সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সুভাষচন্দ্রের আদর্শবিরোধী — অনিতা বসু পাফ

‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সুভাষচন্দ্রের আদর্শবিরোধী’ সাক্ষাৎকারে বললেন নেতাজি কন্যা অনিতা বসু পাফ

 

বিশিষ্ট সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ি সম্প্রতি তাঁর জার্মানি সফরের সময়ে স্টাডবুর্গেন শহরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কন্যা অনিতা বসু পাফ-এর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। সেটি নাগরিক ডট নেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ আমরা এখানে প্রকাশ করলাম।

 

প্রশ্নঃ ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর চলছে। একইসঙ্গে এটা সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মের ১২৫তম বছর। আপনার কি মনে হয় স্বাধীন ভারত তাঁর অবদানকে যথার্থ স্বীকৃতি দিতে পেরেছে?

অনিতা বসু পাফঃ  আমার বাবা সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিজের গোটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর ভারত তাঁর অবদানকে প্রাপ্য মর্যাদা পুরোপুরি দিতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। সুভাষচন্দ্র বসু এবং আইএনএ-র অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি আজও মেলেনি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুটো ধারা ছিল। একটা ধারা অহিংস পন্থায় বিশ্বাসী, অন্যটা আপসহীন সংগ্রামে। আমার বাবা ছিলেন দ্বিতীয় ধারার উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি। বহু দশক ধরেই একটা প্রচার চলে আসছে যে, ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির কৃতিত্ব অহিংস ধারার। এটা ঠিক নয়। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভূমিকাও বিরাট ছিল। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের ঐতিহাসিক সংগ্রাম চিরকাল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে। লাল কেল্লায় আইএনএ-র বিপ্লবী যোদ্ধাদের বিচার চলাকালীন তাঁদের মুক্তির দাবিতে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। নৌবিদ্রোহের অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁরা। এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও বেশি চর্চা হওয়া প্রয়োজন।

তবে আমি একটা কথা বলতে চাই। ইতিহাসবিদ বা রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকার উপর বাবার স্মৃতি নির্ভরশীল নয়। ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ বাবার স্মৃতি বুকে নিয়ে বাঁচেন। এত বছর পরেও সুভাষচন্দ্র বসু কোটি কোটি মানুষের জীবনের আদর্শ। ওঁর মতো একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর এর চেয়ে বড় কোনও প্রাপ্তি হতে পারে না।

প্রশ্নঃ ভারতে নির্বাচন এসে পড়লে বহু রাজনৈতিক দলই সুভাষচন্দ্র বসুর কথা বলে, তাঁর ছবি নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি দিল্লিতে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আপনি বিষয়টাকে কী ভাবে দেখেন?

অনিতাঃ আমি সারাক্ষণ ভারতের খবর রাখি। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে বাবাকে নিয়ে মাতামাতি করে, তাঁর ছবি ব্যবহার করে, সবই জানি। আমার এই নিয়ে খুব কিছু বলার নেই। সুভাষচন্দ্র বসুকে তো তাঁর দেশের মানুষ শ্রদ্ধা জানাবেন বটেই। রাজনৈতিক দলগুলোও তো দেশেরই অংশ। তবে এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন যেন প্রকৃত শ্রদ্ধা হয়। আমার বাবা কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন, ফরওয়ার্ড ব্লক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কংগ্রেস থেকে ভেঙেই তৃণমূল কংগ্রেস হয়েছে। তবে কংগ্রেস যে সবসময় সুভাষচন্দ্র বসুর আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিতে খুব উৎসাহী ছিল, তেমন আমার মনে হয়নি।

দিল্লিতে বাবার মূর্তি উদ্বোধন হওয়ার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি যাইনি। ৮ সেপ্টেম্বর মূর্তির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী, আমি ৩ সেপ্টেম্বর আমন্ত্রণ পত্র পাই। কেন ৮ সেপ্টেম্বর তারিখটাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল তাও বুঝতে পারিনি। ওই তারিখের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর কোনও যোগ নেই।

আর একটা কথা বলতে চাই। সুভাষচন্দ্র বসু স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর আইএনএতে ধর্মীয় ভেদাভেদের কোনও জায়গা ছিল না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে তাঁর মতাদর্শ একেবারেই মেলে না। ধর্মীয় ভেদাভেদের রাজনীতি এবং সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ পরস্পরবিরোধী।

প্রশ্নঃ অনেকে অভিযোগ করেন সাম্প্রতিককালে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত হচ্ছে। আপনার কী অভিমত?

অনিতাঃ আমি এই প্রসঙ্গে আমার বাবার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত অনুশীলনের কথা বলতে পারি। আগেই বললাম, সুভাষচন্দ্র যে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন, তা এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এই বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মাচরণ ব্যক্তিগত বিষয়, কিন্তু রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সব নাগরিকের অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। তা যদি কোনও দেশে না হয়, তা হলে বিষয়টা দুঃখজনক। বিভাজনের রাজনীতি আমার বাবার রাজনৈতিক অনুশীলন ও মতাদর্শের পরিপন্থী। উনি যখন ঝুঁকিপূর্ণ সাবমেরিনযাত্রা করলেন, তখন ওঁর সঙ্গী ছিলেন একজন মুসলিম। ওঁর শেষ বিমানযাত্রাতেও সঙ্গী ছিলেন একজন মুসলিম। আইএনএতে কোনও ধর্মীয় সম্ভাষণের জায়গা ছিল না, একটিই সম্ভাষণ ‘জয় হিন্দ’। এই কথাগুলো মাথায় রাখা জরুরি।

প্রশ্নঃ আপনার মায়ের কথা কিছু বলুন। কী করে ওঁদের আলাপ হল?

অনিতাঃ আমার মায়ের জন্ম ১৯১০ সালে। ওঁর যখন ২৪ বছর বয়স, তখন ওঁর সঙ্গে বাবার দেখা হয়। ১৯৩৪ সালে বাবা চিকিৎসার জন্য ভিয়েনায় ছিলেন। মান্দালয় এবং বার্মায় জেলে থাকাকালীন উনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকার ওঁকে শর্তাধীনে চিকিৎসার জন্য ভিয়েনায় আসার অনুমতি দেয়। ভিয়েনায় থাকাকালীন বাবা একটা বই লিখছিলেন, সেই জন্যে একজন সেক্রেটারি খুঁজছিলেন। একজন ভারতীয় ছাত্র আমার মায়ের কথা ওঁকে জানায়, মা সেক্রেটারি হিসাবে কাজে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওঁরা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হন।

তিনের দশকের দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় পুরো সময়টাই বাবা ভারতে ছিলেন। ১৯৩৮ সালে উনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন, ১৯৩৯ সালে মহাত্মা গান্ধী সমর্থিত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে আবার সভাপতি হন। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪১ সালে আমার বাবা আবার জার্মানিতে পা রাখেন। এরপর ১৯৪৩ সালে উনি সাবমেরিনে জাপানে চলে যান। আমার জন্ম হয় ১৯৪২ সালে।

প্রশ্নঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক কার্যকলাপ, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা নিয়ে যদি কিছু বলেন।

অনিতাঃ আমার বাবার প্রথম এবং শেষ লক্ষ্য ছিল তাঁর মাতৃভূমির স্বাধীনতা লাভ। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্য তিনি সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করেন মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। কোণঠাসা ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। সুভাষচন্দ্র আরও মনে করেছিলেন, দেশে থেকে এই কাজ সম্ভব নয়। ধাক্কা দিতে হবে দেশের বাইরে থেকে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ লগ্নে বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর প্রথম পছন্দের দেশ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। মনে রাখা দরকার উনি জার্মানিতে এসেছিলেন সোভিয়েতের উপর দিয়েই। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ওঁকে সাহায্য করতে পারল না। এই অবস্থায় ভারতের স্বাধীনতার জন্য জার্মানি, জাপান এবং ইটালির সাহায্য নেন। নিঃসন্দেহে এই দেশগুলোর সাহায্য নেওয়া তাঁর পক্ষে ‘গ্রেট চয়েস’ ছিল না। কিন্তু যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, তা হলে দেখব এ ছাড়া অন্য কোনও উপায়ও ছিল না। ভারতের স্বাধীনতার জন্য উনি ব্রিটেনের শত্রুপক্ষের সাহায্য চেয়েছিলেন। ওই বিশেষ সময়ে ব্রিটেনের শত্রুদের সাহায্যই ওঁকে নিতে হয়েছিল।

সুভাষচন্দ্র যে ফ্যাসিস্ট ছিলেন না, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে, তখন বাবা অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেন। ওঁর বহু পরিকল্পনা এর ফলে ধাক্কা খায়। জার্মানিতে আইএনএর যে শাখা ছিল, তাদের উপর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, তারা কেবলমাত্র ব্র্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়বে। এর ফলে তারা কখনওই রাশিয়ায় যুদ্ধ করতে যায়নি। অত্যন্ত জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র।

প্রশ্নঃ আজকের ভারতে সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক মতাদর্শ ঠিক কতখানি প্রাসঙ্গিক?

অনিতাঃ আমার বাবা একজন বামপন্থী ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না ঠিকই, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও হননি, কিন্তু মতাদর্শগতভাবে ছিলেন বামপন্থী। বাবা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাস করতেন, মহিলাদের ক্ষমতায়নে জোর দিতেন। চারের দশকে তিনি আইএনএতে মহিলা বাহিনী তৈরি করেছিলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন (পরবর্তীকালের কমিউনিস্ট নেত্রী লক্ষ্মী সায়গল)। বাবা বিশ্বাস করতেন ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ নয়, সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। আমি মনে করি এর সবকটাই এখনকার ভারতের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ।