স্বাস্থ্যসাথীঃ চ্যালেঞ্জের মুখে বিনামূল্যের চিকিৎসা

২৫ অক্টোবর রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তর এক নির্দেশনামায় ঘোষণা করেছে, এখন থেকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বাধ্যতামূলক। যারা চাকরিজীবী তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য স্বাস্থ্যকার্ড যথা পশ্চিমবঙ্গ হেলথ স্কিম, কেন্দ্রীয় সরকার হেলথ স্কিম, ইএসআই ইত্যাদি হেলথ কার্ডগুলি দাখিল করা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ এই কার্ড যাদের নেই তারা আর সরকারি হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাবেন না।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ২ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের হাতে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড রয়েছে এবং খুবই সীমিত সংখ্যক মানুষ যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি করেন তাঁরা অন্যান্য স্বাস্থ্যকার্ডের সুযোগ পেয়ে থাকেন। যদিও এই নির্দেশিকায় বলা আছে যাদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নেই তাদের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই কার্ড তৈরি করে দেবে, তারপরে তার ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে। এই কার্ডের বিনিময়ে যে কোনও মানুষই তার পরিবারের সকল সদস্যের জন্য বছরে ৫ লক্ষ টাকার চিকিৎসা বিনা অর্থ ব্যয়েই পাবেন বলে সরকারি ঘোষণা।

স্বাস্থ্যসাথী কার্ড এ রাজ্যে ২০১৬ থেকেই চালু হয়েছে। কেন্দ্রের আয়ুষ্মান ভারতের সমান্তরাল এই প্রকল্পটি কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই চালু হয়েছে। প্রথম দিকে নির্দিষ্ট কিছু পেশার মানুষ এই কার্ডের সুযোগ পেতেন। ২০২০-র ডিসেম্বর থেকে এই সুযোগ কিছু চাকরিজীবী ছাড়া রাজ্যের সব মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়েছে।

স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পটি কী? এটি আসলে একটি বিমানির্ভর স্বাস্থ্য প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গোটা দেশ জুড়ে যেমন চালু করেছেন আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য প্রকল্প, তেমনই এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চালু করেছেন স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প।

প্রকল্পে বলা হয়েছে পরিবার পিছু ১ বছরের জন্য ৫ লক্ষ টাকার চিকিৎসা পরিষেবা বিনা অর্থেই পাবেন। এর জন্য তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিমা কোম্পানি এবং টিপিএ-র (যেমন – বাজাজ অ্যানিয়ান্স, ইফকো টোকিও ইত্যাদি বৃহৎ কর্পোরেট বিমা কোম্পানি) সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ এরাই বহন করবে। কিন্তু প্রিমিয়ামের মোটা অঙ্কের টাকা সরকারই মেটাবে।

সরকার কোত্থেকে মেটাবে? না, মানুষের ট্যাক্সের টাকা থেকেই মেটাবে। কিন্তু আশঙ্কাটা অন্য জায়গায়। এখন বিমার প্রিমিয়াম হিসাবে টাকা দিতে না হলেও, ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের উপর প্রিমিয়ামের টাকা যে ধার্য করা হবে না, তার কিন্তু কোনও গ্যারান্টি নেই। এখনও পর্যন্ত এই পাঁচ লক্ষ টাকার মধ্যে ১.৫ লক্ষ টাকা সরকার বিমার প্রিমিয়াম হিসাবে বিমা কোম্পানিকে দিয়ে থাকে এবং বাকি ৩.৫ লক্ষ টাকা অ্যাসুয়েরেন্স হিসাবে থার্ড পার্টি মারফত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলিতে চিকিৎসার বিল মেটায়।

এতদিন সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেমন ছিল? স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ভারতের মতো জনকল্যাণমূলক একটি রাষ্ট্রে স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া না হলেও তা অবশ্যপ্রয়োজনীয় বিষয় হিসাবেই রয়েছে এবং সংবিধান মানুষের বাঁচার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে ৯০-এর দশকের আগে পর্যন্ত দেশের বহু জায়গায় এবং আমাদের রাজ্যেও সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ছিল একেবারেই ফ্রি। সেখানে কোনও রকম চার্জ বা কোনও রকম কার্ডের কোনও ব্যাপারই ছিল না।

