রাষ্ট্র ও বিপ্লব(২)– লেনিন

 

এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে গণদাবীতে তাঁর বিভিন্ন রচনার অংশ আমরা প্রকাশ করছি। এবার ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এর অংশবিশেষ।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

(২)

সশস্ত্র লোকের বিশেষ বাহিনী, কারাগার ইত্যাদি

এঙ্গেলস বলেছেন, ‘… পুরাতন গোষ্ঠী (উপজাতীয় বা ক্ল্যান) সংগঠন থেকে রাষ্ট্রের প্রথম পার্থক্য এই যে রাষ্ট্র তার প্রজাদের অঞ্চলের ভিত্তিতে ভাগ করে …’।

আমাদের কাছে এই রকম বিভাগটা ‘স্বাভাবিক’ লাগে, কিন্তু তার জন্য পুরনোগোষ্ঠী বা উপজাতীয় সামাজিক সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পরই এই ধরনের বিভাগ সম্ভব হয়েছিল।

‘… এর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল একটি রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতিষ্ঠা, যা সশস্ত্র শক্তি হিসাবে স্বয়ং-সংগঠিত জনসাধারণের সঙ্গে আর একাত্ম নয়। সমাজ শ্রেণিবিভক্ত হওয়ার সময় থেকে জনসাধারণের স্বয়ংক্রিয়সশস্ত্র সংগঠন অসম্ভব হয়ে পডে, ফলে এই বিশেষ রাষ্ট্রীয় শক্তির দরকার হয়। … প্রতিটি রাষ্টে্রই এই সশস্ত্র শক্তিটা বর্তমান। এই রাষ্ট্রীয় শক্তিটা শুধু সশস্ত্র বাহিনী দিয়েই নয়, কারাগার এবং সমস্ত রকম দমনমূলক প্রতিষ্ঠান সহ আরও নানা প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে ওঠে, যা গোষ্ঠীভিত্তিক (ক্ল্যান) সমাজব্যবস্থায় ছিল অজ্ঞাত…’।

এঙ্গেলস প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন রাষ্ট্র নামে অভিহিত সেই ‘শক্তি’র ধারণাটাকে, যাসমাজ থেকে উদ্ভূত হয়েও সমাজের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপিত করে এবং ক্রমাগত সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে। এই শক্তিটা প্রধানত কী দিয়ে তৈরি? এই শক্তি গঠিত হয় সশস্ত্র লোকের বিশেষ বাহিনী দ্বারা, যাদের হাতে আছে কারাগার ইত্যাদি।

সশস্ত্র লোকেদের বিশেষ বাহিনীকে আলাদা বলার অধিকার আমাদের আছে, কারণ এই দমনমূলক শক্তিটা সমস্ত রাষ্ট্রেরই বৈশিষ্ট্য যা সশস্ত্র জনগণ, তাদের ‘স্বয়ংক্রিয় সশস্ত্র সংগঠনের’ সঙ্গে একেবারেই মেলে না।

সমস্ত মহান বিপ্লবী চিন্তানায়কের মতো এঙ্গেলস শ্রেণি সচেতন শ্রমিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছেন ঠিক সেই দমনমূলক বিষয়টার দিকে, যেটা স্তরে স্তরে জমাটবাঁধা সংস্কারের কল্যাণে পূত-পবিত্র মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ বর্তমান পণ্ডিতমূর্খেরা এটাকে মনোযোগ দেওয়ার যোগ্য বলেই মনে করে না, তাদের কাছে এটা নিতান্ত মামুলি একটা বিষয়। স্থায়ী সৈন্যদল আর পুলিশই হল রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান হাতিয়ার। এছাড়া অন্য রকম হতে পারে কি?

উনিশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপের বেশির ভাগ লোক যারা একটাও বৃহৎ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যায়নি বা কাছ থেকে বিপ্লবকে দেখেনি, তাদের উদ্দেশে এঙ্গেলস এ কথা লিখেছিলেন যে, এদের অধিকাংশের দৃষ্টিকোণ এমন না হয়ে পারে না। ‘জনসাধারণের স্বয়ংক্রিয় সশস্ত্র সংগঠন’ বলতে কী বোঝায়, তা তারা বুঝতেই পারে না। সমাজের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত, ক্রমাগত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকা সশস্ত্র লোকেদের বিশেষ বাহিনীর (পুলিশ, স্থায়ী সৈন্যদল) প্রয়োজন হল কেন, এ প্রশ্নের জবাবে পশ্চিম ইউরোপীয় ও রুশ কূপমণ্ডুকেরা স্পেনসার কিংবা মিখাইলভস্কির কাছ থেকে ধার করা দুটো বুলি আউড়ে, সমাজজীবনের জটিলতা বৃদ্ধি, পেশাগত বিভিন্নতা বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা যুক্তি দিতে থাকে।

এই নজিরগুলোকে ‘বিজ্ঞানসম্মত’ মনে হতে পারে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল যে বিষয়টি– অর্থাৎ সমাজ এমন পরস্পরবিরুদ্ধ শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে যে তাদের মধ্যে আপস-মীমাংসা অসম্ভব, এই সত্যটি চাপা দিয়ে সাধারণ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা সহজ হয়।

সমাজের এই শ্রেণি বিভাজন না ঘটলে, ‘জনগণের স্বয়ংক্রিয় সশস্ত্র সংগঠন’ থাকা সম্ভব হত। তা অবশ্যই লাঠিধারী আদি বানর পাল, অথবা আদিম মানুষ, অথবা গোষ্ঠীগত (ক্ল্যান) সমাজে মানুষের সংগঠন অপেক্ষা অস্ত্রশস্তে্রর উন্নত প্রযুক্তির দিক থেকে অন্য রকম হত, কিন্তু এই সংগঠনটা গড়ে ওঠা সম্ভব হত।

কিন্তু তা সম্ভব হল না, কারণ সভ্য সমাজ পরস্পরবিরোধী শ্রেণিতে, আরও বড় বিষয় হল, আপস-মীমাংসা অসম্ভব, এমন দুই শত্রু-শ্রেণিতে বিভক্ত। তাদের ‘স্বয়ংক্রিয়’ সশস্ত্রকরণের পরিণাম হত, এই শ্রেণিগুলির মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম। সে জন্য দেখা দিল রাষ্ট্র, গড়ে উঠল আলাদা একটা শক্তি, একটা বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী। প্রতিটি বিপ্লব রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ করে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয় শ্রেণি সংগ্রামের বাস্তবতাকে। দেখায়, কী ভাবে শাসক শ্রেণি তাদের সেবকবিশেষ সশস্ত্র বাহিনীগুলিকে নতুন করে গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। একই সাথে দেখায়, কী ভাবে নিপীড়িত শ্রেণিও গড়ে তোলার চেষ্টা চালায় সেই ধরনের নতুন সংগঠন, যা শোষকদের পরিবর্তে শোষিতদের স্বার্থ রক্ষা করছে।

সশস্ত্র লোকের ‘বিশেষ’ বাহিনী এবং ‘জনসাধারণের স্বয়ংক্রিয় সশস্ত্র সংগঠন’– এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক কী সে প্রশ্ন প্রত্যেক বড় বড় বিপ্লবের সময়েই দেখা দেয়, দেখা দেয় ব্যবহারিকভাবে, সুস্পষ্টরূপে ও বিস্তৃত কর্মক্ষেত্রে। উপরের আলোচনায় এঙ্গেলস তত্তে্বর দিক থেকে সেই প্রশ্নই তুলেছেন। ইউরোপীয় ও রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতার মধ্যে এর মূর্ত নিদর্শন কী ভাবে ফুটে উঠেছে, আমরা তা দেখতে পাব।

