সাম্রাজ্যবাদীদের ভয়াল দাঁত-নখে ছিন্নভিন্ন প্যালেস্টাইন

 

গত তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পশ্চিম এশিয়ায় প্যালেস্টাইনের গাজায় ভয়ঙ্কর হামলা চালাচ্ছে উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েল। মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ছে গাজার মাটিতে। বিধ্বংসী বোমায় মানুষজন নিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। গাজা রক্তাক্ত বিধ্বস্ত। এ পর্যন্ত মারা গেছেন গাজার প্রায় ৮ হাজার মানুষ, যার মধ্যে তিন হাজারের বেশি শিশু। লক্ষ লক্ষ সন্ত্রস্ত মানুষ এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছেন দক্ষিণের দিকে। রেহাই মিলছে না অসুস্থদেরও। গাজার হাসপাতালে পর্যন্ত বেপরোয়া হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলের হিংস্র বাহিনী, অসহায়ের মতো মরতে হয়েছে শয়ে শয়ে রোগীকে। ইজরায়েলের যুদ্ধবিমান অ্যাম্বুলেন্স লক্ষ্য করেও বোমা ছুঁড়েছে। অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে গাজাকে। খাদ্য, জ্বালানি, পানীয় জলের অভাবে হাহাকার করছেন গাজার মানুষ। বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু হাসপাতাল।

পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র থেকে প্যালেস্টাইনকে যেন মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইজরায়েল। ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু বলেছেন, এ তো সবে শুরু– গোটা মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা আমরা বদলে দেবো। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্যালেস্টিনীয়দের প্রতি ঘৃণা উগরে দিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘ওরা পশুমানুষ– আমরা সেই মতোই আচরণ করছি।’

প্যালেস্টিনীয়দের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের কেন এই ঘৃণা? কী তাদের অপরাধ? আন্তর্জাতিক সমস্ত সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, রাষ্ট্রসংঘের ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর চুক্তি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, বিশ্ব জনমতের তোয়াক্কা না করে গোটা প্যালেস্টাইনকেই নিজেদের দখলে আনতে চূড়ান্ত বর্বরতায় বছরের পর বছর ধরে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েলের শাসকরা।প্যালেস্টাইনে শত শত বছরের বাসিন্দা লক্ষ লক্ষ আরব-মুসলমানকে জন্মভূমি থেকে উৎখাত করে উদ্বাস্তু শিবিরে বাস করতে বাধ্য করছে। এর বিরোধিতা করছেন প্যালেস্টাইনের আদি বাসিন্দা আরবরা। এই কি তাঁদের অপরাধ? আন্তর্জাতিক ভাবেও স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের অধিকার স্বীকৃত। তাহলে কোন যুক্তিতে গাজায় এই পৈশাচিক হানাদারি চালাচ্ছে ইজরায়েল?

এই বর্বরতায় ইজরায়েলকে সম্পূর্ণ মদত দিয়ে চলেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার লুঠের স্যাঙাৎ ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়ানো কয়েকটি আরব দেশ এবং গোটা বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী মানুষের আপত্তি অগ্রাহ্য করে এই অসম যুদ্ধে যুদ্ধবিমান সহ অস্ত্রশস্ত্র জোগান দেওয়ার পাশাপাশি নানা ভাবে ইজরায়েলকে মদত জোগাচ্ছে আমেরিকার পাশাপাশি ব্রিটেনও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থনের দীর্ঘ ভারতীয় ঐতিহ্য দু-পায়ে মাড়িয়ে ইজরায়েলের ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছেন।

এই সংঘর্ষের দায় কার

বছরের পর বছর ধরে ইজরায়েলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত হতে হতে গত ৭ অক্টোবর আচমকা ইজরায়েলে হামলা চালায় প্যালেস্টাইনের জঙ্গি সংগঠন হামাস। একেই অজুহাত করে নতুন করে গাজায় নির্মম আক্রমণ শুরু করে ইজরায়েল যা ভয়াবহ গণহত্যার রূপ নিয়েছে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য যাঁরা হামাসকে দায়ী করছেন, তাদের প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল সংঘর্ষের দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে একবার চোখ রাখতে হবে।

