রাষ্ট্র ও বিপ্লব (৫)– ভি আই লেনিন

বিপ্লবের প্রধান কাজ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া

এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এবার পঞ্চম কিস্তি।

বিপ্লবের খতিয়ান

রাষ্ট্র বিষয়ে আমাদের আলোচ্য এই প্রশ্নে মার্ক্স ১৮৪৮-১৮৫১ সালের বিপ্লব থেকে যে উপসংহারে পৌঁছেছেন তা তাঁর ‘লুই বোনাপার্টের আঠারোই ব্রুমেয়ার’ গ্রন্থের নিম্নোক্ত বক্তব্যে পাওয়া যায় ‘‘বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখনও সে চলেছে প্রায়শ্চিত্তকালের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তার কাজ সে করে চলে সুনির্দিষ্ট প্রণালীতে। ১৮৫১ সালের ২ ডিসেম্বরের মধ্যে’ (লুই বোনাপার্টের অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলের বা কু’দেতার তারিখ) তা তার প্রস্তুতির কাজ অর্ধেকটা শেষ করেছে, এবার করছে বাকি অর্ধেকটা। তার প্রথম কাজ ছিল সংসদীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ করে তোলা, যাতে তাকে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়। এই লক্ষ‍্যমাত্রায় পৌঁছনোর পর এখন সে তার প্রশাসনিক কার্যনির্বাহক ক্ষমতাকে (এক্সিকিউটিভ পাওয়ার) নিখুঁত করে তুলতে চাইছে ও তার একেবারে বিশুদ্ধ রূপটা প্রকাশ করে দিয়ে তাকে বিচ্ছিন্ন করছে। বিপ্লব এখন এই প্রশাসনিক ক্ষমতাকে দাঁড় করাচ্ছে তার নিজেরই বিরুদ্ধে এবং আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্যস্থল হিসাবে, যাতে তাকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে ধ্বংসের সমস্ত শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করা যায়। নিজ প্রাথমিক কর্তব্যের এই দ্বিতীয়াংশ বিপ্লব যখন শেষ করবে, তখন ইউরোপ তার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জয়গর্বে চেঁচিয়ে উঠবে, ভালই করেছো, বুড়ো ছুঁচো।’’

‘‘বিশাল আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক সংগঠন সহ এক বিরাট এবং সুনিপুণ রাষ্ট্রযন্ত্র, তার পাঁচ লক্ষ লোকের সৈন্যবাহিনীর পাশে আরও পাঁচ লক্ষ রাজকর্মচারীর বাহিনী সহ এই প্রশাসন-ক্ষমতা, এক ভয়ঙ্কর পরজীবীর মতো ফরাসি সমাজদেহকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলে তার সমস্ত রন্ধ্রমুখকে পর্যন্ত রুদ্ধ করে রেখেছে। এই বিরাট ক্ষমতার উদয় হয়েছিল স্বৈর-রাজতন্ত্রের যুগে, সামন্ততন্ত্রেরর পতনের সময়ে, যখন সে পতনকে ত্বরান্বিত করতে এই প্রশাসনিক ক্ষমতা সাহায্যই করেছিল।’’ প্রথম ফরাসি বিপ্লবে কেন্দ্রীভবন বেড়ে ওঠে, ‘‘কিন্তু সেই সঙ্গে’’ তা বাড়িয়ে তোলে ‘‘সরকারি ক্ষমতার বহর, তার কাজের পরিধি ও তার কর্মকর্তাদের সংখ্যা। নেপোলিয়ন এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিপূর্ণ আকারে গড়ে তোলেন। বৈধ রাজতন্ত্র ও জুলাই রাজতন্ত্র ‘আরও বেশি শ্রমবিভাগ ছাড়া এতে নতুন কিছু যোগ করেনি।…’’

