রাষ্ট্র ও বিপ্লব (১৭) —ভি আই লেনিন

বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার সপ্তদশ কিস্তি।

পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ

মার্ক্স আরও বলেছেনঃ ‘‘পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী সমাজের মধ্যে এক সমাজ থেকে আর এক সমাজের বিপ্লবাত্মক উত্তরণের জন্য একটা পর্যায় আছে। এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে একটা রাজনৈতিক উত্তরণকালীন পর্যায়ও আছে। এই পর্যায়ে রাষ্ট্র, সর্বহারার বিপ্লবী একনায়কত্ব ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।’’

বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে সর্বহারা শ্রেণির ভূমিকা, এই সমাজের বিকাশ সম্পর্কে নানা তথ্য এবং বুর্জোয়া ও সর্বহারার স্বার্থের অনিরসনীয় বিরোধাত্মক দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মার্ক্স এই সিদ্ধান্ত করেছিলেন।

আগে বিষয়টিকে এইভাবে উত্থাপন করা হতঃ মুক্তি অর্জন করতে হলে সর্বহারাকে বুর্জোয়াদের উৎখাত করতে হবে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে হবে এবং তাদের বিপ্লবী একনায়কত্ব কায়েম করতে হবে।

এখন এই প্রশ্নকে কিছুটা ভিন্ন ভাবে উত্থাপন করা হয়ঃ যে পুঁজিবাদী সমাজ সাম্যবাদের দিকে বিকশিত হচ্ছে, সেই পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণ ‘‘একটা রাজনৈতিক উত্তরণকালীন পর্যায়’’ ছাড়া অসম্ভব। এই পর্যায়ে রাষ্ট্র সর্বহারার বিপ্লবী একনায়কত্ব ছাড়া কিছু হতে পারে না।

তা হলে, এই একনায়কত্ব ও গণতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক কী?

আমরা দেখেছি, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো দুটো ধারণা একেবারে পাশাপাশি রেখেছেঃ ‘‘সর্বহারা শ্রেণিকে শাসক শ্রেণির জায়গায় উন্নীত করা’’ এবং ‘‘গণতন্ত্রের লড়াইয়ে জয়লাভ করা’’। উপরে যা বলা হয়েছে তার ভিত্তিতে আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা সম্ভব পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র কী ভাবে পরিবর্তিত হয়।

পুঁজিবাদী সমাজ বিকাশের সবচেয়ে অনুকূল পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্তে্র আমরা মোটামুটি পূর্ণ গণতন্ত্র দেখতে পাই। কিন্তু এই গণতন্ত্র সবসময় পুঁজিবাদী শোষণের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই, বাস্তবে এই গণতন্ত্র হল সংখ্যালঘু শ্রেণির গণতন্ত্র, কেবলমাত্র সম্পত্তির মালিক শ্রেণির, ধনীদের গণতন্ত্র। প্রাচীন গ্রিক প্রজাতন্ত্রের যেমন স্বাধীনতা ছিল শুধু দাস মালিকদের জন্যই, পুঁজিবাদী সমাজেও স্বাধীনতা ঠিক তেমনই। আধুনিক মজুরি-দাসেরা পুঁজিবাদী শোষণের ফলে অভাব ও দারিদ্রের চাপে এতটাই পিষ্ট যে, ‘তারা গণতন্ত্রের কথা ভাবারই সময় পায় না’, ‘তারা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে না’। সাধারণ শান্তিপূর্ণ সময়ে জনসাধারণের অধিকাংশই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ করতে পারে না।

এই বক্তব্যের সঠিকতা সম্ভবত জার্মানি পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছে। কারণ ওই দেশে সাংবিধানিক কানুনি ব্যবস্থা একনাগাড়ে উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী হয়ে থেকেছে। সময়টা প্রায় পঞ্চাশ বছর (১৮৭১-১৯১৪)। এই সময়কালের মধ্যে জার্মানিতে সোসাল ডেমোক্রেসি ‘কানুনি ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে’ অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গিয়েছে। সেখানে তারা বিশ্বের যে কোনও দেশের তুলনায় শ্রমিকদের একটা বড় অংশকে রাজনৈতিক দলে সংগঠিত করতে পেরেছে।

পুঁজিবাদী সমাজে এই সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনীতি সচেতন শ্রমিক ও সক্রিয় মজুরি-দাসের অনুপাতটি কেমন? দেড় কোটি শ্রমিকের মধ্যে সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য হল দশ লক্ষ! এই দেড় কোটির মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সংগঠিত তিরিশ লক্ষ!

অত্যন্ত অল্প সংখ্যক মানুষের জন্য, ধনীদের জন্য গণতন্ত্র–এই হল পুঁজিবাদী সমাজের গণতন্ত্র। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের কলাকৌশলগুলি খুব কাছ থেকে দেখলে আমরা সর্বত্র ভোট ব্যবস্থার ‘ক্ষুদ্র’– তথাকথিত ক্ষুদ্র খুঁটিনাটিগুলি দেখতে পাব (বাসস্থানের যোগ্য প্রমাণ, নারীদের বাদ দেওয়া ইত্যাদি)। প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের কায়দাকানুন, সভা-সমিতির ওপর বাস্তব বাধানিষেধ (সরকারি বিল্ডিং ‘ভিখারিদের’ জন্য নয়!), পুরোপুরি পুঁজিবাদী রূপে সংগঠিত দৈনিক সংবাদপত্র, ইত্যাদি ইত্যাদির মধ্যে আমরা দেখতে পাব গণতন্ত্রের উপর চাপানো একটার পর একটা বিধিনিষেধ। এই সব বিধিনিষেধ, ব্যতিক্রম, একাংশকে বাদ দেওয়া, গরিবের জন্য বাধা সৃষ্টি করা তুচ্ছ মনে হয় বিশেষত তাদের চোখে, যারা দারিদ্র কী জিনিস জানে না, যারা এই নিপীড়িত শ্রেণির জনজীবনের সংস্পর্শে কখনও আসেনি (একশো ভাগের মধ্যে নিরানব্বই ভাগ না হলেও, অন্তত দশ ভাগের নয় ভাগ বুর্জোয়া প্রকাশক ও রাজনীতিবিদ এই স্তরের)। কিন্তু সব বাধার সামগ্রিক যোগফল হল তা দরিদ্র মানুষকে রাজনীতি থেকে, গণতন্ত্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে একেবারে বাদ দিয়ে দেয়, এর থেকে তাদের বহিষ্কার করে।

মার্ক্স কমিউনের অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের এই মর্মবস্তুকে চমৎকারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কয়েক বছর অন্তর অন্তর শোষিত মানুষকে অনুমতি দেওয়া হয় বেছে নিতে যে, তাদের প্রতিনিধি হিসাবে শোষক শ্রেণির কোন কোন বিশেষ প্রতিনিধি তাদের উপর নিপীড়ন চালাবে!

কিন্তু অবশ্যম্ভাবীরূপে এই পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সুকৌশলে দরিদ্র মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই, এই গণতন্ত্র ভণ্ডামিতে পূর্ণ, আপাদমস্তক মিথ্যাচারে ভরা। এই গণতন্ত্রের অগ্রগতির বিষয়ে লিবারাল পণ্ডিত ও পেটি বুর্জোয়া সুবিধাবাদীরা আমাদের যা বিশ্বাস করাতে চায়, তা তেমনভাবে সরল, সোজাসুজি, বিনা বাধায় ‘‘আরও বৃহত্তর গণতন্ত্রের’’ দিকে এগিয়ে যায় না। না, তার সামনের দিকে অগ্রগতি, অর্থাৎ কমিউনিজমের দিকে এগিয়ে যাওয়া, তা একমাত্র সর্বহারা একনায়কত্বের মাধ্যমেই ঘটতে পারে। অন্য কোনও ভাবে এ কাজ হতে পারে না, কারণ, অন্য কারও পক্ষে, অন্য কোনও ভাবে পুঁজিবাদী শোষকদের প্রতিরোধ চূর্ণ করা সম্ভব নয়।

সর্বহারার একনায়কত্ব, অর্থাৎ নিপীড়ক শ্রেণিকে দমন করার উদ্দেশ্যে শাসক হিসাবে সংগঠিত নিপীড়িত শ্রেণির অগ্রগামী বাহিনীর জন্ম নিছক গণতন্ত্রকে সম্প্রসারিত করার মধ্য দিয়েই হতে পারে না। সর্বহারা একনায়কত্ব গণতন্ত্রের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটায়, যা হয়ে ওঠে দরিদ্রের জন্য সর্বপ্রথম গণতন্ত্র, হয়ে ওঠে জনগণের জন্য প্রথম গণতন্ত্র। একই সাথে তা নিপীড়ক, শোষক, পুঁজিপতিদের স্বাধীনতার ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ অরোপ করে। এই গণতন্ত্র ধনীদের জন্য নয়। মজুরি দাসত্ব থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার জন্য আমাদের শোষকদের দমন করতেই হবে, বলপ্রয়োগের দ্বারা তাদের প্রতিরোধকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে হবে। এ কথা পরিষ্কার, যেখানে দমন পীড়ন আছে, যেখানে বলপ্রয়োগ আছে, সেখানে কোনও স্বাধীনতা নেই, সেখানে কোনও গণতন্ত্র থাকতে পারে না।

বেবেলকে লেখা চিঠিতে এঙ্গেলস এ কথা খুব সুন্দরভাবে বলেছেন। পাঠকরা স্মরণ করতে পারবেন, তিনি বলেছেন, ‘‘সর্বহারা শ্রেণি স্বাধীনতার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে না। তারা রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে তাদের বিরোধীদের দমন করার জন্য। স্বাধীনতার কথা তখনই বলা সম্ভব হবে, যখন রাষ্ট্র বলতে কিছু থাকবে না।’’

বিপুল পরিমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য গণতন্ত্র এবং জনগণের শোষক ও নিপীড়কদের সবলে দমন করা, অর্থাৎ গণতন্ত্র থেকে তাদের বের করে দেওয়া, পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে যাওয়ার উত্তরণের পর্যায়ে গণতন্ত্রকে এই ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

একমাত্র সাম্যবাদী সমাজেই, যখন পুঁজিপতিদের প্রতিরোধ সম্পূর্ণরূপে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া গেছে, যখন পুঁজিপতিদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়েছে, যখন কোনও শ্রেণির অস্তিত্ব নেই (অর্থাৎ সামাজিক উৎপাদন-উপকরণের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমাজের সদস্যদের মধ্যে যখন কোনও পার্থক্য নেই), একমাত্র তখনই ‘রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়’। একমাত্র তখনই ‘স্বাধীনতার কথা বলা সম্ভব।’ একমাত্র তখনই, সত্যিকারের পূর্ণ গণতন্ত্র, কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই গণতন্ত্র সম্ভব হবে ও তা বাস্তবে অর্জন করা যাবে। আর একমাত্র তখনই গণতন্ত্র বিলীন হয়ে যেতে শুরু করবে। তার কারণটা সরল– পুঁজিবাদের দাসত্ব, অবর্ণনীয় বিভীষিকা, বর্বরতা, মূঢ়তা, কলঙ্কজনক জীবনের হাত থেকে মুক্ত জনগণ সমাজ জীবনের প্রাথমিক নিয়মগুলি পালনে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এই সব রীতিনীতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জানা আছে, হাজার হাজার বছর ধরে পাণ্ডুলিপিতে, প্রবাদ প্রবচনে তা বার বার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। জনসাধারণ এগুলি পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে কোনও বলপ্রয়োগ, বাধ্যবাধকতা, অধীনতা ছাড়াই। এই সব রীতিনীতি পালনে বাধ্য করার জন্য রাষ্ট্র নামে অভিহিত বলপ্রয়োগের বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন আর থাকবে না।

‘রাষ্ট্র বিলীন হয়ে যাবে’, এই প্রকাশভঙ্গি খুব সুন্দরভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ, এর মধ্য দিয়ে ওই প্রক্রিয়াটির পর্যায়ক্রমিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত উভয় দিককেই বোঝানো হয়েছে। একমাত্র অভ্যাসের শক্তিই এই ধরনের প্রভাব খাটাতে পারে এবং নিঃসন্দেহে তা করবেই। আমরা আমাদের চারপাশে লক্ষ বার দেখতে পাই, শোষণ না থাকলে, ক্ষোভ-ঘৃণা উদ্রেকের কোনও বিষয় না থাকলে, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের জন্ম দেওয়া এবং তা দমন করার প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এমন কারণ না থাকলে কত সহজেই মানুষ সামজিক জীবনের আদানপ্রদানের প্রয়োজনীয় নিয়মগুলি মানতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

সুতরাং, পুঁজিবাদী সমাজে আমরা পাই খণ্ডিত, ঘৃণ্য, নকল গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র শুধু ধনীর জন্য, শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের মানুষের জন্য। এই প্রথম সর্বহারা একনায়কত্ব, সাম্যবাদে উত্তরণের পর্যায়ে জনগণের জন্য, অধিকাংশ মানুষের জন্য গণতন্ত্রের জন্ম দেবে। একই সাথে তা সমাজে সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ শোষকদের প্রয়োজনীয় দমন পীড়ন করবে। সাম্যবাদই একমাত্র যথার্থ পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র দিতে পারে। এবং গণতন্ত্র যত পূর্ণাঙ্গ হতে থাকবে ততই তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে এবং নিজে নিজেই বিলীন হয়ে যাবে।

অন্য কথায় বলতে গেলে, পুঁজিবাদে যথার্থ অর্থে রাষ্ট্র আছে। অর্থাৎ, এক শ্রেণির হাতে অন্য শ্রেণিকে দমনের বিশেষ যন্ত্র, সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠকে দমনের যন্ত্র পুঁজিবাদেই আছে। স্বাভাবিকভাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষকে নিয়মিতভাবে দমন করে চলার মতো একটা কাজ সাফল্যের সাথে করার জন্য সংখ্যালঘিষ্ঠ শোষক শ্রেণির প্রয়োজন হয় প্রবল নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা। তার জন্য যে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, দাসত্ব, ভূমি দাসত্ব ও মজুরি দাসত্বের জীবনে মানব-জাতি তার মধ্য দিয়ে চলতেই বাধ্য হয়েছে।

আবার, পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের কালে দমন পীড়নের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত সংখ্যালগিষ্ঠ শোষককে দমন করে। একটা বিশেষ দমনের যন্ত্র, ‘রাষ্ট্র’ এখানেও প্রয়োজন। কিন্তু এই রাষ্ট্র এখন আছে উত্তরণকালীন পর্যায়ে। যথার্থ অর্থে একে এখন আর রাষ্ট্র বলা যায় না। কারণ গতকালও যারা ছিল মজুরি দাস সেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা সংখ্যালঘু শোষককে দমনের বিষয়টা তুলনামূলকভাবে এতটাই সহজ, সরল ও স্বাভাবিক একটা কাজ যে, এই দমনের জন্য যতটুকু রক্তপাতের প্রয়োজন হয় তা দাস, ভূমিদাস বা মজুরি দাসদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য প্রয়োজনীয় রক্তপাতের তুলনায় অনেক কম। এর জন্য মানব জাতিকে মূল্য দিতে হয় অনেক কম। জনগণের অধিকাংশের জন্য সম্প্রসারিত গণতন্ত্রের সাথে এ সঙ্গতিপূর্ণ। এর ফলে দমনের যন্তে্রর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যেতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, জনগণকে দমনের জন্য জন্য প্রয়োজনীয় অত্যন্ত জটিল দমন যন্ত্রের অভাবে শোষকরা এই কাজ করতে পারে না। কিন্তু জনগণ একেবারে সাধারণ যন্ত্রের সাহায্যে, এমনকি প্রায় কোনও বিশেষ দমন যন্ত্র ছাড়াই, শোষকদের দমন করতে পারে। তখন তার দরকার হয় সশস্ত্র জনগণের সরল একটা সংগঠন (আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে পারি, যেমন ধরুন, শ্রমিক সৈনিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সোভিয়েত)।

সব শেষে, একমাত্র সাম্যবাদই পারে রাষ্ট্রকে পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় করে ফেলতে। কারণ, এখন দমন করার মতো কেউ নেই। ‘কেউ’ বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে একটা শ্রেণিকে, বোঝানো হচ্ছে জনগোষ্ঠীর একটা নির্দিষ্ট অংশের বিরুদ্ধে সুসংবদ্ধ সংগ্রামকে। আমরা কল্পনাবিলাসী নই। কোনও ব্যক্তি যথেচ্ছাচার করতে পারে, বা তাঁর এই যথেচ্ছাচারকে দমন করার প্রয়োজনের সম্ভাবনাকে আমরা একেবারেই অস্বীকার করছি না। কিন্তু প্রথমত, এর জন্য কোনও বিশেষ দমনের যন্ত্র প্রয়োজন হবে না। যেমন করে, আজকের এই আধুনিক সমাজে দু-জন লোককে হাতাহাতি করতে দেখলে একদল সুসভ্য লোক তাদের ছাড়িয়ে দেন, বা একজন মহিলার লাঞ্ছনা তারা প্রতিহত করে, সেভাবেই সশস্ত্র জনগণই এই কাজটা করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, আমরা জানি, এই যথেচ্ছাচার, সমাজ জীবনের নিয়ম লঙ্ঘনের রূপে যার প্রকাশ ঘটে, তার মৌলিক সামাজিক কারণ হল, জনগণের উপর শোষণ, তাদের অভাব ও দারিদ্র্য। এই মূল কারণটা যদি দূর করা যায়, তাহলে এই যথেচ্ছাচারও ‘বিলীন হয়ে যেতে’ শুরু করবে। আমরা জানি না কত দ্রুত এবং কোন ক্রম অনুযায়ী তা লোপ পাবে। এই সব বিলীন হওয়ার সাথে সাথে রাষ্ট্রও বিলুপ্ত হবে।

এই ভবিষ্যতকে এখন যে সংজ্ঞায় চিহ্নিত করা যায়, কল্পনাবিলাসকে আমল না দিয়ে মার্ক্স যাকে আরও পরিপূর্ণরূপে সংজ্ঞায়িত করেছেন, তা হল, সাম্যবাদী সমাজের নিচের স্তর ও উপরের স্তরের মধ্যেকার পার্থক্য। (চলবে)