প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল সংঘর্ষের ইতিহাস

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পশ্চিম এশিয়ার প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। সেখানে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হওয়ার পর এই ভূখণ্ড মিত্রশক্তির হাতে চলে যায়। ‘প্যালেস্টাইন ম্যানডেট’-এর মাধ্যমে এর শাসনভার দেওয়া হয় ব্রিটেনকে। ক্ষমতা হাতে পেয়ে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ব্রিটেন এখানকার বাসিন্দা বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে তোলে। উগ্র ইহুদিবাদে উস্কানি দিয়ে তারা বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক ইহুদিকে প্যালেস্টাইনে প্রবেশ ও বসবাসের অধিকার দেয়। ফলে এই ভূখণ্ডে ক্রমে বাড়তে থাকে ইহুদিদের সংখ্যা। তারা এখানকার আদি অধিবাসী আরবদের উৎখাত করে একটু একটু করে প্যালেস্টাইনের দখল নিতে থাকে।

ইতিমধ্যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনী প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। এই যুদ্ধে হিটলার পরাজিত হওয়ার পর বিশ্ব জুড়ে ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতির হাওয়া ওঠে। সেই হাওয়া পালে লাগিয়ে উগ্র ইহুদিবাদীরা প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে তাদের ‘নিজস্ব বাসভূমি’র দাবি জোরালো ভাবে তুলতে থাকে। তৈরি হয় বিরোধের একটা পরিবেশ। এই সময়ে ব্রিটেন এখানকার শাসনভার রাষ্ট্রসংঘের হাতে তুলে দেয়।

রাষ্ট্রসংঘ সিদ্ধান্ত করে, প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড দু’ভাগে ভাগ করে ইহুদিদের জন্য ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, যদিও সেখানে অন্য ধর্মের মানুষেরও থাকার অধিকার থাকবে। সেই অনুযায়ী ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইজরায়েল রাষ্ট্র। শুরু থেকেই উগ্র ইহুদিবাদীরা ছলে বলে কৌশলে, এমনকি নিজস্ব সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে কাজে লাগিয়েও এই অঞ্চলে নিজেদের সংখ্যা ও আধিপত্য বাড়াতে থাকে। শত শত বছর ধরে প্যালেস্টাইনে বসবাসরত আরব-মুসলমানদের উচ্ছেদ করে গায়ের জোরে বিপুল পরিমাণ জমি নিজেদের দখলে আনতে থাকে। লক্ষ লক্ষ প্যালেস্টিনীয় নিজেদের ঘরবাড়ি, জমি-জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রতিবেশী জর্ডন, লেবানন, সিরিয়া, মিশর ইত্যাদি দেশগুলির উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আজও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেখানে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন ছিন্নমূল অসংখ্য প্যালেস্টিনীয়। এভাবেই প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল বিরোধের সূত্রপাত।

গড়ে উঠল প্রতিরোধ আন্দোলন

জন্মভূমি ফিরে পাওয়ার দাবিতে অচিরেই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে লাগলেন সেখানকার আদি বাসিন্দা প্যালেস্টিনীয়-আরবরা। গোটা আরব দুনিয়া তাদের পাশে দাঁড়াল। অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে নিজের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য তথা খনিজ তেলের বিপুল সম্পদের ওপর দখল কায়েম করার প্রয়োজনে নিজের একটি ঘাঁটি বানানোর উদ্দেশ্যে ইজরায়েলকে বেছে নিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ সহ সর্বতোভাবে সাহায্য করতে লাগল তাকে। এই অবস্থায় প্যালেস্টাইনের পক্ষ নিয়ে মিশর ও সিরিয়া বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালায় মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েলের সঙ্গে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে সিরিয়া ও মিশরে হামলা চালিয়ে জর্ডন নদীর পশ্চিম তীর, সিরিয়ার গোলান হাইট্স ও গাজা সহ মিশরের সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয় ইজরায়েল। ১৯৭৩-এর যুদ্ধে আবার মিশর পর্যুদস্ত করে ইজরায়েলকে। ১৯৭৮-এর শান্তিচুক্তিতে মিশর ফেরত পায় সিনাই উপদ্বীপ। কিন্তু জেরুজালেম সহ জর্ডনের পশ্চিম তীর ও গাজা ইজরায়েল নিজের কব্জায় রাখতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয়, ইজরায়েল ১৯৮০ সালে জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী ঘোষণা করে। যদিও বিশ্বের কোনও দেশই সেই সময় ইজরায়েলের এই অন্যায় দখলদারিকে স্বীকৃতি দেয়নি।