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল বিপ্লবের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সংসদীয় প্রজাতন্ত্র তার দমন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ক্ষমতার সহায় সম্বল ও কেন্দ্রীভবন বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। সব বিপ্লবই এই যন্ত্রটাকে ধবংসের বদলে আরও নিখুঁত করে গড়ে তুলেছে।’’ ‘‘পরস্পরকে হটিয়ে যেসব পার্টি আধিপত্যের জন্য লড়েছে তারা এই বিশাল রাষ্ট্র সৌধটার দখলদারিকেই বিজয়ীর প্রধান লুটের-ধন বলে গণ্য করেছে।’’ (‘লুই বোনাপার্টের আঠারোই ব্রুমেয়ার’, ৯৮-৯৯ পৃঃ, ৪র্থ সংস্করণ, হামবুর্গ, ১৯০৭।)

এই অসাধারণ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মার্ক্সবাদ ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’-এর স্তরের তুলনায় অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে। কমিউনিস্ট ইশতেহারে রাষ্ট্রের প্রশ্নটা তোলা হয়েছিল খুবই বিমূর্তভাবে— সাধারণ কথা ও সাধারণ ভাষায়। কিন্তু এখানে প্রশ্নটা রাখা হয়েছে সুনির্দিষ্ট আকারে, যার থেকে একটি যথাযথ, নির্দিষ্ট ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব হয়েছে— আগের সমস্ত বিপ্লবই রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও নিখুঁত করেছে, অথচ তাকে ভাঙা এবং চূর্ণ করাটাই জরুরি।

এই সিদ্ধান্তটাই হল রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্ক্সীয় তত্ত্বের মূল ও প্রধান কথা। এবং ঠিক এই মূল সিদ্ধান্তটাকেই প্রভাবশালী সরকারি সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলি একেবারেই ভুলে গেছে, শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক কার্ল কাউটস্কি তাকে প্রকৃতপক্ষে বিকৃতও করেছেন (যা আমরা পরে দেখব)।

‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’-এ আমরা পাই ইতিহাসের একটি সাধারণ সার-সংক্ষেপ, যা আমাদের মানতে বাধ্য করে যে, রাষ্ট্র হল শ্রেণি শাসনের যন্ত্র এবং তার মধ্য দিয়ে আমরা এই অনিবার্য সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হই যে, সর্বহারা শ্রেণি প্রথমে রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার না করে, রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন না করে, ‘শাসক শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণির’ স্বার্থে পরিচালিত রাষ্ট্রের পরিণত না করে বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ করতে পারে না। এবং এই সর্বহারা শ্রেণির রাষ্ট্র তার বিজয়ের পর থেকেই ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হওয়ার পথে এগোতে শুরু করবে, কেন না যে সমাজে শ্রেণি বিরোধ নেই সেখানে রাষ্ট্র বাস্তবে নিষ্প্রয়োজন এবং তার অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব নয়। ইতিহাসের বিকাশের দিক থেকে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের জায়গায় সর্বহারা রাষ্ট্রের এই বদলটা কী ভাবে হবে, সে প্রশ্ন এখানে আলোচিত হয়নি।

১৮৫২ সালে মার্ক্স ঠিক এই প্রশ্নটাই তুলেছেন এবং তার জবাবও দিয়েছেন। তাঁর দর্শন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মার্ক্স ১৮৪৮-১৮৫১ সালের বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলির ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে তাঁর মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের মতো এখানেও মার্ক্সের তত্ত্ব বিশ্ব সম্পর্কে গভীর দার্শনিক উপলব্ধি ও ইতিহাসের সমৃদ্ধ জ্ঞানে উদ্ভাসিত অভিজ্ঞতার সার-সংকলন।

রাষ্ট্রের বিষয়টা এখানে রাখা হয়েছে সুনির্দিষ্ট রূপে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের, বুর্জোয়া-শাসনের জন্য অপরিহার্য রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্ভব ঐতিহাসিক দিক থেকে কী ভাবে ঘটল? কোন কোন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তা এগিয়েছে? বুর্জোয়া বিপ্লবের গতিপথে এবং নিপীড়িত শ্রেণিগুলির স্বাধীন কার্যকলাপের সামনে পড়ে তার বিবর্তনের রূপই বা কেমন? এই রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পর্কে প্রলেতারিয়েতের কর্তব্যই বা কী?

বুর্জোয়া সমাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসাবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রক্ষমতার উদ্ভব হয় স্বৈরতন্তে্রর পতনের যুগে। এই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান চরিত্র-বৈশিষ্ট্য দুটি—আমলাতন্ত্র ও স্থায়ী সৈন্যবাহিনী। এই দুটি প্রতিষ্ঠান বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে কী ভাবে হাজার হাজার সূত্রে জড়িয়ে রয়েছে, তা মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাঁদের রচনায় বার বার দেখিয়েছেন। প্রত্যেক শ্রমিকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেই এই যোগাযোগটি একেবারে ছবির মতো স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শ্রমিক শ্রেণি এই সংযোগকে চিনতে শেখে। সেই জন্যই যে মতবাদ এই সংযোগের অনিবার্যতাকে তুলে ধরে শ্রমিকরা অতি সহজেই তা আয়ত্ত করতে এবং গভীর ভাবে আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়। অন্য দিকে পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা হয় অজ্ঞতা ও অগভীর চিন্তা প্রক্রিয়ার বশে সে তত্ত্বকে অস্বীকার করে, নয় তো আরও অগভীরতার পরিচয় দিয়ে তা ‘সাধারণভাবেক্স স্বীকার করলেও উপযুক্ত কার্যকরী সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ভুলে যায়।

আমলাতন্ত্র ও স্থায়ী সৈন্যবাহিনী— এরা হল বুর্জোয়া সমাজের দেহে ‘পরজীবী’—যে পরজীবীর উদ্ভব সমাজের আভ্যন্তরীণ বিরোধাত্মক দ্বন্দ্ব থেকে এবং যা বুর্জোয়া সমাজকে ছিন্নভিন্ন করছে। এ এমন এক পরজীবী যা সমাজের জীবনীশক্তির সমস্ত প্রবাহকে রুদ্ধ করে রেখেছে। প্রতিষ্ঠিত সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলিতে এখন যে সব কাউটস্কিপন্থী সুবিধাবাদীদের প্রাধান্য, তাদের মতে রাষ্ট্রকে পরজীবী সত্ত্বা বলাটা একমাত্র এবং বিশেষ ভাবে নৈরাজ্যবাদীদেরই বৈশিষ্ট্য। বলাই বাহুল্য, যে সঙ্কীর্ণমনার দল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে ‘পিতৃভূমি রক্ষার’ নাম দিয়ে তাকে যুক্তিসঙ্গত ও মনোরম করে দেখানোর অভূতপূর্ব কলঙ্কে সমাজতন্ত্রকে টেনে নামিয়েছে, তাদের কাছে মার্ক্সবাদের এই রকম বিকৃতি খুবই সুবিধাজনক। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা বিকৃতিই।

সামন্ততন্ত্রের পতনের সময় থেকে ইউরোপ যতগুলি বুর্জোয়া বিপ্লব দেখেছে, তার সবকটির মধ্য দিয়েই চলেছে এই আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক যন্ত্রটার বিকাশ, পূর্ণতাসাধন, শক্তিবৃদ্ধির কাজটি। বিশেষ করে পেটিবুর্জোয়ারা এই যন্ত্রটির মারফত বহুল পরিমাণে বৃহৎ বুর্জোয়াদের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং এর দৌলতেই তারা তাদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। কৃষক, ছোট কারিগর ও ব্যবসায়ী প্রভৃতিদের উপরের স্তরটাকে এই রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণের ওপরওয়ালা হবার মতো অপেক্ষাকৃত আরামপ্রদ, নির্ঝঞ্ঝাট ও সম্মানীয় কাজ দিয়ে থাকে। ১৯১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ছক্সমাস জুড়ে রাশিয়ায় কী হয়েছে দেখুন— যেসব সরকারি পদ আগে পেত প্রধানত ব্ল্যাক হান্ড্রেডরা (জারের গুপ্তচর বাহিনী), এখন সেই সব পদ কাদেত, মেনশেভিক ও সোসালিস্ট রেভলিউশনারিদের লুটের মাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও গুরুতর সংস্কার চালুর কথা কেউই ভাবছে না। এ সংক্রান্ত সমস্ত গুরুতর প্রচেষ্টাকেই চেষ্টা করা হয়েছে ‘সংবিধান সভা পর্যন্ত মুলতুবি রাখার, আর ‘সংবিধান সভাটি’ মুলতুবি রাখার চেষ্টা হয়েছে যত দিন না যুদ্ধ শেষ হচ্ছে, তত দিন। কিন্তু লুঠের বখরায় মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, গভর্নর জেনারেল ইত্যাদির লোভনীয় পদগুলি দখলে কিন্তু দেরি হয়নি, এবং কোনও সংবিধান সভার জন্য অপেক্ষাও করা হয়নি। সারা দেশ জুড়ে ওপরতলা থেকে নিচের তলা পর্যন্ত সমস্ত কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনিক দপ্তরে ‘লুঠের’ এই যে বণ্টন ও পুনর্বণ্টন চলছে, সরকার গঠন নিয়ে জোট বাঁধাবাঁধির খেলাটাও মূলত কেবল তারই অভিব্যক্তি। ১৯১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭ আগস্ট এই ছ’মাসের বাস্তব যোগফলঃ সংস্কার মুলতুবি হয়েছে, পদগুলি বণ্টিত হয়েছে, এবং বণ্টনের ‘ভুলত্রুটি শোধরানো হয়েছে কিছু ক্ষেত্রে পুনর্বণ্টন করে’।

কিন্তু বিভিন্ন বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া পার্টির মধ্যে (রুশ দৃষ্টান্ত ধরলে কাদেত, সোসালিস্ট রেভলিউশনারি ও মেনশেভিকদের মধ্যে) আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রটার ‘পুনর্বণ্টন’ যত বেশি চলতে থাকে, সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে চলা নিপীড়িত শ্রেণিগুলির কাছে সমগ্র বুর্জোয়া সমাজের সঙ্গে তাদের অনিরসনীয় বিরোধের চিত্রটা ততই পরিষ্কার হয়ে যায়। এর জন্যই বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ বাড়ানো এবং দমনের হাতিয়ার অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে শক্তিশালী করে তোলা সমস্ত বুর্জোয়া পার্টি এমনকি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ও ‘বিপ্লবী গণতান্ত্রিক’ দলগুলির কাছে আবশ্যক হয়ে পড়ে। ঘটনাবলির এই গতিমুখের ফলেই বিপ্লব বাধ্য হয় রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে ‘ধবংসের সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করতেক্স, রাষ্ট্রযন্ত্রটার উন্নয়ন নয়, তার ধ্বংস, তার সংহারকে কর্তব্য বলে গ্রহণ করতে।

নিছক যুক্তি-তর্ক নয়, ঘটনাবলির বাস্তব বিকাশ, ১৮৪৮-৫১ সালের জীবন্ত অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বিপ্লবের এই কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার এই বাস্তব জমিটাকে মার্ক্স কতটা কঠোরভাবে অনুসরণ করেছেন তা আরও পরিষ্কার হয় যখন দেখি, রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে ধ্বংস করা হবে, তার জায়গায় কী আসবে— এ প্রশ্নটাকে তিনি ১৮৫২ পর্যন্ত নির্দিষ্ট ভাবে বলেননি। আসলে বাস্তব অভিজ্ঞতা বিষয়টা বিচার করার মতো মালমশলার জোগান তখনও দেয়নি। ইতিহাস সে প্রশ্নকে প্রধান কর্তব্যকর্ম হিসেবে তুলে ধরেছিল পরে, ১৮৭১ সালে। ১৮৫২ সালে ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ ও তার যথার্থ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের সাহায্যে শুধু এটুকু বলা সম্ভব ছিল যে, সর্বহারা বিপ্লব যে স্তরে পৌঁছেছে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে ‘ধবংসের সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করার’, রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে ‘ভাঙার’ কর্তব্য সমাধা করার কথা ভাবতে হবে।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তগুলির যে সাধারণীকরণ মার্ক্স করেছেন সেটা ফ্রান্সের ১৮৪৮-১৮৫১ সাল— এই তিন বছরের ইতিহাসের চেয়ে ব্যাপকতর পরিধিতে প্রয়োগ করা কি ঠিক হবে? প্রশ্নটা বিচারের জন্য প্রথমে এঙ্গেলসের একটি মন্তব্য স্মরণ করার পর আমরা বাস্তব তথ্যে যাব। ‘আঠারোই ব্রুমেয়ার’-এর তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস লিখেছেন 