৯০-এর দশকের শুরুতে এ রাজ্যে সিপিএম সরকার সরকারি হাসপাতালে আউট ডোর টিকিটের দাম ধার্য করে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ, বেড ভাড়া ইত্যাদি চালু করা হয়। পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম তদানীন্তন সিপিএম সরকারের হাত ধরে সরকারি হাসপাতালে সিটি স্ক্যান, এক্স রে, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি পরিষেবাগুলিতে পিপিপি নীতির অনুপ্রবেশ ঘটে। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে পরিষেবা বিক্রির অধিকার দেওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে মানুষকে সেখান থেকে পরিষেবা নিতে বাধ্য করা হয়। সে দিনও মানুষকে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল– সিটি স্ক্যানের মতো অত্যাধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ তো আগে মানুষ পেত না, বর্তমানে তা হাতের কাছেই সুলভে পাচ্ছে! কিন্তু যে কথাটা সেদিন ওরা গোপন করেছে তা হল, চিকিৎসার প্রয়োজনে যা যা দরকার তার সবটাই পূরণ করা সরকারেরই দায়িত্ব। তা ছাড়া পিপিপি মোডে ওই সব পরিষেবা চালাতে যে পরিমাণ টাকা সরকারকে খরচ করতে হয়েছে তা দিয়ে চাইলে সরকার ওই সব পরিষেবা অনায়াসেই সরকারি ভাবেই সরাসরি চালু করতে পারতো। যেখান থেকে মানুষ বিনা পয়সাতেই পরিষেবা পেতে পারতো। কিন্তু সিপিএম সরকার সে পথে গেল না। কারণ, ওদের লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া। এর বিরুদ্ধে এস ইউ সি আই (সি) ও তার বিভিন্ন সংগঠনগুলি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। এবং এই দাবিটা রাজ্যে পালাবদলের সময় জনতার দাবি হিসাবে এসে যায়।

ফলে তৃণমূল সরকার অনেক বিলম্বে হলেও ২০১৫ সালে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়– সরকারি হাসপাতালের সমস্ত পরিষেবাই হবে ফ্রি। বহু ক্ষেত্রে নিম্নমানের এবং অপ্রতুল হলেও মানুষ সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনা পয়সায় পরিষেবা আবার পেতে শুরু করে। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই এই বিনা মূল্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করে তৃণমূল সরকার।

এটা ত্বরান্বিত করতেই ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার সকলের জন্য স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের কথা ঘোষণা করে। বর্তমানে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের মাধ্যমে কেমন চলছে এই চিকিৎসা? সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেখলেই বলছে, কোনও বেড ফাঁকা নেই! ভোটের আগে যারা স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের বিনিময়ে ভর্তি হতে পেরেছিলেন তাঁদের অভিযোগ কী? ক’দিনে পাঁচ লাখ টাকা শেষ হয়েছে? মুহূর্তের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ টাকার বিল তৈরি হয়েছে, তার কতটা থার্ড পার্টি বা বিমা মেটানোর চাপে, কতকটা আবার কর্পোরেট হাসপাতালের নিজস্ব উদ্যোগে।

আর টাকা শেষ হয়ে গেলে চিকিৎসাও যাবে থেমে। এখন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোম তাদের বিপুল অঙ্কের বকেয়া বিল না পেয়ে কোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছে এবং নতুন করে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের বিনিময়ে রোগী ভর্তির প্রক্রিয়া তারা প্রায় বন্ধই করে দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকে এ নিয়ে হুঙ্কারও ছাড়তে হয়েছে।

স্বাস্থ্যসাথী নির্ভর চিকিৎসা পরিষেবার মাধ্যমে কি মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার দিন শেষ? আপাত অর্থে মানুষকে সরাসরি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না। সেই অর্থে কেউ ভাবতে পারে– বিমা কার্ড চালু হলে তার ক্ষতি কী? কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পরিষেবার বিনিময়ে সরকারকে যে মোটা অঙ্কের সাদা এবং কালো বিল মেটাতে হবে, সে টাকা কে দেয়? তা তো সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকাই। আর ট্যাক্স তো প্রতিটা মানুষই দেয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে। পূর্বেও সরকার যখন সরাসরি স্বাস্থ্য পরিষেবা দিত তখনও জনগণের ট্যাে’র টাকাতেই তো চলতো। এখন স্বাস্থ্যসাথী নামক বিমা কার্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা হলে কিছু বাড়তি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। কারণ বিমাকার্ড মানেই নানা শর্ত তাতে জোড়া থাকবে। কোনটা ওই সব শর্তে লেখা আছে, আর কোনটা নেই– তা দেখেই তো চিকিৎসা হবে। ফলে চিকিৎসা শুরু হতে যেমন বিলম্ব হবে, তেমনই নানা জটিলতার ফাঁদে চিকিৎসা বহু ক্ষেত্রে শেষও হবে না। আর বিমা নির্ভর চিকিৎসা যেহেতু নানা কোম্পানি ও থার্ড পার্টির মুনাফার লক্ষে্যই পরিচালিত হয়, সেহেতু মুনাফা বাড়াতে নানা অসাধু শর্ত পূরণ করতে চিকিৎসার খরচও বহুগুণ বাড়বে। আর এই বর্ধিত খরচ মানুষকেই মেটাতে হবে।

বিমার টাকা এখন সরকার দিলেও পরবর্তীতে বিমার এই প্রিমিয়াম মানুষকে আলাদা করে বহন করতে হবে না, সে গ্যারান্টিই বা কোথায়? সরকারি হাসপাতালে আজ যেখানে সম্পূর্ণ চিকিৎসাই ফ্রি, সেখানে সমস্ত রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ-পথ্য, বেড ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, অপারেশন চার্জ ইত্যাদি সব মিলিয়ে তৈরি হবে প্যাকেজ। যার দায়ভার জনগণকেই মেটাতে হবে। নতুন করে হেলথ ট্যাক্সও চালু হতে পারে, যার কথা তৃতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে উল্লেখ রয়েছে। ফলে বিনা পয়সায় চিকিৎসার দিন সত্যি-সত্যিই আজ শেষ হতে চলেছে। একই সাথে সরকার ও বিমা কোম্পানির অসাধু আঁতাতের ফলে ধ্বংস হতে চলেছে মেডিকেল এথিক্সও।

প্রশ্ন উঠছে – স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের শর্ত অনুসারে ৫ লক্ষ টাকা শেষ হয়ে গেলে ওই ব্যক্তির বা তার পরিবারের বাকি চিকিৎসার কী হবে? শর্ত অনুযায়ী বলা যায়, তার দায় সরকার আর নেবে না। বর্তমান অর্থমূল্যের বাজারে ৫ লক্ষ টাকার চিকিৎসা আর কতটুকু? যেখানে আসল বিলের সাথে বহুগুণে যোগ হয়ে তৈরি হয়ে যায় অসাধু বিল! পূর্বে যেখানে মানুষ সম্পূর্ণ চিকিৎসাই বিনামূল্যে পেতো এবং সেটাই ছিল তার অধিকার, এখন স্বাস্থ্যসাথী এসে সেটাকেই হটিয়ে দিল।

প্রশ্ন উঠছে– যাদের কার্ড নেই তাদের চিকিৎসা কি সরকারি হাসপাতালে হবে না? সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী তো তাই দাঁড়ায়। কার্ড না থাকলে এখন থেকে আর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে না, অর্থাৎ ইনডোর চিকিৎসা মিলবে না। যদিও বলা হচ্ছে– যার কার্ড নেই, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার কার্ড তৈরি করে দেবে। কিন্তু যারা স্বাস্থ্যসাথী কার্ড হাতে পেয়েছেন, বহু ক্ষেত্রেই তাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

প্রশ্ন আরও – অন্য রাজ্যের মানুষ কি আর এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাবে না? নির্দেশিকা অনুযায়ী তো তাই দাঁড়ায়। কার্ড না থাকলে চিকিৎসা মিলবে না। এই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড তো কেবল পশ্চিমবঙ্গবাসীরই জন্য। ফলে মেডিকেল এথিক্স যেখানে বলছে– চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনও সীমারেখা থাকে না। মানুষের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক অবস্থান, ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাত কোনও কিছুই দেখা চলে না। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বাধ্যতামূলক হলে, কী নিদারুণভাবে লঙ্ঘিত হবে মেডিকেল এথিক্স!

অনেকেই বলছেন, বিমা কোম্পানি এবং থার্ড পার্টিকে যে টাকা সরকার দিচ্ছে, সেই পরিমাণ অর্থ সরাসরি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করলে কি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরও বেশি উন্নয়ন করা যেতো না? প্রশ্নটা তো সেখানেই। সরকার কখনওই স্বাস্থ্য বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে না। ভোর কমিটি স্বাধীনতার পূর্বেই সুপারিশ করেছে, স্বাস্থ্য খাতে কমপক্ষে জিডিপি-র ১০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। আজ পর্যন্ত কেন্দ্র-রাজ্য কোনও সরকারই তা বরাদ্দ করেনি। সেই বাজেট ১.৮ শতাংশের নীচেই ঘোরাফেরা করছে। বিমা নির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু হলে তার একটা বড় অংশই বিমা কোম্পানি ও থার্ড পার্টির দেয় মেটাতেই চলে যাবে। ফলে পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে আজ সে অর্থ খরচ হয় সেখানেও টান পড়বে। আজও যতটুকু স্বাস্থ্য পরিকাঠামো রয়েছে তাও মুখ থুবড়ে পড়বে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১৬ সংখ্যা ২৬ নভেম্বর ২০২১