এখন ফেরা যাক এঙ্গেলসের বক্তব্যে।

তিনি দেখিয়েছেন, কখনও কখনও, যেমন উত্তর আমেরিকার কোথাও কোথাও এই রাষ্ট্রশক্তিটি দুর্বল (পুঁজিবাদী সমাজের পক্ষে বিরল একটি ব্যতিক্রমের কথা এঙ্গেলসের মনে হয়েছে এবং তিনি সাম্রাজ্যবাদের আগের যুগের উত্তর আমেরিকায় এমন অনেক জায়গার কথা বলেছেন যেখানে স্বাধীন ঔপনিবেশিকদেরই প্রাধান্য ছিল)। কিন্তু সাধারণভাবে বললে, তা অধিকতর শক্তিশালী হয়ঃ

‘… রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শ্রেণি-বিরোধ যে পরিমাণে তীব্র হয় এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি আয়তনে এবং জনসংখ্যায় যত বাড়তে থাকে রাষ্টে্রর শক্তিও সেই অনুপাতে বাড়তে থাকে। শুধু বর্তমান ইউরোপের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, শ্রেণি-সংগ্রাম ও রাজ্য জয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে এমন উচ্চতায় বাড়িয়ে তুলেছে যে, তা গোটা সমাজ, এমনকি খোদ রাষ্ট্রটাকে পর্যন্ত গিলে ফেলতে পারে এমন বিপদ হিসাবে দেখা দিয়েছে…।’

এটা লেখা হয়েছিল গত শতকের ৯০-এর দশক শুরুর মধ্যেই। এঙ্গেলসের শেষ ভূমিকার তারিখ ১৬ জুন ১৮৯১। রাষ্টে্রর সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন বলতে বোঝায়, ব্যবসায়ী সংঘের (ট্রাস্ট) পূর্ণ আধিপত্য, বড় বড় ব্যাঙ্কের সর্বব্যাপক দাপট, বিপুল পরিসরে ঔপনিবেশিক কর্মনীতি ইত্যাদি– যেগুলি সবেমাত্র শুরু হয়েছে ফ্রান্সে। উত্তর আমেরিকা ও জার্মানিতে তা তখন আরও দুর্বল। তারপর থেকে ‘দেশ জয়ের প্রতিযোগিতা’ বিপুল আকারে বেড়েছে। বিশেষ করে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ায় দেখা গেল এই সব ‘প্রতিদ্বন্দ্বী দখলদারদের’ মধ্যে, অর্থাৎ বড় বড় আগ্রাসী শক্তিদের মধ্যে পৃথিবীটা পুরোপুরি বন্টিত হয়ে গেছে। তারপর সামরিক ও নৌবাহিনীর অস্ত্রসজ্জা বেড়ে উঠেছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়। দুনিয়ার ওপর কে প্রভুত্ব করবে– ব্র্রিটেন না জার্মানি, তা নিয়ে এবং লুঠের বাঁটোয়ারা নিয়ে ১৯১৪-১৯১৭ সালের যুদ্ধে চরম লোভী ও হিংস্র রাষ্ট্রশক্তি গিলে খেয়েছে সমাজের সমস্ত শক্তিকে। যা সমাজকে নিয়ে গেছে পরিপূর্ণ বিপর্যয়ের কাছাকাছি।

১৮৯১ সালেই বৃহৎ শক্তিগুলির বিদেশনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে এঙ্গেলস ‘রাজ্যজয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার’ উল্লেখ করেছিলেন। আর ১৯১৪-১৯১৭ সালে যখন ঠিক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাটাই বহুগুণ তীব্র হয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের জন্ম দিল, সমাজতন্তে্রর ভেকধারী উগ্র জাতীয়তাবাদী (সোস্যাল শোভিনিস্ট) শয়তানরা তখন ‘পিতৃভূমি রক্ষা’, ‘প্রজাতন্ত্র ও বিপ্লব রক্ষা’ ইত্যাদি বুলি আউড়ে ‘নিজ নিজ’ দেশের বুর্জোয়াদের লুঠেরা স্বার্থকে আড়াল করতে থাকল!

