেছিল। এর বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও প্রথম প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। রাজ্য জুড়ে জোরদার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকারের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলে তারা। কর্ণাটকের সাধারণ মানুষ যে বিজেপির এই অশুভ প্রচেষ্টা মেনে নেননি, ভোটের ফলে তা পরিষ্কার হয়েছে। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন সেখানকার শিল্পী, বুদ্ধিজীবী সহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনেরাও। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ‘সেভ এডুকেশন কমিটি’-র নেতৃত্বে কর্ণাটকের শিক্ষাপ্রেমী মানুষ ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনটিও গণতান্ত্রিক, বৈজ্ঞানিক, আধুনিক শিক্ষা ধ্বংসকারী বিজেপির ঘৃণ্য চেহারা রাজ্যের মানুষের সামনে তুলে ধরতে সাহায্য করে।

অর্থনৈতিক দুরবস্থায় কর্ণাটকের জনজীবন বিপর্যস্ত

প্রশ্ন হল, বিপুল অর্থ খরচ করে লাগাতার প্রচারের জাঁকজমক সত্ত্বেও কেন বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতপাত ও সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে বিভেদ তৈরির চেষ্টা ভোটের অর্থে পুরো কাজ দিল না? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধিতে বিপর্যস্ত কর্ণাটকের জনজীবনের অসহনীয় অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের কল্যাণে বাঙ্গালোরের মতো শহরগুলির কিছুটা চাকচিক্য থাকলেও তার বাইরে কর্ণাটক জুড়ে দারিদ্র প্রবল। মানব উন্নয়ন সূচকে দেশের মধ্যে যথেষ্ট পিছনে রয়েছে এই রাজ্য। ২০২২-এর সরকারি হিসেবে, প্রতি ১ হাজারটি সদ্যোজাতের মধ্যে এ রাজ্যে মারা যায় গড়ে ২০টি শিশু। নীতি-আয়োগের তৈরি করা ২০২১ সালের দারিদ্রের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, কর্ণাটকের ৩৪ শতাংশ মানুষ যথাযথ পুষ্টি পান না। এই হিসাবে দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে কর্ণাটক। এ রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলির মানুষ তুলনায় আরও বেশি দরিদ্র। চিত্রদুর্গ, বেলারি, রাইচুর, গুলবর্গা, বিদার ইত্যাদি গ্রামীণ কৃষিপ্রধান এলাকাগুলিতে চাষের জন্য জলসেচের চরম অভাব। পরিকাঠামোর হালও ভাল নয়। নতুন কল-কারখানা তৈরি না হওয়া ও চালু কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুণ কৃষিক্ষেত্রই রাজ্যের কর্মসংস্থানের মূল ভরসা। কিন্তু জলসেচ, বিদ্যুৎ ইত্যাদির অভাবে এবং ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় আর্থিক দুর্দশা কৃষকদের পিছু ছাড়ে না। চাষের কাজের ফাঁকে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে তাদের কাছে। ফলে কর্ণাটকে বছরে বছরে বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। জাতীয় গড়ের তুলনায় বেকারত্বের হার কম কর্ণাটকে। কিন্তু অদক্ষ শ্রমিক, কর্পোরেট সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক এমনকি সরকারি কাজে যুক্ত ঠিকা-কর্মচারীদের মজুরি বা বেতন নিতান্তই সামান্য। জামাকাপড় তৈরির কারখানার মহিলা শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ি ও সহায়িকা, ঠিকায় কাজ করা পৌরকর্মী সহ রাজ্যের শ্রমিক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে বেতন বৃদ্ধি ও কাজের নিয়মিতকরণের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি রাজ্যের বিজেপি সরকার শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনার তোয়াক্কা না করেই শ্রমিকদের কাজের সময় ৮ ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করে দেয় যা খেটে-খাওয়া মানুষের মনে বিপুল ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

২০২০ সালে বিজেপি সরকার গো-হত্যা নিবারণী আইন করার পর থেকে গো-রক্ষক বাহিনীর রমরমা বাড়তে থাকে রাজ্যে। সাথানুর়ে গোরক্ষক বাহিনীর হাতে এক সংখ্যালঘু মানুষের মৃত্যুও হয়। এতে ভোটে সুবিধে পাওয়ার বদলে ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে এলাকার মানুষ বিজেপির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। গবাদি পশুর মেলায় আতঙ্কিত মুসলিমরা আসতে চান না বলে গত কয়েক বছর ধরে কর্ণাটকে পশু কেনাবেচার বাজারের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পরিণামে আর্থিক দুর্দশা আরও বেড়ে গেছে কৃষক পরিবারগুলির।

‘বাম’ নামধারী দলগুলির সুবিধাবাদী আচরণ

সব মিলিয়ে বিজেপি সরকারের অপশাসনে বিরক্ত কর্ণাটকের সাধারণ মানুষ গত কয়েক বছর ধরে সত্যিকারের একটি বিকল্প খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে একজোট করে রাজ্য জুড়ে জনজীবনের নানা দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার এটাই উপযুক্ত সময়– এ কথা বুঝে এসইউসিআই(সি) বামপন্থী দলগুলির সংগ্রামী জোট গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল কর্ণাটকে। এই উদ্দেশ্যে সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই(এমএল)-লিবারেশন, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরপিআই এবং স্বরাজ ইন্ডিয়ার সঙ্গে জোট করে এসইউসিআই(সি) বেশ কিছু আন্দোলন চালায়। জনগণের দাবিপত্র তৈরি করে, ছাপিয়ে তা ব্যাপক ভাবে বিলি করাও হয়। কিন্তু নির্বাচন ঘোষণার পরেই, ‘যে কোনও উপায়ে বিজেপিকে পরাজিত করাই এখন সবচেয়ে জরুরি’– এই অজুহাত দেখিয়ে, আসলে যে কোনও উপায়ে বিধানসভায় কিছু আসন পাওয়ার লোভে সুবিধাবাদীর মতো সিপিআই দ্রুত হাত মেলায় কংগ্রেসের সঙ্গে এবং কংগ্রেস ও জেডিএস-এর সঙ্গে বোঝাপড়ায় চলে যায় সিপিএম। তিনটি আসনে জেডিএস সমর্থনও করে সিপিএম-কে। এই অবস্থায় এসইউসিআই(সি) একাই জনজীবনের দাবিগুলি নিয়ে নির্বাচনে ১৪টি আসনে লড়াই করেছে।

বিজেপি অপশাসনের বিরুদ্ধে জনরোষ কংগ্রেসের ভোটের ঝুলি ভরিয়েছে

রাজ্য সরকারের দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বুঝে আসরে নামে কংগ্রেস। ভোটে জিতলে জনগণকে দেদার খয়রাতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারে নামে তারা। শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার নীলনক্সা জাতীয় শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, আশা-অঙ্গনওয়াড়ি-মিড ডে মিল কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি, সরকারি দফতরের সমস্ত শূন্যপদে নিয়োগ, কৃষকদের জন্য বিনাসুদে ঋণ ইত্যাদি যে ন্যায্য দাবিগুলি নিয়ে এসইউসিআই(সি) দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে, সেই দাবিগুলিও পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কংগ্রেস। বিজেপি সরকারের স্বৈরাচারী অপশাসন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে কর্ণাটকের জনসাধারণের ক্ষোভ, জনস্বার্থবাহী কোনও বিকল্প না থাকায় কংগ্রেসের পক্ষে চলে যায়।

সরকার বদল হলেই সাম্প্রদায়িকতা দূর হয় না

সব মিলিয়ে এ কথা বলাই যায় যে, কর্ণাটক রাজ্য জুড়ে হিজাব, হালাল ও টিপু সুলতানকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির বিজেপির চিরাচরিত ভোট-কৌশল আপাতত ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস কি এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনও বিশ্বাসযোগ্য শক্তি? কর্ণাটকে ঘৃণার বাজার বন্ধ হল আর ভালবাসার দোকান খুলে গেল বলে রাহুল গান্ধী সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেছেন। কথাগুলি শুনতে ভাল সন্দেহ নেই। কিন্তু নরম হিন্দুত্বের লাইন অনুসরণ করে বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারের বিরুদ্ধে কংগ্রেস কার্যত কিছুই বলেনি। একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থের রক্ষক হিসাবে বিজেপির মতোই কংগ্রেসও যে পুঁজিপতি শ্রেণির অন্যতম প্রিয় রাজনৈতিক দল, অতীতে তার প্রমাণ বহুবারই পাওয়া গেছে। একচেটিয়া মালিকের মুনাফার স্বার্থে খেটে-খাওয়া মানুষের উপর শোষণ-জুলুম চালাতে তারা যে কারও চেয়ে কম যায় না, রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির সেবার লক্ষে্য প্রয়োজনে দাঙ্গা বাধানোর বা সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর বহু ঘটনাই যে তাদের ঝুলিতে আছে, তা-ও দেশের মানুষের অজানা নয়।

ফলে জয়ের প্রাথমিক উল্লাস থিতিয়ে গেলে কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার যে চিরাচরিত কায়দায় কর্পোরেট স্বার্থবাহী জনবিরোধী নীতি অনুসরণ করা শুরু করবে এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। ফলে জলকল্যাণমুখী প্রতিশ্রুতিগুলি রক্ষা করতে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে নতুন সরকার যাতে বাধ্য হয়, জনগণকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। তা ছাড়া, শুধু সরকার বদলে জনমানস থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ দূর করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন সমাজজুড়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবিরাম চর্চা ও জনজীবনের দাবিগুলি নিয়ে ব্যাপক গণআন্দোলন। নিছক ভোট-রাজনীতি নয়, একমাত্র সংগ্রামী বামপন্থার রাস্তাতেই তা সম্ভব।