রাষ্ট্র ও বিপ্লব (১৩)—ভি আই লেনিন

এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার ত্রয়োদশ কিস্তি।

আশু সুবিধার জন্য মূল দৃষ্টিভঙ্গি ভুলে যাওয়া হল সুবিধাবাদ

এরফুর্ট কর্মসূচির খসড়ার সমালোচনা

রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্ক্সবাদী শিক্ষাকে বিচার করতে গিয়ে এঙ্গেলস এরফুর্ট কর্মসূচির খসড়ার যে সমালোচনা করেছিলেন, তা অবহেলা করা যাবে না। এই সমালোচনা এঙ্গেলস কাউটস্কিকে পাঠিয়েছিলেন ১৮৯১ সালের ২৯ জুন। এর দশ বছর পর তা ‘নিউয়ে জেইট’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সমালোচনায় মূলত রাষ্ট্রকাঠামো সংক্রান্ত বিষয়ে সোসাল ডেমোক্রেসির সুবিধাবাদী মতামত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, আমাদের লক্ষ করা দরকার, অর্থনীতি সম্পর্কেও এঙ্গেলস অত্যন্ত মূল্যবান মতামত রেখেছিলেন। সেই সব মতামত আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে, আধুনিক পুঁজিবাদের মধ্যে যে নানা ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে, কত মনোযোগ দিয়ে, কত সুচিন্তিতভাবে এঙ্গেলস তা লক্ষ করেছিলেন। এই কারণে, বর্তমানের সাম্রাজ্যবাদী যুগে আমাদের কর্তব্য কী হবে তা তিনি কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাঁর মতামতটি এই রকম– খসড়া কর্মসূচিতে ‘পরিকল্পনাহীনতা’ বলে একটা শব্দ ছিল, বলা হয়েছিল এই পরিকল্পনাহীনতা হল পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য। এই শব্দটির উল্লেখ করে তিনি লিখেছেনঃ

‘যখন পুঁজিবাদ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে ট্রাস্টের দিকে যায়, তখন তা শিল্পের সমস্ত শাখাকেই একচেটিয়াকরণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। তখন শুধু ব্যক্তিগত উৎপাদন লোপ পায় না, পরিকল্পনাহীনতাও লোপ পায়।’ (নিউয়ে জেইট, খণ্ড ২০, ১ ১৯০১-০২, পৃষ্ঠা ৮)

এখানে আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা দেখতে পাচ্ছি, পুঁজিবাদের সর্বাধুনিক স্তরের, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী স্তরের তত্ত্বগত মূল্যায়ন। এখানে পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজিবাদে পরিণত হয়েছে। এই শেষ বিষয়টার উপর আমাদের বিশেষ জোর দিতে হবে, কারণ বুর্জোয়া সংস্কারবাদীরা জোরের সাথে এই ভ্রান্ত চিন্তা প্রচার করে যে, একচেটিয়া পুঁজিবাদ বা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, পুঁজিবাদই নয়। ওরা বলেন, একে ‘রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র’ বা ওই ধরনের কিছু একটা বলতে হবে। এই চিন্তা অনেক দূর ছড়িয়েগেছে। অবশ্য, ট্রাস্ট কখনওই পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা করতে পারেনি, এখনও করতে পারে না, করা তার পক্ষে সম্ভবও নয়। কিন্তু ওরা যতই পরিকল্পনা করুক, যতই পুঁজিবাদী বড়কর্তারা জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে আগাম হিসাবনিকাশ করুক, পরিকল্পনা করুক, যতই তারা ক্রমাগত তাকে নিয়ন্ত্রণ করুক, আমরা পুঁজিবাদের অধীনেই থাকব। এ কথা সত্য যে, এই পুঁজিবাদ নতুন স্তরের পুঁজিবাদ। কিন্তু তা নিঃসন্দেহে পুঁজিবাদই। পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের এই ‘নৈকট্য’ শ্রমিক শ্রেণির যথার্থ প্রতিনিধিদের পক্ষে সহায়ক। এই নৈকট্য দেখিয়ে তাঁরা প্রমাণ করতে পারবেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আসন্ন, তা আজ সহজ, সম্ভব ও কতটা জরুরি। এই নৈকট্যকে দেখিয়ে সংস্কারবাদীরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে। তারা পুঁজিবাদকে আরও মোহনীয় রূপে দেখাতে চায়। শ্রমিক শ্রেণির যথার্থ প্রতিনিধিদের এসব সহ্য করা উচিৎ নয়।

আসুন, আমরা রাষ্ট্রের প্রশ্নে ফিরে যাই। এই চিঠিতে এঙ্গেলস তিনটি মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিলেন। এক, প্রজাতন্ত্র প্রসঙ্গে, দুই, জাতীয় প্রশ্ন ও রাষ্ট্র কাঠামোর সম্পর্ক প্রসঙ্গে এবং তিন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে।

এরফুর্ট কর্মসূচির খসড়ার সমালোচনায় প্রজাতন্ত্রের প্রশ্নটিকে এঙ্গেলস সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু করেছিলেন। আমরা স্মরণ করতে পারি, এরফুর্ট কর্মসূচি বিশ্বের সমস্ত সোসাল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। সমগ্র দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে একে আদর্শ বলে মনে করা হত। অতিশয়োক্তি না করেও আমরা বলতে পারি, এই কারণেই এঙ্গেলস সমগ্র দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদের সমালোচনা করেছিলেন।

তিনি লিখেছিলেনঃ ‘খসড়ার রাজনৈতিক দাবিতে একটা বড় ভুল আছে। ঠিক যে কথাগুলি বলা উচিত ছিল, তা ওতে নেই।’

পরবর্তীকালে, তিনি পরিষ্কার করে বলেছিলেন, জার্মান সংবিধান ১৮৫০ সালের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল সংবিধানের নকল। ভিলহেলম লিবনেক্ট যেমন বলেছেন, রাইখস্ট্যাগ (জার্মান পার্লামেন্ট) ‘স্বৈরতন্ত্রের আবরণ মাত্র’। এঙ্গেলস আরও বলেন, যে সংবিধান ছোট ছোট রাষ্ট্র ও এই রকম রাষ্ট্রগুলির ভিত্তিতে তৈরি জার্মান ফেডারেশনকে আইনসঙ্গত করেছে সেই সংবিধানের মাধ্যমে ‘উৎপাদনের সমস্ত উপকরণকে জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত’ করার ইচ্ছা ‘স্পষ্টতই অবাস্তব’।

এঙ্গেলস ভাল করেই জানতেন, ওই কর্মসূচিতে জার্মানিতে প্রজাতন্ত্রের দাবি অন্তর্ভুক্ত করা আইনগত কারণেই অসম্ভব। তাই তিনি আরও বলেছেন, ‘অবশ্য, এই বিষয়টি বলতে যাওয়ার বিপদ আছে।’ কিন্তু ‘সকলেই’ যখন এটা অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন, তখন এঙ্গেলস তা মানতে অস্বীকার করছেন। তাই তিনি আবার বলছেনঃ ‘‘তবুও কোনও না কোনও ভাবে একে আক্রমণ করতে হবে। বর্তমানে, সোসাল ডেমোক্রেটিক পত্র-পত্রিকায় সুবিধাবাদ যে ভাবে ব্যাপকভাবে বাসা বেঁধেছে তা দেখে এর প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়। সমাজতন্ত্র বিরোধী আইন ফিরে আসতে পারে এই ভয় এদের গ্রাস করেছে। এই আইন চালু থাকার সময় করা আলটপকা উক্তিগুলির কথা ভেবে এরা ভীত। তাই এরা এখন বলছেন, জার্মানির আইনি ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্টির সমস্ত দাবি আদায় করা সম্ভব।’’

এঙ্গেলস যে মূল বিষয়টির ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন, তা হল, জার্মানির সোসাল ডেমোক্র্যাটরা সমাজতন্ত্র বিরোধী আইন ফিরে আসার ভয়ে ভীত। তিনি সুস্পষ্টভাবে একে সুবিধাবাদ বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি ঘোষণা করেন, যেহেতু জার্মানিতে কোনও প্রজাতন্ত্র ও স্বাধীনতা ছিল না, ঠিক এই কারণেই সেখানে ‘শান্তিপূর্ণ’ পথের স্বপ্ন একেবারেই অর্থহীন। এঙ্গেলস খুবই সতর্ক ছিলেন যাতে তাঁর হাত বাঁধা না পড়ে। তিনি স্বীকার করেছেন, প্রজাতান্ত্রিক বা অত্যন্ত স্বাধীন দেশগুলিতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়ার ‘কল্পনা করা’ (শুধুই কল্পনা!) যেতে পারে। কিন্তু জার্মানির ক্ষেত্রে তিনি পুনরায় বলেছেনঃ

‘‘জার্মানিতে, যেখানে সরকার প্রায় সর্বশক্তিমান এবং আইনসভা বা অন্যান্য প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের কোনও সত্যিকারের ক্ষমতা নেই, সেখানে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের ঘোষণা করার অর্থ হল, স্বৈরতন্ত্রের উপর থেকে আচ্ছাদন সরিয়ে নিয়ে তার নগ্নতা ঢাকতে নিজেকেই আবরণে পরিণত করা।’’

জার্মান সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অধিকাংশ নেতাই এই উপদেশকে বাক্সবন্দি করে রেখেছিলেন এবং তাঁরা যে স্বৈরতন্ত্রের আবরণ তা প্রমাণিত হয়েছিল।

‘‘এই ধরনের নীতি, শেষ পর্যন্ত নিজের দলকেই উচ্ছন্নের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাঁরা সাধারণ, বিমূর্ত রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে ঠেলে সামনে আনছিলেন। অথচ, যে সমস্ত বড় বড় ঘটনা, রাজনৈতিক সংকট প্রথম স্থানে আসা উচিত সেগুলিকে তাঁরা আড়ালে রাখছিলেন। এর ফল কী হতে পারে? এর ফল হতে পারে এটাই যে, একেবারে চূড়ান্ত নির্ণায়ক মুহূর্তে পার্টি হঠাৎ অসহায় হয়ে পড়ে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অস্পষ্টতা ও অনৈক্য দেখা দেয়। কারণ, এই সব বিষয় নিয়ে কখনও আলোচনা হয়নি।…

‘‘আশু সুবিধার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ মূল দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুলে যাওয়া, পরবর্তীকালে ফল কী হবে তা বিবেচনায় না রেখে, ক্ষণিকের সাফল্যের জন্য চেষ্টা ও লড়াই করা, বর্তমানের জন্য ভবিষ্যতের সংগ্রামকে জলাঞ্জলি দেওয়ার সত্যিকারের অর্থ হল সুবিধাবাদের মধ্যে ডুবে যাওয়া। ‘সৎ’ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হলেও তা সুবিধাবাদ ছাড়া কিছু নয়। আর বলা যেতে পারে ‘সৎ’ সুবিধাবাদ হল সবচেয়ে বিপজ্জনক।…’’

‘‘একটা বিষয় নিশ্চিত, একমাত্র গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মধ্যেই আমাদের দল ও শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতায় আসতে পারে। সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের এটাই হল বিশেষ রূপ। ফ্রান্সের মহান বিপ্লব তা ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে।’’

মার্ক্সের সমস্ত রচনার মধ্যে যে চিন্তা মর্মবস্তুর মতো অবস্থান করছে, এঙ্গেলস তা বিশেষভাবে জোরের সাথে পুনরাবৃত্তি করেছেন। এই ধারণাটি হল, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হল সেই ব্যবস্থা যার মধ্য দিয়ে সর্বহারা একনায়কত্বের অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। কারণ, এই ধরনের প্রজাতন্ত্রের পুঁজির শাসন বিন্দুমাত্র লোপ পায় না, তাই, জনগণের উপর নির্যাতন ও শ্রেণি সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী রূপে বেড়ে চলে। এই শ্রেণি সংগ্রাম প্রবল আকার ধারণ করে এমনভাবে বিকশিত, বিস্তৃত ও তীব্রতর হয় যে, নিপীড়িত জনগণের মূল স্বার্থগুলি চরিতার্থ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়া মাত্র অবশ্যম্ভাবী রূপে একমাত্র সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে শোষিত জনগণ কর্তৃক সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পুরো সময়কাল জুড়ে মার্ক্সের এই চিন্তাও ‘ভুলে যাওয়া কথায়’ পরিণত হয়েছিল। তাঁরা যে ভুলে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ বিস্তৃতভাবে প্রকাশ পেয়েছে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রথম ছয় মাসে,মেনশেভিক পার্টির ইতিহাসে।

যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র বা ফেডারেল রিপাবলিকে জনগণের জাতিগত গঠন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এঙ্গেলস লিখেছিলেনঃ ‘‘বর্তমান দিনের জার্মানির জায়গায় কী হওয়া উচিত?’’ (এর সংবিধান প্রতিক্রিয়াশীল ও রাজতান্ত্রিক এবং একই রকম প্রতিক্রিয়াশীল বিষয় হল ছোট ছোট রাষ্ট্রে এর বিভক্ত হয়ে থাকা। এই ধরনের বিভক্তি বিশেষ প্রুশীয় বৈশিষ্ট্যকে ধরে রেখে তাকে সমগ্র জার্মানির মধ্যে মিলে যেতে দেয় না।) ‘‘আমার মতে সর্বহারা শ্রেণি কেবলমাত্র এক ও অবিভাজ্য প্রজাতন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারে। বিশাল আয়তনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখনও পর্যন্ত মোটের ওপর একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র প্রয়োজন। যদিও পূর্ব দিকের রাষ্ট্রগুলিতে ইতিমধ্যেই তা বাধা হিসাবে কাজ করছে। ইংল্যান্ডে এই ব্যবস্থা একধাপ অগ্রগতির শামিল। কারণ, সেখানে দুটো দ্বীপে আছে চারটে জাতি। সেখানে একটি পার্লামেন্ট থাকা সত্ত্বেও আইন প্রণয়নের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা আজও পাশাপাশি কাজ করছে। ক্ষুদ্র দেশ সুইজারল্যান্ডে বহুদিন আগে থেকেই এই ব্যবস্থা বাধা হিসাবে থাকলেও তাকে সহ্য করা হচ্ছে, কারণ, ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুইজারল্যান্ড হল সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় সদস্য। জার্মানিতে সুইজারল্যান্ডের ধাঁচের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েমের অর্থ হবে পিছনের দিকে এক বিরাট লাফ। ছোট ছোট রাষ্টে্রর যুক্তরাষ্ট্র (ইউনিয়ন স্টেট) ও সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ (ইউনিটারি) রাষ্ট্রের মধ্যে দুটো বিষয়ে পার্থক্য আছে। এক, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিটি আলাদা রাষ্ট্রের, প্রত্যেকটি প্রদেশের নিজস্ব দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা এবং নিজস্ব বিচারব্যবস্থা আছে। দুই, একটা সরাসরি নির্বাচিত নিম্নকক্ষ (লোকসভা)-র পাশাপাশি, একটা রাজ্যসভাও (উচ্চকক্ষ) আছে। এই রাজ্যসভায় বিভিন্ন প্রদেশ ছোট হোক আর বড় হোক, প্রদেশ হিসাবে ভোট দেয়।

জার্মানিতে এই যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের পরিণত হওয়ার উত্তরণকালীন পর্যায়ে আছে। এবং ১৮৬৬ ও ১৮৭০ সালে ‘উপর থেকে যে বিপ্লব ঘটানো হয়েছে’ তাকে পিছনের দিকে ঠেলে না দিয়ে ‘নিচের দিক থেকে আন্দোলন’ করে অসমাপ্ত কাজটা শেষ করতে হবে।’’

রাষ্ট্রের রূপ সম্পর্কে এঙ্গেলস কোনওমতেই নিস্পৃহ থাকেননি। বরং তিনি বিপরীত কাজটাই করেছেন। অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তিনি রূপান্তরকালীন পর্যায়গুলিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তিনি সুনির্দিষ্ট, ঐতিহাসিক, বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট রূপান্তরকালীন পর্যায়ে কী থেকে কী সৃষ্টি হয়েছে তা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।

মার্ক্সের মতো এঙ্গেলসও সর্বহারা বিপ্লব ও সর্বহারা শ্রেণির দৃষ্টিতে ঘটনাকে বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা এবং এক ও অবিভাজ্য প্রজাতন্ত্রকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র হয় একটা ব্যতিক্রম এবং বিকাশের পথে বাধা, না হয়, রাজতন্ত্র থেকে কেন্দ্রীভূত প্রজাতন্ত্রের দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র একটা উত্তরণকালীন পর্যায়, কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে এক ধাপ ‘অগ্রগতি’। এই বিশেষ পরিস্থিতিগুলির মধ্যে তিনি জাতীয় প্রশ্নটিকে সামনে রেখেছেন।

মার্ক্সের মতো এঙ্গেলসও ক্ষমাহীন চিত্তে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের সমালোচনা করেছেন। কোনও কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে জাতীয় সমস্যার আবরণে যে রাষ্ট্রের এই প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র ঢেকে রাখা হয়, তারও সমালোচনা করেছেন। তা সত্ত্বেও মার্ক্স ও এঙ্গেলস কখনওই জাতীয় প্রশ্নকে এড়িয়ে চলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। হল্যান্ড ও পোল্যান্ডের মার্ক্সবাদীরা ‘তাঁদের’ ছোট ছোট রাষ্ট্রের কূপমণ্ডুক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রায়ই এমন ইচ্ছা প্রকাশ করে ফেলেন।

এমনকি ব্রিটেনের কথাই যদি ধরা যায়, সেখানকার ভৌগোলিক পরিস্থিতি, একই ভাষার উপস্থিতি, বহু শতাব্দীর ইতিহাস দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে জাতি সমস্যার প্রশ্নের ‘অবসান ঘটিয়েছে’ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এই ব্রিটেনেও যে জাতি সমস্যা আজও অতীতের বিষয় নয়, এঙ্গেলস এই সহজ বাস্তবকে মেনেছেন। এই যুক্তিতেই তিনি ব্রিটেনে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র গঠিত হলে ‘এক ধাপ অগ্রগতি’ হবে বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এঙ্গেলস যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনা পরিত্যাগ করেছিলেন বা ঐক্যবদ্ধ, কেন্দ্রীভূত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ়ভাবে প্রচার ও সংগ্রাম করেছিলেন, এর সামান্য ইঙ্গিত কোথাও পাওয়া যাবে না।

কিন্তু বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা, যাঁদের মধ্যে নৈরাজ্যবাদীরাও আছেন, যে ভাবে আমলাতান্ত্রিক অর্থে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাকে বুঝতেন, এঙ্গেলস সেই অর্থে তা বুঝতেন না। যে উদার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে কমিউন ও জেলাগুলো স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষা করে এবং সব ধরনের আমলাতন্ত্র ও উপর থেকে হুকুমদারির অবসান ঘটায়, এঙ্গেলসের কেন্দ্রিকতার ধারণা তার সামান্যতমও বিরোধী নয়। মার্ক্সবাদের রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণার কর্মসূচিগত দিককে বিকশিত করে এঙ্গেলস লিখেছিলেনঃ

‘‘তাই, একটা কেন্দ্রীভূত প্রজাতন্ত্র চাই। কিন্তু তা বর্তমান ফরাসি প্রজাতন্ত্রের মতো হলে চলবে না। কারণ, ১৭৯৮ সালে যে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা সম্রাটহীন সাম্রাজ্য ছাড়া কিছু নয়। ১৭৯২ সাল থেকে ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রতিটি বিভাগ, প্রতিটি কমিউন আমেরিকার মডেলে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। ঠিক এটাই আমাদের দরকার। কেমনভাবে স্বায়ত্তশাসন সংগঠিত করতে হবে, কেমনভাবে আমলাতন্ত্র ছাড়াই আমরা কাজ চালাতে পারি, তা প্রথমে আমেরিকা ও তারপর প্রথম ফরাসি প্রজাতন্ত্র দেখিয়েছে এবং এখনও তা দেখাচ্ছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের অন্যান্য উপনিবেশগুলো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই ধরনের রাজ্য (আঞ্চলিক) এবং কমিউনের মাধ্যমে পরিচালিত স্বায়ত্বশাসন সুইস প্রজাতন্ত্রর চাইতে অনেক বেশি স্বাধীন। এটা সত্য যে, এই ব্যবস্থায় বুন্দ-এর (অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র) সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে ক্যান্টন বা প্রদেশ অনেক বেশি স্বাধীন। একই সাথে প্রদেশ আবার জেলা ও কমিউনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও স্বাধীন। প্রাদেশিক সরকার জেলা গভর্নর ও প্রিফেক্টদের নিয়োগ করে। ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলিতে এই বৈশিষ্ট্য অজানা। আমাদের দেশেও ভবিষ্যতে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রুশিয়ার এই হুকুমদারি প্রথাকে আমাদের অবলুপ্ত করতে হবে (উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কমিশনার, জেলা পুলিশ প্রধান, গভর্নর, এবং সাধারণভাবে সমস্ত আমলা)।’’ তাই, কর্মসূচির স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ধারায় এঙ্গেলস এই প্রস্তাব দিয়েছেনঃ ‘‘সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রদেশ (গুর্বেনিয়া অঞ্চল) জেলা ও কমিউনের কর্মকর্তারা নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রনিযুক্ত সমস্ত স্থানীয় ও রাজ্যের আমলা পদ অবলুপ্ত করা হবে।’’

কেরেনস্কি ও অন্যান্য ‘সমাজতন্ত্রী’ মন্ত্রীরা প্রাভদার প্রকাশ নিষিদ্ধ করেছেন। আমি এই প্রাভদাতেই (সংখ্যা ৬৮, ২৮ মে ১৯১৭) ইতিমধ্যে দেখিয়েছি, এই দিক থেকে (শুধু এই দিকই নয়, সব দিক থেকে) কীভাবে আমাদের মেকি বিপ্লবী, মেকি গণতন্ত্রের মেকি সমাজতন্ত্রী প্রতিনিধিরা গণতন্ত্র থেকে লজ্জাজনকভাবে দূরে সরে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই, যারা সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সাথে ‘মৈত্রী বন্ধনে’ আবদ্ধ হয়েছেন, তাঁরা এই সমালোচনায় কান দেননি।

এ কথা লক্ষ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বিশেষভাবে পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের মধ্যে যে কুসংস্কার ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে, এঙ্গেলস তথ্যের ভিত্তিতে একেবারে সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে তা খণ্ডন করেছেন। এই কুসংস্কার হল, কেন্দ্রীয় প্রজাতন্ত্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের বেশি স্বাধীনতা আছে। এটা সত্য নয়। এঙ্গেলস ১৭৯২-’৯৮ সালে কেন্দ্রীভূত ফরাসি প্রজাতন্ত্র ও সুইজারল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের উদাহরণ দিয়ে এই ধারণা খণ্ডন করে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের তুলনায় যথার্থ গণতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীভূত প্রজাতন্ত্র অনেক বেশি স্বাধীনতা দিয়েছিল। অন্য কথায় বলতে গেলে, ইতিহাসে স্থানীয়, রাজ্যগত ও অন্যান্য স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি দিয়েছে কেন্দ্রীভূত প্রজাতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র নয়।

আমাদের প্রচার ও আন্দোলনে এই ঘটনার প্রতি আমরা যথেষ্ট মনোযোগ দিইনি, মনোযোগ দিচ্ছি না। মনোযোগ দিচ্ছি না যুক্তরাষ্ট্রীয় ও কেন্দ্রীভূত প্রজাতন্ত্র এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিও। (চলবে)

১। এরফুর্ট কর্মসূচি হল জার্মান সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টির ১৮৯১ সালে এরফুর্ট কংগ্রেসে গৃহীত কর্মসূচি। এই কর্মসূচি ছিল ১৮৭৫-এর গোথা প্রোগ্রামের তুলনায় একধাপ অগ্রগতি। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার স্থান অধিগ্রহণ করতে হবে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে–মার্ক্সের এই মতবাদ ছিল এরফুর্ট কর্মসূচির ভিত্তি। এখানে শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সংগ্রামের উপর জোর দেওয়া হয়, এই সংগ্রামের সংগঠক হিসাবে পার্টির ভূমিকার কথা বলা হয়। কিন্তু সর্বহারার একনায়কত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি।

২। ১৮৬৬-র অস্ট্রো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ ও ১৮৭০-এর ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এই দুই যুদ্ধে প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর জোরে ঐক্যবদ্ধ জার্মানি গঠিত হয়।