(৩)

রাষ্ট্র হল নিপীড়িত শ্রেণিকে শোষণের হাতিয়ার

সমাজের ঊর্ধ্বে অবস্থিত এই বিশেষ নিপীড়ন যন্ত্রের ভরণপোষণের জন্য দরকার কর আদায় ও রাষ্ট্রীয় ঋণ।

এঙ্গেলস লিখেছেন, ‘… রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর আদায়ের অধিকার থাকায় সরকারি অফিসারেরা সমাজের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে সমাজেরই অঙ্গ হিসাবে কাজ করে। গোষ্ঠীভিত্তিক (ক্ল্যান) সমাজের কার্যকর্তারা যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা পেত, তা অর্জন করতে পারা যদি বা বর্তমান শাসকদের পক্ষে সম্ভব হত, সেটাও আর তাদের কাছে যথেষ্ট হত না।’ … ‘রাজপুরুষরা পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়, এই মর্মে বিশেষ আইন তৈরি করা হয়েছে। ‘সবচেয়ে নগণ্য পুলিশ কর্মচারীটি’-ও গোষ্ঠী সমাজের প্রতিনিধিদের চেয়ে বেশি ‘ক্ষমতাশালী’, কিন্তু গোষ্ঠীপতিরা সমাজের কাছ থেকে যে ‘অবারিত শ্রদ্ধা’ পেত তা সভ্য রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কেরও ঈর্ষার বস্তু।

রাষ্ট্রশক্তির যন্ত্র হিসেবে রাজপুরুষদের বিশেষ সুবিধা ও অধিকার ভোগের কথা এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে। মূল কথাটা বলা হয়েছে এই ভাবে যে, যার জোরে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা সমাজের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে, তা কী? ১৮৭১-এ প্যারিস কমিউন কী ভাবে হাতে কলমে এই তাত্ত্বিক প্রশ্নটার সমাধান করেছিল এবং ১৯১২-তে কাউটস্কি কী ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান থেকে প্রশ্নটাকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন, সেটা আমরা দেখব।

‘যেহেতু শ্রেণি বিরোধকে সংযত রাখার প্রয়োজন থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব, কিন্তু আবার যেহেতু শ্রেণি-সংঘাত থেকেই এর উৎপত্তি, তাই রাষ্ট্র সর্বদাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে পরাক্রান্ত, অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভুত্বকারী শ্রেণির রাষ্ট্র। আবার রাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে এই শ্রেণিই রাজনৈতিকভাবেও প্রভুত্বকারী শ্রেণি হয়ে ওঠে এবং এই ভাবেই তারা নিপীড়িত শ্রেণিকে দমন ও শোষণের নতুন নতুন উপায় হস্তগত করে…’। প্রাচীন ও সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ছিল ক্রীতদাস ও ভূমিদাসদের শোষণের যন্ত্র। একই ভাবে ‘আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র’ও হল পুঁজি কর্তৃক মজুরি-শ্রম শোষণের হাতিয়ার। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে কখনও কখনও এমন পর্ব দেখা যায় যখন দ্বন্দ্বে লিপ্ত শ্রেণিগুলির শক্তি এমন একটা ভারসাম্যে পৌঁছয় যখন রাষ্ট্রশক্তি সাময়িকভাবে আপাত মধ্যস্থতা রক্ষার কাজ করে, যাতে উভয়ের সম্পর্কেই রাষ্ট্র খানিকটা পরিমাণ স্বাধীন ভূমিকা নেয়…’। সতেরো ও আঠারো শতকের নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, ফ্রান্সে প্রথম ও দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের বোনাপার্টতন্ত্র, জার্মানিতে বিসমার্কের সময়টাতে ঠিক যেমন ছিল।

এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি, বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতকে দমন শুরু করার পর এই রকমই হয়েছিল প্রজাতান্ত্রিক রাশিয়ায় কেরেনস্কি সরকারের পরিস্থিতি। এটা এমন এক মুহূর্ত যখন পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের নেতৃত্বের কল্যাণে সোভিয়েতগুলি হয়ে পড়েছে শক্তিহীন, অথচ সোজাসুজি তাদের উৎখাত করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা বুর্জোয়াদের তখনও নেই ।

