কমরেড মানিক মুখার্জীর প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রদ্ধার্ঘ্য

 

কেন্দ্রীয় অফিসে কমরেড মানিক মুখার্জীর মরদেহে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। উপস্থিত প্রবীণ পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)-এর পলিটবুরোর প্রবীণ সদস্য, আমৃত্যু বিপ্লবী কমরেড মানিক মুখার্জীর মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় কমিটি গভীর শোক প্রকাশ করছে।

সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের সহযোদ্ধা ও আমাদের দলের পূর্বতন সাধারণ সম্পাদক কমরেড নীহার মুখার্জীর মাধ্যমে কমরেড মানিক মুখার্জী দলের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪০-এর দশকে কমরেড নীহার মুখার্জীর যৌথ পরিবার ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে আসে। কমরেড মানিক মুখার্জীও তাঁদের সাথে কলকাতায় চলে আসেন।

কমরেড মানিক মুখার্জী তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দলের বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কমসোমল গড়ে ওঠার সময় কমরেড মানিক মুখার্জীকে তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি দক্ষতার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। কিছুদিন পর ছাত্রদের মধ্যে বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গড়ে তোলা এস ইউ সি-এসবি (স্টুডেন্টস বুরো)-তে কাজ শুরু করেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি দু’বার টিবি এবং জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ায় দীর্ঘদিন দলের কাজের সাথে যুক্ত থাকতে পারেননি।

১৯৬৩ সালে কমরেড শিবদাস ঘোষ বুদ্ধিজীবীদের যুক্ত করে দলের আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য কমরেড মানিক মুখার্জীকে দায়িত্ব দেন। শুরুতে তিনি দুজন কমরেডকে সঙ্গে নিয়ে ‘পথিকৃৎ’ নামে বাংলায় একটি সাংস্কৃতিক দ্বিমাসিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। পরে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর একটি নাটকের গ্রুপ ও সঙ্গীত গোষ্ঠী তৈরি করে পথিকৃৎ সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে তোলা হয়। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা ও পথনির্দেশকে ভিত্তি করে শিল্প-সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে তিনি গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে বাড়তে থাকা কিছু পশ্চাদগামী ভাবধারা, যেগুলি প্রগতিশীলতার মোড়কে উপস্থিত করা হচ্ছিল, সেগুলির অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি শীঘ্রই সংস্কৃতি জগতে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

কমরেড মানিক মুখার্জীর শেষযাত্রা

১৯৭৫-৭৬ সালে এস ইউ সি আই (সি) মহান সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে শিল্প-সাহিত্য জগতের বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তিদের যুক্ত করে একটি পাবলিক কমিটি গঠনের জন্য কমরেড মানিক মুখার্জীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সাফল্যের সাথে সেই কমিটি গড়ে তোলেন এবং সর্বসম্মতিতে সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ পথিকৃৎ আয়োজিত শরৎ জন্মবার্ষিকীর বিভিন্ন সভায় বক্তব্য রাখেন। সেই ভাষণগুলির গুরুত্বপূর্ণ অংশ সংকলিত করে ‘শরৎ মূল্যায়ন প্রসঙ্গে’ নামে একটি পুস্তিকা শরৎ জন্মশতবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে এই কমিটির তত্ত্বাবধানে ‘গোল্ডেন বুক অফ শরৎচন্দ্র’ নামে বহুভাষিক একটি অমূল্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির প্রধান সম্পাদক হিসাবে কমরেড মানিক মুখার্জী অত্যন্ত দক্ষ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে কমরেড মানিক মুখার্জী হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার অগ্রগণ্য সাহিত্যিকদের যুক্ত করে ‘অল ইন্ডিয়া শরৎ সেন্টিনারি কমিটি’ গড়ে তোলেন। কমরেড মানিক মুখার্জী ‘প্রেমচন্দ শতবার্ষিকী কমিটির’-ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুশতবর্ষে কমরেড মানিক মুখার্জীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘গোল্ডেন বুক অফ বিদ্যাসাগর’।

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮০-র দশকের শুরুতে সিপিএম পরিচালিত রাজ্য সরকার শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি ও পাশফেল প্রথা তুলে দেয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধিকার হরণ করে। এ রাজ্যের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সমাজের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ভাষাশিক্ষা আন্দোলন গড়ে ওঠে। ‘শিক্ষা সংকোচন বিরোধী ও স্বাধিকার রক্ষা কমিটি’ নামে একটি গণকমিটি গড়ে ওঠে যার মুখ্য সংগঠক ছিলেন কমরেড মানিক মুখার্জী। এই কমিটির নেতৃত্বে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে আন্দোলন চলে এবং সিপিএম সরকার প্রাথমিকে ইংরেজি পুনরায় চালু করতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলির শিক্ষাস্বার্থবিরোধী নীতির প্রতিবাদে গড়ে ওঠে অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি।

স্মরণসভার সঞ্চে প্রয়াত কমরেডের প্রতি বিপ্লবী শ্রদ্ধা কমরেড প্রভাস ঘোষ সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের।

১৯৯০ সালে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দুঃখজনক পতনের পর কমরেড নীহার মুখার্জীর পরিচালনায় দল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টদের যুক্ত করে যুদ্ধবিরোধী জঙ্গি শান্তি আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কমরেড মানিক মুখাজীকে সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই প্রচেষ্টার ফল হিসাবে ১৯৯৫ সালে কলকাতায় একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, জাইরে, তুরস্ক, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল সহ বহু দেশের এবং ভারতের নানা রাজ্যের প্রতিনিধিরা সেই কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেন। এরপরে ১৯৯৭, ২০০৩, ২০০৫, ২০০৭ সালে আরও চারটিআন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কনভেনশন থেকে আমেরিকার প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল ব়্যামসে ক্লার্ককে সভাপতি ও কমরেড মানিক মুখার্জীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-ইম্পিরিয়ালিস্ট কোঅর্ডিনেটিং কমিটি গঠিত হয়। কমরেড মানিক মুখার্জী অত্যন্ত সাফল্যের সাথে দল এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তাধারাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যান। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা আন্তর্জাতিক সেমিনার এবং সভায় কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে মূল্যবান বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। বিশ্বের যে দেশেই তিনি গেছেন, সর্বত্রই তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা এবং পাণ্ডিত্যের দ্বারা সে দেশের বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষের উপর ছাপ ফেলেছেন।

১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের প্রথম পার্টি কংগ্রেসে কমরেড মানিক মুখার্জী স্টাফ মেম্বারশিপ লাভ করেন এবং দলের কলকাতা জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার আগেই তিনি দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দলের বাংলা মুখপত্র গণদাবীর সম্পাদকও ছিলেন।

কমরেড মুখার্জী ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি, পলিটবুরো ও সেন্ট্রাল এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে দলের তৃতীয় কংগ্রেসে তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটবুরোর সদস্য হিসাবে পুননির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি তাঁর এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

কমরেড মানিক মুখার্জী ছিলেন খুবই স্নেহপ্রবণ। শোষিত নিপীড়িত মানুষের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালবাসা। যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরাই গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার নিরন্তর চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে অত্যন্ত উচ্চমানের এক বিপ্লবী নেতা হিসাবে গড়ে তুলতে এবং পার্টির সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের হৃদয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।

স্মরণসভার একাংশ

দলের কেন্দ্রীয় কমিটি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে, কমরেড মানিক মুখার্জী তীব্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী চরিত্র অর্জন করেছিলেন, দল ও শোষিত জনগণের স্বার্থে তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন, এমনকি পার্কিনসন রোগ যখন তাঁর চলাফেরার গতি ক্রমশ রুদ্ধ করেছে, তখনও তাঁর চিন্তার শক্তিকে খর্ব করতে পারেনি। তাঁর মৃত্যু দেশের শোষিত জনগণের কাছে গভীর ক্ষতি। তাঁর এই বিপ্লবী সংগ্রাম এবং কর্মনিষ্ঠা দেশের মুক্তিসংগ্রামে নিয়োজিত সকল মানুষের কাছেই প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

কমরেড মানিক মুখাজী লাল সেলাম