সিঙ্গুরে টাটাকে ফেরাতে বিজেপির সভায় সিপিএম কর্মীরা

সিঙ্গুরে শিল্প করা নিয়ে এবার বাজিমাত করতে নামছে বিজেপি৷ সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিনই হুগলি কেন্দ্রে বিজয়ী বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেন, সিঙ্গুরে তিনি টাটার ন্যানো কারখানা ফিরিয়ে আনবেন৷ তার কয়েকদিন বাদে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া মুকুল রায় বলেন, সিঙ্গুর আন্দোলনটা ভুল ছিল৷ আর এদিকে সিপিএম তো বরাবরই বলছে, সিঙ্গুর আন্দোলন রাজ্যে শিল্প সম্ভাবনাকে ধ্বংস করেছে৷ সাম্প্রতিক নির্বাচনে তৃণমূলের সংগঠনে বিপর্যয় ঘটতেই বিজেপি ও সিপিএম সিঙ্গুর আন্দোলন নিয়ে জল ঘোলা করতে নেমেছে৷ ১৪ জুন সিঙ্গুরে টাটার পরিত্যক্ত কারখানার কাছে সার্ভিস রোডে বিজেপি সাংসদ যে সভা আহ্বান করেন, সংবাদে প্রকাশ, সেখানে সিপিএম কর্মীরাও যোগ দেন৷ বস্তুত এই সিপিএম কর্মীরাই সভায় ছিলেন অতিমাত্রায় সক্রিয়৷ (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময় ১৫.০৬.’১৯)

বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় এবং নেতা মুকুল রায়ের নিশ্চয়ই অজানা নয় যে, টাটাকে অনেক বেশি সুবিধা দিয়ে গুজরাটের সানন্দে নিয়ে গিয়েছিলেন গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ সেখানে ন্যানোর অবস্থাটা কী? ন্যানো কারখানা সেখানে অনেক ধুমধাম সহ শুরু হলেও বর্তমানে লালবাতি জ্বলছে৷ সানন্দ এলাকায় ন্যানো কারখানার জন্য উচ্ছেদ হওয়া সাতটি গ্রামের বাসিন্দারা সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়ে জমি দিয়েছিলেন৷ সেই জমিতে এখন বড় বড় বহুতল৷ টাকা লুটছে প্রোমোটাররা৷ স্থানীয় বাসিন্দারা নদীর জলটুকু থেকেও বঞ্চিত৷ তাঁরা দু–এক মাসের জন্য টাটার কারখানায় সামান্য বেতনের সিকিউরিটি গার্ড কিংবা মালির কাজ পেয়েছিলেন, কিন্তু সে কাজ থেকে অচিরেই স্থানীয়দের প্রায় সকলকে ছাঁটাই করেছিল টাটা কোম্পানি৷ কেন ন্যানো বন্ধ হল? কারণ ন্যানো বিক্রির বাজার ভাল ছিল না৷ মূলত মন্দার কারণে টাটাকে উৎপাদন কমাতে কমাতে অবশেষে বন্ধ করে দিতে হল৷ সিঙ্গুরে কারখানা হলে তারও তো এই একই পরিণতি ঘটত৷ তা হলে এখন আবার সিঙ্গুরে কারখানার কথা উঠছে কেন?

বস্তুত শিল্পায়নের সামনে আজ প্রধান বাধা আর্থিক মন্দা৷ অর্থাৎ জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার অভাব৷ ভারতের জনগণের যে চার–পাঁচ শতাংশ সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে এবং বৃহৎ ব্যবসায়ী– এদের বাদ দিলে ৯০ শতাংশের বেশি জনগণ কোনওক্রমে সংসার প্রতিপালন করছেন৷ এদের কাছে গাড়ি চড়া বিলাসিতা৷ অন্ন, বস্ত্র,  শিক্ষা, চিকিৎসার বিপুল ব্যয় সামলাতেই এদের রোজগার শেষ হয়ে যায়৷ এই অবস্থায় শিল্প গড়ে উঠতে পারে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আহ্বান দিয়ে পুঁজিপতি ধরার জন্য বিশ্বের কোনও মহাদেশই তো বাদ রাখেননি সফর করতে৷ কটা শিল্পপতি এনেছেন? কী কারখানা তিনি করতে পেরেছেন? কতজনকে চাকরি দিতে পেরেছেন? শিল্প যদি সত্যিই করে থাকেন তা হলে বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি তাঁর ব্যর্থ হলকেন?

শুধু কি নরেন্দ্র মোদি? এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতি বছর নিয়ম করে শিল্প সম্মেলন করে থাকেন৷ তিনিও পুঁজি ধরতে কখনও লন্ডন, কখনও সিঙ্গাপুর গিয়েছেন৷ দেশীয় পুঁজিপতিদের দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের অনুকূল পরিবেশের কথাও শুনিয়েছেন৷ তিনি বনধ বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন, শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেছেন, ধর্মঘট করলে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন তার কথাও শুনিয়েছেন৷ বিনিয়োগে উৎসাহ জাগাতে তার সরকার ‘উৎসাহ প্যাকেজ’ও তৈরি করেছে৷ এতে কিছু ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হলেও বাস্তবে শিল্প হয়নি৷

বিজেপি শাসিত অন্যান্য রাজ্যের অবস্থাটি কী? মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে ১৫ বছর বিজেপি ক্ষমতায় ছিল৷ কী শিল্প করতে পেরেছে? যোগীর রাজ্য উত্তরপ্রদেশে নতুন কী শিল্প হয়েছে? পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ জরাগ্রস্ত৷ এই অবস্থায় সে শিল্প করতে পারে না৷ বিশিল্পায়ন, জবলেস গ্রোথ বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য৷ এ যুগে বন্ধ হয় শ্রমিক প্রধান শিল্প৷ এখানে সেখানে গড়ে ওঠে দু’চারটে প্রযুক্তি প্রধান শিল্প, যেখানে শ্রমিক লাগে খুবই সামান্য৷ গোটা বিশ্বে পুঁজিবাদী দেশে এই চিত্র৷ এই সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে শিল্পায়নের স্বপ্ণ দেখানো যেতে পারে, কিন্তু সে স্বপ্ণ বাস্তবায়িত হওয়ার নয়৷ যথার্থ কমিউনিস্টদের কাজ হল এই সত্যটাকেই শ্রমিক শ্রেণির কাছে তুলে ধরা৷ শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যুক্তির ভিত্তিতে এই বিশ্বাস এনে দেওয়া যে, শিল্পায়ন–কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের রুদ্ধ দ্বার খুলে দিতে হলে পুঁজিবাদ উচ্ছেদের বিপ্লব ছাড়া পথ নেই৷

কিন্তু সিপিএম, এর বিপরীতে গিয়ে তার কর্মী সমর্থকদের মধ্যে এই ধারণা এনে দিয়েছে যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই শিল্পায়ন–কর্মসংস্থান সম্ভব৷ এই ধারণা নিয়ে চললে কমিউনিজমের প্রতি, সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ দুর্বল না হয়ে পারে? বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক এবং পুঁজিপতিদের বিশ্বস্ত দলকে সিপিএমের কর্মী–সমর্থকরা যে সহজেই ভোট দিয়ে এ রাজ্যে ১৮টি আসনে জিততে সাহায্য করল তার অন্যতম কারণ এখানেই৷ ঠিক এই কারণে সিঙ্গুরে বিজেপির সভায় সিপিএমের কর্মী সমর্থকরা অনায়াসেই যোগ দিতে পারল৷

বাস্তবে কোনও মানুষই শিল্পায়নের বিরোধী নয়৷ কিন্তু শিল্পায়নের নাম করে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কৃষকের জমি দখল করে পুঁজিপতিদের দেওয়ার বিরুদ্ধেই ছিল জনগণের লড়াই৷ ভোটের স্বার্থে সিপিএম ২০০৬ সালে শিল্পায়নের ধুয়ো তুলে সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামে হাজার হাজার একর উর্বর জমি পুঁজিপতিকে দিতে উদ্যত হয়েছিল৷ এখন বিজেপি সেই পথ নিচ্ছে৷ জনগণ আবার সেই ভাঁওতায় ভুলবে কি?

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা)