সন্তানের পাতে দুটো ভাত দিতে জেরবার মানুষ, বিজেপি সরকার ব্যস্ত মালিক তোষণে

সন্তানের পাতে ঠিকমতো দুটো ডাল-ভাত দিতে হলেও কপালে চিন্তার ভাঁজ আজ বহু মায়ের কপালে। ছেলেমেয়েরা আলুসেদ্ধতে এক ফোঁটা বেশি তেল চাইলেও অসহায় চোখে ফাঁকা শিশিটা দেখছেন কত সংসারের কর্তা-কর্ত্রীরা! বাজারে সরষের তেলের দামের ঝাঁঝ প্রতিদিন চোখের জল ঝরাচ্ছে। সরষের তেল ২০০ টাকায় পৌঁছেছে আগেই। তার ঊর্ধ্বগতির দৌড় বুঝিয়ে দিচ্ছে তা উঠবে আরও বহু দূর। অন্য ভোজ্য তেলের দামও আশেপাশেই ঘুরছে। চাল, ডাল, গম, আটা, মশলাপাতি, শাক সবজি থেকে মাছ-মাংস– কোনটার দাম আকাশছোঁয়া হয়নি? কষ্ট করে যদি কেউ সামান্য কিছু কিনেও আনেন, রান্নার গ্যাসটাও যে হাজার টাকার কাছাকাছি! কার কাছে যাবেন? কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলি ব্যস্ত নিজের নিজের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার সাফাই গাইতে। তাদের কাছে দরবার করে লাভ কী?

কিন্তু কেন এত অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি? দেশে কি কৃষিপণ্যের উৎপাদনে কোনও ঘাটতি দেখা দিয়েছে? তা হলে তো বাজারগুলোতে শাকসবজি, চাল-ডাল, আটা, সরষের তেলের আকাল দেখা দিত! তেমনটা কি ঘটেছে? বাজারে কোনও জিনিসের অভাব নেই, অভাব শুধু সেগুলো কেনার জন্য সাধারণ মানুষের হাতে পয়সার! তবে কি কৃষকরা তাঁদের উৎপাদন খরচের তুলনায় বাড়তি কিছু টাকা পাচ্ছেন? তা হলে তো দেশে হাজার হাজার কৃষককে আত্মহত্যা করতে হত না! তবে এই দাম বৃদ্ধি কেন?

এদিকে দেশের কৃষকরা সংযুক্ত কিসান মোর্চার মাধ্যমে ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধ পালনের আহ্বান করেছেন। সমস্ত কারখানা শ্রমিক, চুক্তি শ্রমিক, অস্থায়ী দৈনিক রোজের কর্মচারী, পরিবহণ কর্মচারী, অফিস কর্মচারী, শিক্ষক, হকার, দোকানদার, ছোট ব্যবসায়ী সহ সমস্ত স্তরের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে তাঁরা আবেদন করেছেন– এই বনধকে সর্বাত্মক করুন। সরকারের চোখের উপর চোখ রেখে ওই একটা দিনের জন্য সব কিছু স্তব্ধ করে দিন। বিজেপি সরকারের তিন কৃষি আইন, নতুন বিদ্যুৎ আইনের বিরোধিতায় নেমেছেন তাঁরা। সংসারে প্রতিদিন হেঁসেলটাই চলবে কি না যখন প্রশ্ন, তার উপর আবার একটা বনধ ডাকছেন কৃষকরা, সমর্থন করবেন সব পেশার খেটে খাওয়া মানুষ! এ কি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো নয়? বাজারে দামের ছ্যাঁকা খেয়ে অস্থির পরিবারগুলির কাছে এই সব আইনের কচকচির মূল্য কী?

একটু খতিয়ে দেখা যাক। বাজারে আজকাল গেলেই দেখবেন সরষের তেল বলুন, আটা বলুন, চাল বলুন সব কিছুই বিক্রি হচ্ছে প্যাকেটবন্দি। আপনি খুচরো তেল, আটা, চাল চাইলে বহু সময় পাবেনই না। পাড়ার মুদির দোকানে যদি বা পান, তার গুণমানও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ফলে কিনতে হবে ওই প্যাকেটই। তার কোনওটা আদানি গোষ্ঠীর ফরচুন, কোনওটা বা আম্বানিদের মালিকানার রিলায়েন্সের ছাপধারী, কোনওটা বা স্বনামধন্য আইটিসি-র, কেউ বা টাটাদের তকমা নিয়ে দোকান আলো করছে। দাম? খুচরো জিনিসের দামের চেয়ে ওই সব প্যাকেটের দামের ফারাক ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অন্য দিকে শপিং মল কাগজের পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে বলছে সপ্তাহে একদিন করে বিপুল ছাড়ে নিয়ে যান– ঘরের যা লাগবে তার সব কিছু। কারা চালাচ্ছে ওই সব মল? যাদের নাম বলা হল প্যাকেটবন্দি মুদিখানা সামগ্রীর জন্য, সেই সব বৃহৎ পুঁজি মালিকরাই আবার শপিং মলের মালিক। খুচরো ব্যবসা দখল করার জন্য একচেটিয়া মালিকদের কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। ফলে সাধারণ তেলকল, ধানকল, ফসল ব্যবসায়ী, আটাচাকির দোকানদাররা যে ব্যবসা করতেন তা ক্রমাগত লাটে উঠছে। জায়গা নিচ্ছে বৃহৎ পুঁজির মালিকরা। বিরাট বিরাট একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা এখন কৃষিপণ্যের ব্যবসায়। তারা কৃষিপণ্যের চাষে টাকা ঢালছে, ইতিমধ্যেই শত শত একর জমি নিয়ে গুদাম, সংরক্ষণের নানা ব্যবস্থাও তারা করে ফেলেছে।

কৃষিপণ্যের ব্যবসায় একচেটিয়া দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের মুনাফা সুনিশ্চিত করতেই বিজেপি সরকার এনেছে তিনটি কৃষি আইন। এর একটি হল চুক্তি চাষের আইন। যে আইন চাষিকে ইতিমধ্যেই বাধ্য করতে শুরু করেছে বৃহৎ পুঁজিপতিদের মর্জিমাফিক চাষ করতে, তাদের দরেই ফসল বেচতে। তাই সরষে চাষি যত সামান্য দরই পাক, টমেটো চাষি প্রতি কিলোতে এক টাকা বা তার কমই পাক, এই বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজারে তা অগ্নিমূল্য। চালু হয়েছে কৃষি ফসলের আগাম লেনদেনের ব্যবস্থা। মাঠে ফসল থাকতে থাকতেই বৃহৎ ব্যবসায়ীরা স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার কেনাবেচার মতো অনলাইনে ফসলের দাম নিয়ে ফাটকা নিলাম হাঁকছে। ফলে মাঠের ফসল কৃষক যেমন ব্যবসায়ীদের বেঁধে দেওয়া দরেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, সেই ফসলই বহুজাতিক কোম্পানির গুদাম ঘরে প্যাকেট বন্দি হয়ে আগুন দামে পৌঁছচ্ছে ক্রেতার হাতে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনসংশোধন করে বলেছে বৃহৎ ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি, আলু ইত্যাদির দাম যত খুশি বাড়াক, সরকার ব্যবস্থা নেবে না।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে ডিজেলের মারাত্মক দামবদ্ধি। চাষ এখন বহু দিক থেকে যন্ত্রনির্ভর। ট্রাক্টর, হারভেস্টরের মতো যন্ত্র ভাড়া না করে সাধারণ চাষিরও চলছে না। তেলের দাম বাড়লে তার ভাড়া বাড়ে লাফিয়ে। বাড়ে সেচের পাম্পের খরচ। একই সাথে বিপুল হারে বাড়ে পরিবহণের খরচ। বিদ্যুতের দাম যেভাবে বেড়েছে তার ফলে সেচের বিদ্যুতের দাম যেমন বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে হিমঘরের ভাড়া। যা জোগানো অসম্ভব বলে বহু ক্ষুদ্র চাষিকে মাঠ থেকেই ফসল দিয়ে দিতে হচ্ছে বৃহৎ কোম্পানির এজেন্টদের হাতে। আর এর প্রত্যেকটির ধাক্কা যেমন গিয়ে পড়ছে একেবারে সাধারণ চাষির উপর, তেমনই নিতান্ত সাধারণ গৃহস্থের উপর। এর উপর বিদ্যুৎ আইনের নতুন সংশোধনী যেমন বিদ্যুতের দাম বাড়াবে, একই সাথে বাড়াবে কৃষিপণ্য সহ সমস্ত কিছুর দাম। সর্বনাশা কৃষি আইন, বিদ্যুৎ আইনের নতুন সংশোধনী অগণিত গরিব মধ্যবিত্ত সংসারের ভাতের থালাটুকুও কেড়ে নেবে। আপনার বড় আদরের সন্তানের পাতে দুটো ভাত ঠিকমতো দিতে হলেও আজ দাঁড়াতে হবে কৃষকদের এই সংগ্রামের পাশে।

বন্ধ হতে বসা হেঁসেলের চুলাটুকু জ্বালিয়ে রাখতে হলেও এই একটা দিন কল-কারখানা, অফিস-কাছারি, যানবাহন, হাট-বাজার সব কিছু বন্ধ করে বিজেপি সরকারের নির্লজ্জ মালিক তোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের আওয়াজ তোলা দরকার। এই বনধে সামিল হতেই হবে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৯ সংখ্যা