সিংঘু বর্ডার থেকে (পাঠকের মতামত)

‘হেথায় দাঁড়ায়ে দু’বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে’– বলেছিলেন কবিগুরু। আর সেই নরদেবতাকে চাক্ষুষ করার সুযোগ হল দিল্লি বর্ডারে, কিসান আন্দোলনে। মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার ও সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম সেখানে মেডিকেল ক্যাম্প চালাচ্ছে একেবারে শুরু থেকেই।

এসডিএফ -এর তৃতীয় মেডিকেল টিম হিসেবে কলকাতা থেকে দিল্লি পৌঁছলাম ১৭ ফেব্রুয়ারি। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে আরও ৪১ কিলোমিটার সিংঘু বর্ডার, আমার গন্তব্যস্থল। আগে অনেক সহজে ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি যাওয়া যেত সেখানে। এখন ব্যারিকেড করে, রাস্তা কেটে দেওয়ায় ঘুরপথে পৌঁছাতে হচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রোতে জাহাঙ্গিরপুর, সেখানে থেকে অটোতে বর্ডারের আগে প্রথম পুলিস ব্যারিকেড, সেখান থেকে এক কিলোমিটার হেঁটে দ্বিতীয় ব্যারিকেড, তারপর কাটা অংশ পেরিয়ে আবার ই-রিক্সাতে কুণ্ডলি বর্ডার– যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলেছি।

বেশ ক্লান্তি নিয়েই ক্যাম্পে এসে পৌঁছালাম। কিন্তু পথের ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেল সকলের উষ্ণ অভ্যর্থনায়। একে একে সবার সাথে পরিচয় হল। মেডিকেল ক্যাম্পের মূল কারিগর ডাঃ অংশুমান মিত্র, এছাড়া ক্যাম্প ইনচার্জ অজিতদা, নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের ডাঃ অনীক, ফার্মাসিস্ট বন্ধু দেবু এবং প্রকাশ, সিস্টার নিধি, রাই সিংহ, মহেশ এবং তার সাথে সাথে স্থানীয় কলেজের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক পড়ূয়া। সেদিনই গিয়ে পৌঁছলেন বেলপাহাড়ির গ্রামীণ চিকিৎসক তারাপদদা। এর মধ্যে আমরা কয়েক জন বাংলার। আর বাকিরা বেশিরভাগ মধ্যপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবের। সবাই একটা টিম হিসেবে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এসেছেন দেখে ভাল লাগল।

দিল্লি হরিয়ানা হাইওয়ের উপরেই অন্তত ৬-৭ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে প্রায় লাখ খানেক কৃষক অবস্থান করছেন। সময়ে সময়ে তা আরও বাড়ে। এখন চাষ-আবাদের সময়, তাই লোক কিছু কম। দেখলাম, কিছু লোক আছেন মূল ধরনা-মঞ্চের কাছে, বিশাল তাঁবুতে। তারপর ছোট বড় অসংখ্য তাঁবু। বয়স্ক ও মহিলাদের জন্য খাট, বাকিদের জন্য নিচে ঢালাও বিছানা। একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ আছেন ট্রাকের উপর, ত্রিপল/চাঁদোয়া/কাপড় টাঙিয়ে, সেখানে ঘর বানিয়ে। পুরো এলাকা জুড়েই এ রকম কয়েক হাজার ট্রাক-ঘর। মাসের পর মাস সেখানেই অস্থায়ী সংসার। রাস্তার ধারে ধারে তৈরি হয়েছে অসংখ্য শৌচালয় বা মোবাইল টয়লেট। রাস্থার দু’পাশের ড্রেনেজ সিস্টেমটা নিজেরাই সংস্কার করে নিয়েছেন এঁরা, সেগুলো পালা করে নিয়মিতভাবে পরিষ্কারও রাখছেন।

গত তিন মাস ধরে এখানে অসংখ্য লঙ্গর চলছে। সব রকম খাওয়া পুরোপুরি ফ্রি। শুধু আন্দোলনরত কৃষকই নন, আশেপাশের গ্রামের থেকে বিভিন্ন মানুষ কাজের সূত্রে সেখানে আসা কেউ কিংবা রাস্তার ভিখারি পর্যন্ত, যেই এসে দাঁড়াক, তাদের খাইয়ে যাচ্ছেন ওঁরা। শুধুমাত্র পরিস্রুত জলের জন্যই বেশ কয়েকটা ‘আর ও’ প্ল্যান্টও ইতিমধ্যেই বসে গেছে। দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ধীরে ধীরে।

