সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বেশি করে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করবে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ (পাঠকের মতামত)

জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকা বহু বিষয় দেখলে মনে হবে শিক্ষা ব্যবস্থায় এ এক আমূল পরিবর্তনের সূচনা৷ একইভাবে ১৯৮৬ সালের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ অথবা ২০০৯ সালের ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ যখন কার্যকরী হয়েছিল তখনও আমাদের অনেকের মধ্যে এই একই উপলব্ধি হয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে বহু ভালো ভালো কথার আড়ালে এমন কিছু বিষয় ছিল যার ফলে সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বেশি করে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে৷ আজও যদি আমরা শিক্ষানীতির কয়েকটি বিষয়কে বেছে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠি তাহলে সামগ্রিক বিচার ধারাটি আড়ালে থেকে যাবে৷

১) জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষার জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের যোগান প্রয়োজন তা আসবে কী করে? জিডিপি ৬ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে৷ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত৷ কিন্তু প্রতি বছর শিক্ষায় বরাদ্দকৃত অর্থ কমানো হচ্ছে৷ ফলে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে৷

২) শিক্ষা যুগ্ম তালিকায় রয়েছে৷ আলাপ–আলোচনা, সমালোচনা বা প্রতিবাদের রাস্তা বন্ধ করে, রাজ্যগুলির সাথে আলোচনা না করে, সংসদকে এডিয়ে করোনার মতো অতিমারি ভাইরাসের আক্রমণে যখন দেশ জর্জরিত তখন এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য সময়টাকে বেছে নেওয়া হল কেন?

৩) সামগ্রিক পরিকাঠামো গড়ে না তুলে বারবার গুরুগম্ভীর শিক্ষানীতি ঘোষণা করে কতটুকু সুফল পাওয়া যাবে? বিগত দিনে ১৯৮৬ সালের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ এবং ২০০৯ সালের ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ একই ভাবে বিরাট আশা নিয়ে মানুষের কাছে এসেছিল৷ বাস্তবে আমরা কী পেয়েছি?

৪) শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে বেসরকারিকরণের গ্রাস থেকে রক্ষা করার কোনও পরিকল্পনা এই শিক্ষানীতির মধ্যে নেই৷ শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়ভার সরকার গ্রহণ না করলে শিক্ষা বাস্তবে সকল মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে কি? দেশের বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে অবসান ঘটিয়ে শিক্ষার সম্পূর্ণ দায় সরকার গ্রহণ করার দিকে এগোচ্ছে কি? নাকি উল্টো পথে হাঁটা হচ্ছে?

৫) মাধ্যমিক শিক্ষার গুরুত্বকে কোনওভাবেই হ্রাস করা ঠিক নয়৷ এই পরীক্ষার পর বহু ছাত্র–ছাত্রীই ড্রপ আউট হয়ে যায়৷ বর্তমান কাঠামোকে বদলে দিয়ে যদি সেমেস্টার পদ্ধতিতে নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ভিত্তিতে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট দেওয়া হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ হওয়ার আগে ড্রপ আউটের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে না কি?

৬) সারা দেশে অঙ্গনওয়াডি শিক্ষা কেন্দ্রে তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের শিক্ষা ও পরিচর্যার ব্যবস্থা রয়েছে৷ নয়া শিক্ষানীতির মাধ্যমে সেই কেন্দ্রে আরও দু’বছরের জন্য অর্থাৎ প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণি যুক্ত করা হল৷ এই কেন্দ্রগুলির বর্তমানে যা হাল তাতে কি আরও দুটি শ্রেণিযুক্ত করার মতো উপযুক্ত শিক্ষক এবং পরিকাঠামো রয়েছে? শিক্ষার ভিত্তি হল প্রাথমিক শিক্ষা৷ তা যদি নড়বড়ে হয় তাহলে বৃহৎ কথার আড়ালে ‘পর্বত মূষিক প্রসব’ করবে না তো? এর ফলে অর্থবানরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে আরও বেশি করে দৌড়াতে বাধ্য হবে৷ পড়ে থাকবে অসহায় দরিদ্র সাধারণ বাড়ির সন্তানরা৷

৭) নয়া শিক্ষানীতির মাধ্যমে অনলাইন ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয়েছে৷ করোনা পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে দেখতে পেয়েছি প্রায় আশি শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনের আওতার বাইরে থেকে গিয়েছে৷ সাধারণ বাড়ির সন্তানরা এর মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ পাবে কি?

৮) নতুন শিক্ষানীতিতে তিনটি ভাষা শিক্ষার কথা বলা হয়েছে যার মধ্যে দুটি ভাষাকে হতে হবে ভারতীয়৷ তার মানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার গুরুত্বকে হ্রাস করার চেষ্টা রয়েছে এই নীতিতে৷

মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকে প্রথম থেকে গুরুত্ব সহকারে পড়াতে হবে৷ তা না হলে কোনও শিক্ষার্থীর শক্ত ভিত গড়ে উঠতে পারবে না৷ কারণ ঐতিহাসিক কারণেই শিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্রের জ্ঞানের আকর রয়েছে এই ভাষার মধ্যেই৷ তা থেকে কোনওভাবেই বঞ্চিত করা যাবে না ছাত্র–ছাত্রীদের৷ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে এক নিয়ম আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে আরেক নিয়ম যদি হয় তাহলে পরোক্ষভাবে বেসরকারি শিক্ষার দিকে মানুষকে ঠেলে দেওয়ার এ আর এক কৌশল নয়ত?

৯) শিক্ষার ভিত্তি যদি প্রাথমিক শিক্ষা হয় তাহলে সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে সারা দেশ জুডে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা এই শিক্ষানীতিতে নেই৷ ভিত শক্ত হলে তবেই তো তার উপর ইমারত গডে তোলা সম্ভব৷

১০) তিন বছর বয়স থেকে শিশু শিক্ষার বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে৷ ওই সময় থেকে সরকারিভাবে সারা দেশজুডে শিক্ষার ব্যাপক পরিকাঠামো তৈরি করতে না পারলে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটি নেবে৷ বলাবাহুল্য শিক্ষার এই প্রারম্ভিক স্তরটির যা করুণ দশা তাতে শুরু থেকেই বেসরকারি শিক্ষা জাঁকিয়ে বসবে৷ পরিণতিতে বিরাট অংশের সাধারণ গরিব বাড়ির সন্তানরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে৷ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বৈষম্য তৈরি হবে৷

১১) বেশ কিছু অবাস্তব শিক্ষানীতি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া হলেও বাস্তবে দেখা যায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির্ ক্ষেত্রে তা কার্যকরী হয় না৷ ফলে একই দেশে দু’রকম শিক্ষা পদ্ধতি চলতে থাকে৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিগত দিনে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি বা পাশ ফেল প্রথা তুলে দেওয়া হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা বহাল থাকে৷ তার ফলে ধনী বাডির সন্তানরা অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ আর বঞ্চিত থেকে যায় সাধারণ গরিব বাড়ির বিরাট অংশের ছাত্র–ছাত্রীরা৷ এর অবসান নয়া শিক্ষানীতির মাধ্যমে ঘটবে কি?

১২) বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছাত্র–ছাত্রীদের পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সমর্থনযোগ্য কিন্তু পদার্থবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গীত কিংবা সংস্কৃতের সঙ্গে কম্পিউটার সায়েন্স বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে পদার্থবিদ্যা, বিষয় শিক্ষাকে কতটা সাহায্য করবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে৷

১৩) সংস্কৃত ভাষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না৷ প্রত্যেকে তার পছন্দ অনুযায়ী ভাষা শিক্ষা অর্জন করতেই পারে৷ তাতে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই৷ তার পছন্দের ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে আবশ্যিক করতেই হবে৷ স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাই নিজে সংসৃক্তে দিকপাল হওয়া সত্ত্বেও ছাত্র–ছাত্রীদের জন্য ইংরেজি, ফিজিক্স, গণিত এবং আধুনিক যুক্তিবিদ্যা পড়ানোর পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন৷

১৪) মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দিয়ে নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ভিত্তিতে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হলে বর্তমানে সমস্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় বহু বিষয়ে শিক্ষক সহ উন্নত পরিকাঠামো গডে তুলতে হবে৷ আগে তা না করে হঠাৎ করে এই শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দিলে তা মুখ থুবড়ে পডতে বাধ্য৷ এর সুযোগ নেবে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীরা৷

১৫) যেখানে হাজার হাজার ছাত্র–ছাত্রী ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন করে কাজের জন্য হাহাকার করে ঘুরে বেডাচ্ছে সেখানে বিদ্যালয় স্তরে বৃত্তিমূলক শিক্ষা কতটুকু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে তা যথেষ্ট সন্দেহের৷ তাছাড়া বিশ্বায়নের যুগে এইসব শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে কাজ শিখে খোলাবাজারে বৃহৎ শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কতটুকু পেরে উঠবে তা সহজে অনুমেয়৷

সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হলে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে উন্নত পরিকাঠামোর সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে হবে৷ তবেই শিক্ষা ধনী বা গরিব বাড়ির সন্তানদের কাছে সমানভাবে পৌঁছে যাবে৷ আর শিক্ষানীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যাঁরা হাতে–কলমে শিক্ষা দান করছেন সেই শিক্ষক–শিক্ষিকাদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষানীতি গ্রহণ করতে হবে৷ শিক্ষানীতির এই আসল কাজটিকে এড়িয়ে গিয়ে কোনও শিক্ষানীতি সফল হতে পারেনি আর পারবেও না৷

কিংকর অধিকারী

বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর