বিপন্ন গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ (পাঠকের মতামত)

চার মাস ধরে লকডাউন ও আনলকের বিভিন্ন পর্বে এ দেশের হতদরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষদের, একদিকে করোনা ভাইরাস মোকাবিলা এবং পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের যন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কিছু দার্শনিক উপদেশ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও উল্লেখযোগ্য সদর্থক ভূমিকা ছিল না৷ কিন্তু বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে রাষ্ট্রীয় দমন–পীডন আইন, গ্রেফতারি পরোয়ানা, পুলিশিরাজ বিস্ময়কর ভাবে বেডেছে৷ লকডাউনের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কিছুক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, আর কিছু ক্ষেত্রে রাস্তায় নামার উপায় না থাকার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় দমন–পীড়ন অবাধে চলছে৷ পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমকে কোণঠাসা করে গণতান্ত্রিক আবরণের যতটুকু ছিঁটেফোটা ছিল তাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে সরকার৷ এনআরসি, সিএএ বিরোধীদের ওপর একের পর এক আক্রমণ, দিল্লির ‘দাঙ্গা’র নামে ধরপাকড় লেগেই আছে৷ রাজপথে নেমে সিএএ–এর বিরোধিতা করার সাহস দেখিয়েছিল বলে জামিয়া মিলিয়া ছাত্রছাত্রীদের একটির পর একটি চার্জশিট ধরানো হল৷ এমনকি দিল্লিতে উত্তরপ্রদেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণকারী সমাজকর্মীদের ইউএপিএ দানবীয় ধারায় আটক করা হল, যে ধারায় মূলত বিশেষ পরিস্থিতিতে উগ্রপন্থীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়৷ এই আইনে সরকার যে কোনও নাগরিককে দেশদ্রোহের অভিযোগে বিনা প্রমাণে জামিন অযোগ্য ধারায়, এজলাসে না তুলে কমপক্ষে এক বছর জেলবন্দি করে রাখতে পারে এবং এক বছর পর অভিযুক্ত মুক্তি পেলেও ঠিক তার পরের দিন অভিযুক্তকে পুনরায় এক বছরের জন্য কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারে৷ এই জাতীয় আইন একটি ফ্যাসিস্ট সরকারই ব্যবহার করে থাকে৷ শাহিনবাগ সিদ্ধান্ত করেছিল লকডাউন পরিস্থিতিতে কয়েক হাজার জমায়েতের বদলে ছয় জন পালা করে প্রতীকী অবস্থান আন্দোলন চালিয়ে যাবে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ দিল্লির পুলিশ লকডাউনের অজুহাতে ২৪ মার্চ শাহিনবাগ জনশূন্য করে দিয়েছে৷ কোভিড স্বাস্থ্যবিধির কোনও তোয়াক্কা না করে, বিজেপি মধ্যপ্রদেশের এমএলএ ভাঙিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মুখ্যমন্ত্রীর পদে শিবরাজ সিংহ চৌহানকে বসিয়ে দিল৷ আর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের অসন্তোষ যথার্থ ভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ পেয়ে কোনও সংগঠিত আন্দোলনের রূপ না পায়, সে কারণে সংবাদপত্রের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতার ওপর ক্রমাগত আক্রমণ নেমে আসছে৷ দিল্লির একটি পেশাদার সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী এ বছর ২৫ শেষ মার্চ – ৩১শে জুনের মধ্যে ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, এফআইআর ইত্যাদি নেমে এসেছে, অনেকে শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, সম্পত্তি ক্রোক করার নোটিশ পেয়েছেন৷ এই তালিকায় সিদ্ধার্থ বরদারাজন, বিনোদ দুয়া প্রমুখ যশস্বী সাংবাদিকরাও রয়েছেন৷ ‘রাইজিং কাশ্মীর’ এর সম্পাদক সুজাত বুখারি, বরিষ্ঠ সম্মানীয় সাংবাদিক, ১৪ জুন অফিস থেকে বেরিয়েই ১৮টা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন৷ ১৯৯০ সালে কাশ্মীরেই ১৯ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন৷ নিগৃহীত সাংবাদিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি আদিত্যনাথের ‘রামরাজ্য’ উত্তরপ্রদেশে, ১২ জন৷ সম্প্রতি কানপুরের ডন বিকাশ দুবের সাজানো এনকাউন্টারের সময় ওই এলাকায় পৌঁছানো সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল৷ দুষ্কৃতীদের মাধ্যমে সাংবাদিকদের উস্কানি দিয়ে ফাঁদে ফেলে তারপর হত্যা করার উদাহরণ উত্তরপ্রদেশে গাজিয়াবাদে গত ২০ জুলাই বিক্রম যোশীর মৃত্যু৷ জনৈক চিনা রাজপুরুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে ভারত সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর মন্তব্য প্রকাশের দায়ে এ দেশের প্রাচীন ও সর্বতোমান্য সাংবাদিক সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার কপালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পুরস্কার জুটেছে৷

সুরজিৎ দেবরায়

কলকাতা