আরও নানা পরিষেবাও চলছে পাশাপাশি। বিনা পয়সায় বিলি হচ্ছে কম্বল, শীত পোশাক, টুপি, গামছা, জুতো, মোজাও। কোথাও ধোলাই কাউন্টার হয়েছে, জামা কাপড় দিয়ে গেলে এমনিতেই কেচে দিচ্ছেন তাঁরা, কোথাও কেউ ফ্রি সেলুন খুলে বসেছেন তো কোনও জায়গায় ফ্রি-তে জুতো সেলাই, পালিশ– বিস্ময়ে দেখার মতো। গাঁও থেকে যে যখন যেমন ভাবে যা পারছেন, পাঠাচ্ছেন। রোজ সকালে ট্রাক আসে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানের বিভিন্ন গ্রাম থেকে। আর তাতে করেই আসে কাঁচা সব্জি থেকে আনাজ, চাল, আটা, ডাল, দুধ। বিভিন্ন লঙ্গরের সামনে দাঁড়িয়ে জিনিস নামিয়ে দিয়ে যায় এরা।

আমাদের মেডিকেল ক্যাম্পটি মূল মঞ্চের ঠিক পিছনে। ২ ডিসেম্বর থেকে এই ক্যাম্প চালু হয়েছিল। এবং এখানে এটাই প্রথম মেডিকেল ক্যাম্প। পরবর্তীকালে আরও বেশ কয়েকটি ক্যাম্প বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে চালু হয়। এমনকি তাঁবু দিয়েই একটি দশ বেডের হাসপাতালও তৈরি হয়েছে সম্প্রতি। যাই হোক প্রথম ক্যাম্প হিসেবে আমাদের একটা আলাদা জায়গা ছিল এদের কাছে। রোজ সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত আউটডোর ভিত্তিতে রোগী দেখা হত। আর তারপর শুধুমাত্র ইমারজেন্সি। প্রথম দিকে, যখন আর কোনও ক্যাম্প ছিল না, এক একদিনে চারশোরও বেশি রোগী এসেছেন, এখন আসছেন গড়ে দেড়শো। প্রায় সব রকম ওষুধই আমরা দিতে পেরেছি রোগীদের। আমাদের ডাক্তাররা বহু জায়গায় ঘুরে ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করেছেন। স্থানীয় মেডিকেল কোম্পানিগুলোও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এমনও মানুষের সাথে আলাপ হল, যাঁর তিনতলা বাড়ি আছে, চারচাকায় যাতায়াত করেন। অথচ কি অবলীলায় এখানে এসে রাস্তা সাফ করছেন আর রাত পাহারা দিচ্ছেন। পুরো কাজটাই হয়ে চলেছে দারুণ সুশৃঙ্খল ভাবে। পাঁচ দিন ছিলাম। কোথা দিয়ে কেটে গেল দিনগুলো বুঝতেই পারলাম না। এমন আতিথেয়তায় আপন করে নিয়েছিলেন এঁরা। ফিরে আসার পরেও অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে আছে মনটা। আমি আন্দোলনের সপক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলছি না। গণতান্ত্রিক দেশে নিজেদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের অধিকার সবার আছে, সেটাই ওঁরা করছেন। যেটা দেখার মতো, শেখার মতো সেটা হল ওঁদের এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকার মানসিকতা। নিজেরা যেটা ভুল মনে করেছেন, তার বিরুদ্ধে নিজের সবটুকু দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন শান্তিপূর্ণ ভাবে। একটা আন্দোলন কী ভাবে বিভিন্ন ভাষা, ধর্মের, রাজ্যের, জাতির মানুষকে এক সুতোয় বাঁধতে পারে সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আরও আশ্চর্য, কী সুন্দর একটা পরিষেবা তথা গণবন্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন সবাই মিলে। যেখানে খাদ্য, বস্ত্র থেকে শুরু করে চিকিৎসা সব ফ্রি। যাঁদের আছে, তাঁরা দিচ্ছেন, যাঁরা পারছেন, তাঁরা তৈরি করছেন, যাঁদের দরকার তাঁরা পাচ্ছেন। পুরোটাই চলছে পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না।

সব বাধা বিপত্তি, উপেক্ষা, সমালোচনা, কুৎসা উড়িয়ে সম্প্রতি একশো রাত পার করলেন ওনারা। এরকম আরও শয়ে শয়ে রাত পার করার মত প্রস্তুতি কিন্তু ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়ে গেছে। রাজধানীর প্রবল ঠাণ্ডা তাঁদের দমাতে পারেনি। ইতিমধ্যেই দু’শোরও বেশি কৃষক শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন। তার পরেও চোয়াল কষে আসন্ন গরম, বর্ষার জন্যেও তৈরি হচ্ছেন ওঁরা। এ লড়াই যে বাঁচার লড়াই।

অর্ণব রায়, কলকাতা

(গণদাবী-৭৩ বর্ষ ২৬ সংখ্যা_১৯ মার্চ , ২০২১)