‘‘… ফ্রান্স এমন একটা দেশ, যেখানে শ্রেণিগুলির ঐতিহাসিক সংগ্রাম অন্য যে-কোনও দেশের তুলনায় প্রতিবারই একটা চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছেছে। যেসব পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক রূপের মধ্য দিয়ে এই শ্রেণিসংগ্রাম এগিয়েছে এবং যার মধ্য দিয়ে তার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে, তা ফ্রান্সেই সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ফ্রান্স। রেনেসাঁসের পর থেকে সামাজিক বর্গভেদের উপর ভিত্তি করে (বেসড অন সোসাল এস্টেটস) ঐক্যবদ্ধ রাজতন্ত্রের আদর্শ দেশও ছিল এই ফ্রান্স। মহান বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামন্ততন্ত্রকে চূর্ণ করে এমন স্পষ্টভাবে বুর্জোয়াদের বিশুদ্ধ প্রভুত্ব স্থাপনও ইউরোপের আর কোনও দেশে হয়নি। আবার ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে মাথা তোলা প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম এখানে যে তীব্র রূপ নিচ্ছে তাও অন্য দেশে অজ্ঞাত।’’ (৪ পৃঃ, ১৯০৭ সালের সংস্করণ।)

এখানে শেষের কথাটি অবশ্য কিছুটা পুরনো হয়ে পড়েছে, কারণ ১৮৭১ সালের পর থেকে ফরাসি সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রামে একটা বিরতি দেখা যাচ্ছে। যদিও সে বিরতি যত দীর্ঘই হোক, এই সম্ভাবনা তাতে এতটুকুও নাকচ করা যায় না যে, শ্রেণিসংগ্রামকে তার চূড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার চিরায়ত ঐতিহ্যশালী দেশ হিসেবে হয়তো আসন্ন প্রলেতারীয় বিপ্লবও ফ্রান্সেই আবার আত্মপ্রকাশ করবে।

এখন উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুর দিকের অগ্রণী দেশগুলির ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকানো যাক। সর্বত্রই আমরা দেখব ওই একই প্রক্রিয়া— কোথাও ধীরে, কোথাও অনেকখানি ক্ষেত্র জুড়ে ছড়িয়ে, বিচিত্ররূপে সংসদীয় শক্তির বিকাশ হয়েছে। এটা ঘটেছে একদিকে, যেমন প্রজাতান্ত্রিক দেশগুলিতে (ফ্রান্স, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড) তেমনি আবার রাজতন্ত্রী দেশগুলিতেও (ইংল্যান্ড, কিছুটা পরিমাণে জার্মানি, ইতালি, স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলি প্রভৃতি)। অন্য দিকে দেখতে পাব ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া ব্যবস্থার ভিত্তি না বদলিয়েও সরকারি গদির সুযোগে প্রাপ্ত ‘লুটের’ বণ্টন ও পুনর্বণ্টন করে বিভিন্ন বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া পার্টির মধ্যে ক্ষমতার সংগ্রাম এবং শেষপর্যন্ত ‘প্রশাসনিক ক্ষমতার’, তার আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক যন্ত্রটাকে দক্ষ ও সংহত করার চেষ্টা।

কোনও সন্দেহই নেই যে, এটা সাধারণভাবে সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেরই সাম্প্রতিক ক্রমবিকাশের সাধারণ রূপ। ১৮৪৮-১৮৫১ এই তিন বছরে দ্রুত, তীক্ষ্ম ও সংহতরূপে ফ্রান্স বিকাশের এই প্রক্রিয়াগুলিকেই দেখিয়েছে। এগুলি সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়ারই সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে ব্যাঙ্ক পুঁজির যুগ, অতিকায় একচেটিয়া পুঁজির যুগ। একচেটিয়া পুঁজিবাদ থেকে রাষ্ট্রীয়-একচেটিয়া পুঁজিবাদে বিকাশের এই যুগে দেখা যাচ্ছে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের’ এক অভূতপূর্ব শক্তিবৃদ্ধি। সরকারের রূপ সে রাজতান্ত্রিকই হোক, বা সর্বাধিক মুক্ত প্রজাতান্ত্রিক হোক না কেন—প্রলেতারিয়েতের বিরুদ্ধে দমন করার শক্তির ব্যাপারে আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক যন্ত্রের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি এখন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

বিশ্ব ইতিহাস আজ নিঃসন্দেহে এমন এক পরিণামের দিকে এগোচ্ছে যখন ১৮৫২ সালের তুলনায় অনেক ব্যাপক পরিসরে শ্রমিক-বিপ্লবের ‘সমস্ত শক্তি’ রাষ্ট্রযন্ত্র ধ্বংসের জন্য কেন্দ্রীভূত হবে। কী দিয়ে প্রলেতারিয়েত এই রাষ্ট্রযন্ত্রের বদল ঘটাবে সে বিষয়ে প্যারিস কমিউন থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে।   (চলবে)

ফুট নোট

১। ‘বৈধ রাজতন্ত্র’ ও ‘জুলাই-রাজতন্ত্র’

১৭৮৯ সালের প্রথম ফরাসি বিপ্লবের ফলে তদানীন্তন শাসক বুরবোঁ-বংশের সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের পতন হয়। ১৮১৪ সালে তদানীন্তন সম্রাট প্রথম নেপোলিয়নের পতনের পর এই বুরবোঁ-বংশ (দশম চার্লস) আবার ফ্রান্সের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৪ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত এই বুরবোঁ-বংশ ফ্রান্সে রাজত্ব করে। এই যুগকে বলা হয় (বুরবোঁ-বংশের) ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগ’। বুরবোঁ বংশের রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিল ফ্রান্সের বড়-বড় জমির মালিকরা। তাদের মতে বুরবোঁ-বংশই ছিল রাজ-সিংহাসনের বৈধ দাবিদার। তাই তাদের বলা হত ‘বৈধ রাজতন্ত্রের সমর্থক’, এবং ১৮১৪ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত বুরবোঁ-বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগকে ইতিহাসে বলা হয় ‘বৈধ রাজতন্ত্র’। ১৮৩০ সালের জুলাই মাসে এক বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ-বংশের পতন হয় এবং অরলেয়াঁ-বংশের লুই ফিলিপ সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হন। অরলেয়াঁ-বংশের রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিল ফ্রান্সের ব্যাঙ্ক-মালিক, ব্যবসায়ী প্রভৃতি ধনিকগোষ্ঠী। তাই তাদের বলা হয় ‘অরলেয়াঁ-বংশের রাজতন্ত্রের সমর্থক’। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বিপ্লবে লুই ফিলিপ ক্ষমতাচ্যুত হন, এবং ফ্রান্সে ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ ঘোষিত হয়। ১৮৩০ থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত লুই ফিলিপের এই রাজত্বকে বলা হয় ‘জুলাই-রাজতন্ত্র’।

২। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে বিপ্লব, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে বিপ্লব, আমেরিকায় স্বাধীনতা যুদ্ধ, উনবিংশ শতাব্দীতে সারা ইউরোপ জুড়ে (ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া) একের পর এক বিপ্লব।

৩। কাদেত। রাশিয়ার ‘নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রী দল’ নামে উদারনীতিক বুর্জোয়াদের এক দল। এই দলের সদস্যদের বলা হত ‘কাদেত’। জারের পতনের পর রাশিয়ায় যে প্রতিবিপ্লবী অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়, তাতে এরাই প্রধান অংশগ্রহণকারী। এরা ছিল শ্রমিক শ্রেণি ও বিপ্লবের বিরোধী।

গণদাবী ৭৬ বর্ষ ১৪ সংখ্যা ২৪ নভেম্বর ২০২৩