ইতিমধ্যে প্যালেস্টাইনের মানুষের প্রতিরোধ সংগঠন হিসাবে গড়ে উঠেছে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)। কিন্তু প্যালেস্টাইনে এমনকি তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বা বিক্ষোভ আন্দোলনগুলির উপরেও নির্মম দমন-পীড়ন চালাতে থাকে ইজরায়েলের সেনাশাসকরা। প্যালেস্টিনীয় আরবদের উপর চালাতে থাকে নির্বিচার দাদাগিরি। স্বাধীনতাকামী প্যালেস্টিনীয় আরবরাও ইজরায়েলের প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর উপর আঘাত হানার রাস্তা খোঁজে।

অসলো চুক্তি সরাসরি লংঘন করেছে ইজরায়েল

প্যালেস্টাইন ও ইজরায়েলের মধ্যে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইজরায়েলের একটি চুক্তি হয়, যেটি অসলো চুক্তি নামে পরিচিত। সেই চুক্তিতে প্যালেস্টাইনের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তথা প্যালেস্টাইনে স্বশাসিত সরকার গড়ার কথা স্বীকৃত হয়। পিএলও ইজরায়েলকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ঠিক হয়, প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর পূর্ব জেরুজালেমকে তার রাজধানী বলে মেনে নেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক ভাবেই স্বীকৃত হয় যে এবার প্যালেস্টাইন জাতি-রাষ্ট্র গড়ে উঠবে।

ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। পিএলও-র নেতৃত্বে তথাকথিত প্যালেস্টাইন অথরিটি প্রতিষ্ঠিত হলেও আজও স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠিত হতে পারেনি ইজরায়েলের অন্যায় আধিপত্যবাদী আচরণের কারণে। প্যালেস্টাইনের অঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে দখল করে রাখা পূর্ব অংশ সহ গোটা জেরুজালেমেই ইজরায়েলে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। অসলো চুক্তিকে দু পায়ে মাড়িয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করে সেখানে দেশের আইনসভা, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ইত্যাদি তৈরি করেছে ইজরায়েল। ২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও আন্তর্জাতিক মতকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী বলে মান্যতা দেন, যা প্যালেস্টাইনের মানুষ মেনে নিতে পারেননি।

প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠিত হলে উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের উদ্বাস্তু শিবির থেকে স্বভূমিতে ফেরার দাবি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে ইজরায়েল। শুধু তাই নয়, ইজরায়েল ঘোষণা করেছে, প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তাকে সার্বভৌম ক্ষমতা তারা দেবে না। প্যালেস্টাইন নিজস্ব সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে পারবে না, তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব থাকবে ইজরায়েলের হাতে। শুধু এইসব অন্যায় আব্দারই নয়, বিশ্ব জনমতকে অগ্রাহ্য করে বছরের পর বছর ধরে ইজরায়েল লাগাতার হামলা চালিয়ে চলেছে প্যালেস্তাইনের সাধারণ নাগরিকদের উপরে। এই অবস্থায় স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বিশ বাঁও জলেই থেকে যায়। প্যালেস্টাইনের সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, পণ্য ও মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে ইজরায়েলের সেনা।

প্রথম ও দ্বিতীয় ‘ইন্তিফাদা

ইজরায়েলের নিষ্ঠুর গা-জোয়ারির বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালে পিএলও-র নেতৃত্বে শুরু হয় ‘ইন্তিফাদা’ বা প্রতিরোধ আন্দোলন। এই আন্দোলনে প্যালেস্টাইনের আরব অধিবাসীরা একের পর এক গণবিক্ষোভ গড়ে তুলতে থাকে। পাশাপাশি চলতে থাকে ইজরায়েলের পুলিশ ও সেনার সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ। কিন্তু ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির পর পিএলও প্যালেস্টাইনের প্রশাসন চালানোয় মন দিলে নানা কারণে ধীরে ধীরে এই সংগঠনটির মধ্যে আপসমুখি মনোভাব দেখা দেয়। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য জানকবুল মানসিকতার বদলে নেতাদের গ্রাস করে নিতে থাকে নানা দুর্নীতি। এই অবস্থায় সেখানকার স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ২০০০ সাল নাগাদ শুরু হল দ্বিতীয় ইন্তিফাদা নামে ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলন। এবারের আন্দোলনের নেতৃত্ব পিএলও-র হাত থেকে সরে নানা জঙ্গি সংগঠনের হাতে চলে যায়। স্বাধীনতাকামী প্যালেস্টিনীয় যুবকদের বুকের রক্তে ভেসে যেতে থাকে দেশ।

বর্তমান পরিস্থিতি

 এই অবস্থায় ২০০৫ সালে হামাস ও তার সহযোগী কয়েকটি সংগঠন গাজার প্রশাসন পরিচালনার ভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। কিন্তু অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় না। ইতিমধ্যে ধনী দেশ ইজরায়েল শিল্প-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশ্বে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। তার মাথায় রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার স্যাঙাতদের আশীর্বাদের হাত। ফলে দিনে দিনে প্যালেস্টাইনকে সে কোণঠাসা করে ফেলতে থাকে। লাগাতার চালাতে থাকে নির্বিচার রক্তক্ষয়ী হামলা। শিশু-নারী সহ সাধারণ প্যালেস্টিনীয়দের প্রাণহানি প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে ওঠে। এমনকি প্যালেস্টিনীয় উদ্বাস্তু শিবিরও ইজরায়েলের সেই নির্মম হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ তুড়ি মেরে উড়িয়ে তারা বলতে শুরু করে, একটাই রাষ্ট্র থাকবে যার নাম ইজরায়েল। প্যালেস্টাইন নামে কোনও রাষ্টে্রর অস্তিত্বই রাখবে না তারা। ইহুদিরা বাস করবে প্যালেস্টাইনের সর্বত্র। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে সংখ্যালঘু আরব বাসিন্দারা তাদের সেবা করবে। কোনও রকম রাজনৈতিক অস্তিত্বই থাকবে না প্যালেস্টিনীয় আরবদের। বাস্তবিকই, প্যালেস্টাইনের মানচিত্রের সালওয়াড়ি বিবর্তন লক্ষ করলেই দেখা যাবে, ইজরায়েল ধীরে ধীরে নিজের দখলদারি এমন ভাবে বিস্তার করেছে যে, কার্যত প্রায় গোটা প্যালেস্টাইনই আজ তার কব্জায়।

এই পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত বিপন্ন প্যালেস্টিনীয়দের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হামাস গত ৭ অক্টোবর আচমকা হামলা চালায় ইজরায়েলের উপর। এই আক্রমণকে দীর্ঘদিন ধরে অবমানিত, অত্যাচারিত, নিজস্ব বাসভূমি থেকে অন্যায়ভাবে বিতাড়িত স্বাধীনতাকামী প্যালেস্টিনীয়দের বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া হিসাবে বুঝতে হবে। একেই অজুহাত করে আত্মরক্ষার নামে তার প্রতিশোধ নিতে ইজরায়েল যা করছে, তাকে নৃশংস গণহত্যা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। নৃশংস আক্রমণ ও গাজাকে সবদিক দিয়ে অবরুদ্ধ করার পাশাপাশি ইজরায়েল সেখানকার আন্তর্জাল সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ায় গাজার বর্তমান পরিস্থিতি কতখানি ভয়ঙ্কর, সেই খবরটুকুও ঠিক মতো বাইরে আসতে পারছে না। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্যালেস্টাইনের অসহায় সাধারণ মানুষের জীবনকে জীবন্ত নরকে পরিণত করেছে এই উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র।