এঙ্গেলস লিখেছেন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে ‘ধন সম্পদের শক্তি পরোক্ষে, কিন্তু নিশ্চিত কার্যকরীরূপে ক্ষমতা প্রয়োগ করে’, প্রথমত, ‘রাজপুরুষদের সোজাসুজি কিনে নিয়ে’ (যেমন আমেরিকাতে), দ্বিতীয়ত, ‘শেয়ার বাজারের সঙ্গে সরকারের জোট’ মারফত (যেমন ফ্রান্স ও আমেরিকাতে)।

বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্যবাদ ও ব্যাঙ্কের আধিপত্যের ফলে সব ধরনের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রেই ধন-সম্পদের সর্বময় শক্তিকে রক্ষা ও কার্যকরী করার উপরোক্ত দুটিপথ অসাধারণ কৌশলে ‘বিকশিত’ হয়েছে। যেমন, রাশিয়ায় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে, যাকে বলা যেতে পারে কোয়ালিশন সরকারে বুর্জোয়াদের সঙ্গে ‘সমাজতন্ত্রী’ সোস্যালিস্ট রেভলিউশনারি ও মেনশেভিকদের পরিণয় বন্ধনের মধুমাস, সেই সময়েই পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণ করা ও তাদের দস্যুবৃত্তি ও মিলিটারি কনট্রাক্ট মারফত রাজকোষ লুণ্ঠনে বাধা দেওয়ার জন্য সম্মিলিত মন্ত্রিসভা যে-সব প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, শ্রী পালচিনস্কি সেই-সব প্রস্তাবের প্রত্যেকটিরই বিরোধিতা করেন। তারপর মন্ত্রিপরিষদ থেকে বিদায় নেবার পর তিনি (অবশ্যই একই রকম আর এক পালচিনস্কির জন্য স্থান ছেড়ে দিয়ে) পুঁজিপতিদের কাছ থেকে বছরে ১ লক্ষ ২০ হাজার রুবল বেতনের চাকরির ‘পুরস্কার’ পেলেন– এটাকে কী বলা যাবে? এটা কি সোজাসুজি ঘুষ, নাকি পরোক্ষ ঘুষ? সরকারের সঙ্গে সিন্ডিকেটদের জোট, নাকি ‘শুধুই’ বন্ধুত্ব? কী ভূমিকা নিচ্ছেন চের্নোভ, সেরেতেলি, আভক্সেন্তিয়েভ এবং স্কবেলেভরা? কোটিপতি রাজকোষ-লুঠেরাদের সঙ্গে তাদের যোগ ‘প্রত্যক্ষ’, নাকি তাঁরা কেবল ‘পরোক্ষ’ সহযোগী?

গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে ‘সম্পদের’ সর্বময় ক্ষমতা এই কারণে নিশ্চিত যে, রাজনৈতিক কাঠামোর কোনও ত্রুটি বা পুঁজিবাদের রাজনৈতিক খোলসটা কত নিকৃষ্ট তার ওপর এই ক্ষমতা নির্ভর করে না। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হল পুঁজিবাদের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট খোলস। তাই ক্ষমতা কায়েম করতে পুঁজি (পালচিনস্কি, চের্নোভ, সেরেতেলি কোং-দের মতো লোকেদের মারফত) এই সর্বোৎকৃষ্ট খোলসটাকে দখল করেছে। এই দখল এতটাই পাকা, এতটাই সুনিশ্চিত যে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্তে্র ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা পার্টি, এ-সব কোনও কিছুর বদলের দ্বারাই সে ক্ষমতা নড়ানো যায় না।

আরও বলা দরকার যে, এঙ্গেলস সুনির্দিষ্টভাবে সর্বজনীন ভোটাধিকারকেও বলেছেন বুর্জোয়া প্রভুত্বের হাতিয়ার। স্পষ্টতই জার্মান সোসাল ডেমোক্রেসির দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা মনে রেখে তিনি বলেছেন, সর্বজনীন ভোটাধিকার হল– ‘‘শ্রমিক শ্রেণি কতটা পরিণত হয়েছে তার সূচক। আধুনিক রাষ্টে্র সর্বজনীন ভোটাধিকার এ ছাড়া আর বেশি কিছু হতে পারে না, কখনও হবেও না।’’

আমাদের সোসালিস্ট রেভলিউশানারি ও মেনশেভিকদের মতো পেটি- বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা এবং তাদের যমজ ভাই পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত সোস্যাল শোভিনিস্ট ও সুবিধাবাদীরা সর্বজনীন ভোটাধিকার থেকে ঠিক ওই ‘বেশি কিছুটার’ই আশা করে। ‘বর্তমান রাষ্ট্রে’ সর্বজনীন ভোটাধিকার বুঝি-বা সত্যিই অধিকাংশ মেহনতি জনগণের ইচ্ছা প্রকাশ করতে ও তাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে সক্ষম, এই অলীক ধারণাটা তারা নিজেরা পোষণ করে ও জনগণের মনে ঢোকায়।

এখানে আমরা সেই ভ্রান্ত ধারণাটার উল্লেখটুকু করছি যে, এঙ্গেলসের অত্যন্ত সুস্পষ্ট, যথাযথ ও সুনির্দিষ্ট উক্তিকে ‘সরকারি’ (অর্থাৎ সুবিধাবাদী) সমাজতন্ত্রী পার্টিগুলির প্রচার ও আন্দোলনে প্রতিপদেই বিকৃত করা হচ্ছে। এঙ্গেলস যে ধারণাটাকে ঝেঁটিয়ে দূর করেছেন, তার বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘বর্তমান’ রাষ্ট্র প্রসঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের বক্তব্য সংক্রান্ত আমাদের পরবর্তী আলোচনায়।

এঙ্গেলস তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় পুস্তকটিতে নিজ দৃষ্টিভঙ্গির সারমর্ম ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে– ‘… রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শাশ্বত কালের নয়। এমন সমাজ ছিল যা রাষ্ট্র ছাড়াই চলেছে, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রক্ষমতার কোনও ধারণা তাদের ছিল না। অর্থনৈতিক বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে এসে যখন সমাজ অবশ্যম্ভাবী রূপে শ্রেণিবিভক্ত হয়ে পড়ে, সেই বিভাজনের কারণে রাষ্ট্র এক অবশ্য প্রয়োজন হিসাবে উদ্ভূত হয়।

আমরা এখন উৎপাদন বিকাশের এমন একটা পর্যায়ের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছি, যখন এই সব শ্রেণির অস্তিত্ব শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, তাদের অস্তিত্ব উৎপাদনের সামনে সোজাসুজি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অতীতে শ্রেণির উদয় যেমন অনিবার্য ছিল, তেমনই অনিবার্য হবে তাদের বিলুপ্তি। শ্রেণি বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবেই লোপ পাবে রাষ্ট্র। উৎপাদকদের স্বাধীন ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলে সমাজ সে দিন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে পাঠাবে পুরাবস্তুর যাদুঘরে– চরকা ও ব্রোঞ্জ কুঠারের পাশে হবে তার যোগ্য স্থান।

বর্তমান সোসাল-ডেমোক্র্যাটদের প্রচার ও আন্দোলনমূলক সাহিত্যে এঙ্গেলসের এই কথাগুলো বড় একটা দেখা যায় না। যদিওবা কোথাও নজরে পড়ে, দেখা যায় দেবতার বিগ্রহের সামনে নতজানু হওয়ার মতো করে তারা এগুলি উদ্ধৃত করে। অর্থাৎ এঙ্গেলসের প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখানোর জন্যই তাদের তা করা। ‘সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুরাবস্তুর যাদুঘরে পাঠানোর’ জন্য প্রয়োজনীয় বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পরিধিটা যে কত গভীর ও ব্যাপক, তা নিয়ে ভাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা তারা করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে এঙ্গেলস যা বুঝিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বোঝার চেষ্টাও তাদের মধ্যে দেখা যায় না। (চলবে)