শ্রমিকের প্রাণরক্ষার দায়ও ঝেড়ে ফেলছে মালিক এবং সরকার

খনি এবং কারখানা দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের মৃত্যুমিছিল যেন দেশে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু’দিন হইচইয়ের পর সমস্ত ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে, কোথাও শ্রমিক বিক্ষোভ হলে কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে দায় সারছে অথবা পরিবারের সদস্যদের হাতে সামান্য কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে ৩ জন শ্রমিক কাজ করতে করতে বিষাক্ত গ্যাসে মারা গেলেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আরও চার জন। কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিক নিরাপত্তার অভাবই এই ভয়ঙ্কর পরিণতির কারণ। ২৬ জানুয়ারি দুর্গাপুরের ফরিদপুর-লাউদোহা ব্লকে খোলামুখ কয়লাখনিতে কাজ করতে গিয়ে একই পরিবারের চারজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এর চারদিন পর ঝাড়খণ্ডের নিরশার খোলামুখ কয়লাখনিতে পাথরের চাঁই চাপা পড়ে প্রাণ হারান পাঁচ জন। বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, তেলেঙ্গানা, মেঘালয়ের খনিগুলিতে প্রতি দিন কয়েক লক্ষ শ্রমিক জীবন বাজি রেখে কয়লা তুলতে নামেন। ঠিকা, অস্থায়ী এবং চুক্তি শ্রমিকদের দিনের পর দিন নামমাত্র বেতনে কাজ করতে হয়। কাজেরও নিরাপত্তা নেই, নেই জীবনের নিরাপত্তাও।

কেন নিরাপত্তা নেই? নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে তাদের সর্বোচ্চ মুনাফায় যাতে টান না পড়ে সেই কারণে মালিকরা নিরাপত্তার কোনও দায়িত্বই পালন করে না। দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকের প্রাণের ঝুঁকির নিরিখে ভারতের খনিগুলি সর্বাধিক ঝুঁকিসম্পন্ন খনির অন্যতম। সম্প্রতি সংসদে দেওয়া তথ্য, ২০১৫-২০১৭ সালের মধ্যে ভারতের কয়লাখনিতে ২১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, ‘১৯-‘২০-তে ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু কয়লাখনিতে, তাও নথিভুক্ত ঘটনা। অনথিভুক্ত অসংখ্য ঘটনা রয়েছে।

শ্রমিক-দুর্ঘটনার ভয়াবহতা দেখে যে কোনও মানুষ আঁতকে উঠবেন। যেন এগুলি অনিবার্যই ছিল। হরিয়ানার গুরুগ্রাম ও ফরিদাবাদে গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানায় প্রতি বছর প্রায় পাঁচশো শ্রমিকের আঙুল ও হাত কাটা যায়। পরবর্তীকালে পঙ্গু হয়ে কর্মহীন জীবন কাটে এঁদের। এই কর্মীরা মূলত ঠিকাশ্রমিক। ঠিকাদারের অধীনে তারা কাজ করে, আধুনিক যন্ত্রপাতি চালানোর প্রশিক্ষণ এঁদের নেই। এঁরা ঠিকাশ্রমিক হওয়ায় নিয়োগকারী সংস্থা এদের ‘দিন আনি দিন খাই’ মজুরে পরিণত করে রেখেছে। দুর্ঘটনা ঘটলে কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়ও থাকে না নিয়োগকারী সংস্থার। কারণ কোনও আইনের বেড়াতে তা আটকায় না। কারখানার শোষণ-যন্ত্রের চাকায় পেষাই শ্রমিক মালিকের সর্বোচ্চ মুনাফার জোগান দিতে বাধ্য হয়। সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে শোষণ চলতে থাকে অনায়াসে।

অথচ কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা শ্রমিকের প্রাথমিক এবং অলঙ্ঘ্য অধিকার। বহু যুগ ধরে বহু আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তা অর্জিত হয়েছিল। তা দু’পায়ে মাড়িয়ে চলেছে মালিকপক্ষ। তার অনুমোদন দিচ্ছে জনবিরোধী সরকারগুলি।

ভারতে চুক্তি শ্রমিক আইন (১৯৭০) অনুসারে, কুড়ি জনের বেশি (নতুন শ্রমবিধি অনুসারে ৩০০ জন) শ্রমিক নিয়োগ করে যে সংস্থা, তাকে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হলে রাজ্য সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। তা এড়াতে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করছে কর্তৃপক্ষ। তাদের কাজের নিরাপত্তা কম থাকায় তারা স্থায়ী কর্মীদের মতো সংগঠিত হতে পারছেন না। মালিকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে নিরাপত্তার দাবি তুলতে পারছেন না। ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট’ বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর্মী নিয়োগ আইনে (২০১৮) বলা হয়েছে, চুক্তি ফুরোলে কোনও কারণ না দেখিয়েই কর্মীদের ছাঁটাই করা যাবে। এর পূর্ণ সদব্যবহার করছে মালিকরা। যদিও এই আইনগুলির কোনওটাতেই বলা নেই, স্থায়ী শ্রমিকদের মতো বেতন কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার নেই চুক্তি বা ঠিকা শ্রমিকদের। বাস্তবে তার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমিক।

আগেকার শ্রমআইনগুলিতে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে বহু বিষয় থাকলেও তা কথার কথাতেই রয়ে গেছে। আজ আর সেই আব্রুটুকুও নেই। সম্প্রতি সংসদে বিজেপি সরকার শ্রমিকদের জন্য চারটি শ্রমবিধি পাশ করিয়েছে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী সেই বিধির বিরুদ্ধেই শ্রমিক সংগঠনগুলি ২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে তাতে পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি ও কাজের পরিস্থিতি সংক্রান্ত শ্রমিকদের সুযোগসুবিধা আরও কমানো হয়েছে। স্বভাবতই কমছে শ্রমিকদের নিরাপত্তা। শ্রমিকের কাজের এবং বেঁচে থাকার অধিকার পেতে বর্তমান ব্যবস্থা ও তার সেবাদাস সরকারগুলির বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হবে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২৮ সংখ্যা ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২