সাম্রাজ্যবাদীদের ভূমিকা

আগেই বলা হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী লুঠের স্বার্থে পশ্চিম এশিয়ায় নিজের এজেন্ট হিসাবে প্রথম থেকেই ইজরায়েল রাষ্ট্রকে সব রকম ভাবে মদত দিয়ে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবারের সংঘাতেও যুদ্ধজাহাজের বহর সহ অস্ত্রশস্তে্রর সম্ভার নিয়ে ইজরায়েলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তারা। এই সংঘর্ষে তার লাভ দু’দিক দিয়ে। একদিকে ইজরায়েলের মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়ায় নিজের আধিপত্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা, অন্যদিকে অস্ত্র বেচে মন্দায় তলিয়ে যেতে থাকা অর্থনীতির হাল খানিকটা হলেও ফেরানোর সুযোগ তৈরি হওয়া। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্যাঙাৎ ইউরোপের অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও রক্তক্ষয়ী এই ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ বন্ধ করতে বিন্দুমাত্র সচেষ্ট নয়। ব্রিটেন তার নৌবহর নিয়ে ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে।

একই ভাবে, প্যালেস্টাইনের পক্ষে দাঁড়াবার বদলে, গোটা দেশের জনমতকে অগ্রাহ্য করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিজেপির নরেন্দ্র মোদিও এই অসম সংঘর্ষে সরাসরি ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এতে মার্কিন-কর্তাদের সন্তুষ্ট করার পাশাপাশি দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের লুটের স্বার্থটিকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা চালালেন তিনি। প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার লড়াইয়ের পাশে থাকার ভারতের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে দেশের শাসক শ্রেণি এখন ধনী সাম্রাজ্যবাদী দেশ ইজরায়েলের সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে উদগ্রীব। শাসক একচেটিয়া পুঁজিপতিদের প্রতিনিধি হয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথম ইজরায়েল সফর করেছেন নরেন্দ্র মোদি।

অস্ত্র কেনাবেচায় ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের এখন বিপুল টাকার লেনদেন চলে। সম্প্রতি ইজরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ হাইফা বন্দর কিনে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ একচেটিয়া পুঁজিপতি আদানি সাহেব। ফলে উগ্র ইহুদিবাদী ফ্যাসিস্ট ইজরায়েলের সমর্থনে এখন সোচ্চার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এই নির্লজ্জতা এতটাই সীমা ছাড়িয়েছে যে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় আনা শান্তিচুক্তি তথা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদানে পর্যন্ত বিরত থেকেছে ভারত।

ইজরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার গোটা বিশ্ব

সাম্রাজ্যবাদী লুঠের স্বার্থে ইজরায়েল ও তার সাম্রাজ্যবাদী দোস্তদের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে গোটা দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় যুদ্ধবিরোধী সাধারণ মানুষ। প্যালেস্টাইনের প্রতিবেশী আরব দেশগুলিতেই শুধু নয়, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি সহ ইউরোপের প্রতিটি দেশে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনকি খোদ ইজরায়েলেও উগ্র ইহুদিবাদীদের এই নির্মম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন খেটে-খাওয়া মানুষ।

মিছিলে মিছিলে স্লোগান উঠছে– ‘ফ্যাসিস্ট ইজরায়েল প্যালেস্টাইন থেকে হাত ওঠাও’। ভারতের সাধারণ মানুষও সামিল হয়েছে এই প্রতিবাদে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতিতে এই একমেরু বিশ্বে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যান্য হামলাগুলির মতোই প্যালেস্টাইনের উপর ইজরায়েলের এই হানাদারি গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশে দেশে শক্তিশালী যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছে।