রাষ্ট্র ও বিপ্লব (১১) — ভি আই লেনিন

এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার একাদশ কিস্তি।

 

মার্ক্সের চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এঙ্গেলস

কমিউনের অভিজ্ঞতার তাৎপর্য প্রসঙ্গে মার্ক্স মৌলিক শিক্ষা তুলে ধরেছেন। এঙ্গেলস এই বিষয়ের আলোচনায় বারবার ফিরে এসেছেন, এ ব্যাপারে মার্ক্সের বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। কখনও কখনও এই প্রশ্নের অন্যান্য দিকের বিস্তৃত ব্যাখ্যাও তিনি এমন জোরালো ও স্পষ্ট ভাবে করেছেন যে, তাঁর ব্যাখ্যাকে আলাদাভাবে আলোচনা করা দরকার।

গৃহ সমস্যা

১৮৭২ সালে লেখা তাঁর ‘দি হাউজিং কোয়েশ্চেন’ গ্রন্থে এঙ্গেলস ইতিমধ্যেই কমিউনের অভিজ্ঞতাকে বিচার করেছিলেন এবং একাধিকবার রাষ্ট্র প্রসঙ্গে বিপ্লবের কর্তব্য কী হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। খুবই লক্ষণীয়, এই সুনির্দিষ্ট বিষয়ের আলোচনা একদিকে দেখিয়ে দিল, বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সাথে সর্বহারা রাষ্ট্রের মিল কোথায়, যা দুই রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। অন্য দিকে দেখাল, এদের মধ্যে পার্থক্য কোনখানে। আরও দেখাল রাষ্ট্রের ধ্বংসের পথে এই উত্তরণ হবে কী ভাবে।

‘‘তা হলে, গৃহ সমস্যার সমাধান হবে কী ভাবে? বর্তমান সময়ে এর উত্তর দেওয়া হয় এইভাবে, অন্য সব সামাজিক সমস্যার সমাধান হয় যে ভাবে– ক্রমান্বয়ে চাহিদা ও যোগানের অর্থনৈতিক সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে। এ এমন একটা সমাধান, যা বারবার নতুন করে একই সমস্যার জন্ম দেয়। তাই এটা কোনও সমাধানই নয়।সামাজিক বিপ্লব এই প্রশ্নের সমাধান কী ভাবে করবে তা শুধু বিশেষ সমস্যার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে না। এই সমস্যা অনেক সুদূরপ্রসারী প্রশ্নের সাথে যুক্ত। এর অন্যতম মৌলিক প্রশ্নটি হল, শহর ও গ্রামের বিরোধাত্মক সম্পর্কের অবসান হবে কী ভাবে। ভবিষ্যত সমাজের জন্য একটা কাল্পনিক ব্যবস্থা রচনা করা আমাদের কাজ নয়। সে সম্পর্কে আলোচনা করা তাই সময় নষ্ট। কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত, বড় বড় শহরে যথেষ্ট বাড়ি ইতিমধ্যেই আছে, যুক্তিসঙ্গত ভাবে তা ব্যবহার করলে এখনই ঘাটতি পূরণ করে গৃহ সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব। এই কাজ সহজে তখনই করা যাবে, যদি বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে বাড়িগুলো অধিগ্রহণ করে গৃহহীনদের এবং শ্রমিকরা যেখানে গাদাগাদি করে থাকে, সেই পুরনো ঘরগুলি থেকে তাদের এনে এই সব বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়। সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার ঠিক পরেই জনগণের স্বার্থে এই সব কাজ করতে পারে। ঠিক যেমন বর্তমান বুর্জোয়া রাষ্ট্র জনগণের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে সামরিক এবং অন্যান্য কাজে তা ব্যবহার করে।’’ (জার্মান সংস্করণ, ১৮৮৭, পৃষ্ঠা ২২)

রাষ্ট্রশক্তির রূপের নানা পরিবর্তনের কথা এখানে আমরা আলোচনা করছি না। আলোচনা করছি তার কাজের বিষয়বস্তু নিয়ে। বর্তমান রাষ্ট্রও হুকুম জারি করে সম্পত্তি দখল করে এবং তাকে সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করে। নিয়মতান্ত্রিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, সর্বহারা রাষ্ট্রও ঘর বাড়ি দখল করার নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু এ কথা পরিষ্কার দেখা যায়, বুর্জোয়া ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত পুরনো প্রশাসনযন্ত্র অর্থাৎ আমলাতন্ত্র সর্বহারা রাষ্ট্রের আদেশ পালনে একেবারেই অনুপযুক্ত।

‘‘যেটা বোঝা অবশ্যই দরকার, শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা শ্রমের সমস্ত উপকরণকে এবং কারখানাগুলোকে ‘যথার্থ অর্থে দখল করা’, আর প্রুধোঁর ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়া—এই দুটো বিষয় একেবারে পরস্পরের বিপরীত। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে শ্রমিক ব্যক্তিগতভাবে বাসস্থান, কৃষি ফার্ম, উৎপাদন উপকরণের মালিক হবে। আর প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে, ‘শ্রমজীবী জনগণ’ ঘরবাড়ি, কল-কারখানা এবং শ্রমের উপকরণের যৌথ মালিক হবে। আর অন্তত রূপান্তরের পর্যায়ে মূল্য উসুল না করে তা কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ঠিক যেমন, জমির উপর ব্যক্তি মালিকানা লোপ পাওয়া মানেই ভূমি করের অবলুপ্তি নয়, বরং পরিশীলিত রূপে তা সমাজকে হস্তান্তরিত করা। তাই শ্রমের সমস্ত উপকরণ কার্যকরীভাবে শ্রমজীবী জনগণের দখলে আসা মানেই তা কর-সম্পর্ক বাতিল হওয়া বোঝায় না। (পৃষ্ঠা ৬৮)

এই অনুচ্ছেদে আমরা রাষ্ট্রের বিলোপের অর্থনৈতিক ভিত্তির কথা শুধু উল্লেখ করেছি। এই বিষয়টা আমরা পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব। এঙ্গেলস খুব সতর্কভাবে বলেছেন, ‘অন্ততপক্ষে রূপান্তরের পর্যায়ে’ ভাড়া না নিয়ে সর্বহারা রাষ্ট্র প্রায় কাউকেই ঘর-বাড়ি ব্যবহার করতে দেবে না। যে সব ঘরবাড়ি সমগ্র জনগণের সম্পত্তি, তা ব্যক্তি পরিবারকে ব্যবহার করতে দিলে তা থেকে ঘর ভাড়া আদায় করতে হবে, তার উপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে এবং সেগুলি বণ্টনের একটা মাপকাঠিও ঠিক করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন একটা বিশেষ ধরনের রাষ্ট্র। কিন্তু তা অবশ্যই সেই বিশেষ সামরিক এবং আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রটা নয়, যেখানে উচ্চপদস্থ আমলারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করে। বিনা ভাড়ায় বাসস্থান দেওয়ার মতো পরিস্থিতির দিকে রূপান্তর নির্ভর করে আছে রাষ্ট্রের ‘সম্পূর্ণ বিলুপ্তির’ ওপর।

কমিউনের পরবর্তীকালে তার অভিজ্ঞতায় প্রভাবিত ব্ল্যাঙ্কিপন্থীদের মার্ক্সবাদীতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রশ্নে, বলতে গিয়ে এঙ্গেলস এই নিয়ম নীতির কথা বলেছেন–

‘‘শ্রেণির অবলুপ্তি ও সাথে সাথে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির জন্য উত্তরণের পর্যায়ে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব ও তার রাজনৈতিক সংগ্রাম প্রয়োজন’’ (পৃষ্ঠা ৫৫)।

চুলচেরা সমালোচনার নেশায় যারা মত্ত বা ‘মার্ক্সবাদের ধ্বংসকারী’ বুর্জোয়ারা সম্ভবত এই কথার মধ্যে একটা স্ববিরোধ দেখতে পাবেন। তাঁদের মতে যেটা স্ববিরোধ– উপরে উদ্ধৃত অ্যান্টি ডুরিং থেকে এই অনুচ্ছেদে একদিকে ‘রাষ্ট্রের অবলুপ্তির কথা’ বলা হয়েছে, অন্য দিকে এই তত্ত্বকে নৈরাজ্যবাদী বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, যদি আমরা দেখি সুবিধাবাদীরা এঙ্গেলসকেও নৈরাজ্যবাদী বলে চিহ্নিত করে বসে আছেন। কারণ, জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রীদের (সোসাল শভিনিস্ট) এখন একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে যে, তারা আন্তর্জাতিকতাবাদীদের ক্রমাগত বেশি বেশি করে নৈরাজ্যবাদী বলে অভিযুক্ত করছেন।

মার্ক্সবাদ সব সময় শিখিয়েছে, শ্রেণি বিলোপের সাথে সাথে রাষ্ট্রও অবলুপ্ত হবে। অ্যান্টি ডুরিং-এর ‘রাষ্ট্রের বিলুপ্তির’ বহুখ্যাত অনুচ্ছেদে, রাষ্ট্র বিলোপের কথা বলার জন্য নৈরাজ্যবাদীদের অভিযুক্ত করা হয়নি। রাষ্ট্র ‘রাতারাতি’ ধ্বংস হবে, এই কথা বলার জন্য নৈরাজ্যবাদীদের বিরোধিতা করা হয়েছে।

এটা বাস্তব, বর্তমানের সোসাল ডেমোক্র্যাটরা রাষ্ট্র বিলোপের প্রশ্নে মার্ক্সবাদের সাথে নৈরাজ্যবাদের সম্পর্ককে পুরোপুরি বিকৃত ভাবে দেখাচ্ছেন। তাই নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মার্ক্স-এঙ্গেলস কী ধরনের বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন তা স্মরণ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন।

নৈরাজ্যবাদীদের সাথে বিতর্ক

এই বিতর্ক হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। মার্ক্স ও এঙ্গেলস প্রুধোঁপন্থী, ‘স্বায়ত্তশাসনবাদী’ (অটোনমিস্ট) বা ‘কর্তৃত্ব-বিরোধী’দের (অ্যান্টি অথরিটারিয়ান) বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই সব প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল ইতালির একটা সমাজতান্ত্রিক বার্ষিক পত্রিকায়। ১৯১৩ সালের আগে এই সব প্রবন্ধ জার্মান ভাষায় নিউ জেইত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।

রাজনীতি পরিত্যাগ করার জন্য নৈরাজ্যবাদীদের ব্যঙ্গ করে মার্ক্স লিখেছেন, ‘‘শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সংগ্রাম বিপ্লবী রূপ ধারণ করলে, তারা বুর্জোয়া একনায়কত্বের জায়গায় সর্বহারার বিপ্লবী একনায়কত্ব কায়েম করলে, তারা নীতি লঙ্ঘন করার মারাত্মক অপরাধে অভিযুক্ত হয়। কারণ, তাদের দৈনন্দিন স্থূল বাস্তব প্রয়োজন মেটানোর জন্য, বুর্জোয়াদের প্রতিরোধ চূর্ণ করার জন্য, তাদের রাষ্ট্রকে একটা বিপ্লবী ও উত্তরণকালীন রূপ দিতে হয়। অস্ত্র নামিয়ে রেখে, রাষ্ট্রকে অবলুপ্ত করার কর্মসূচি গ্রহণ করলে তাদের চলবে না’’ (নিউ জেইত, সংখ্যা ৩২,১, ১৯১৩- ১৪,পৃষ্ঠা ৪০)।

নৈরাজ্যবাদীদের চিন্তাকে খণ্ডন করতে গিয়ে মার্ক্স রাষ্ট্রের ‘অবলুপ্তির’ এই ধরনটার বিরোধিতা করেছিলেন! শ্রেণি না থাকলে রাষ্ট্রও থাকবে না, বা শ্রেণি অবলুপ্ত হলে রাষ্ট্রও অবলুপ্ত হবে। মার্ক্স আদৌ এই চিন্তার বিরোধিতা করেননি। শ্রমিক শ্রেণি অস্ত্র ব্যবহার করবে না, সংগঠিত সশস্ত্র বলপ্রয়োগ করবে না, অর্থাৎ, যে রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের প্রতিরোধকে চূর্ণ করবে, সেই রাষ্ট্রকে ব্যবহার করবে না, মার্ক্স এই ধরনের তত্তে্বর বিরোধিতা করেছিলেন।

নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামকে যাতে কেউ বিকৃত করতে না পারে, এই জন্য মার্ক্স পরিকল্পনামাফিক সর্বহারা শ্রেণির যে রাষ্ট্র প্রয়োজন, সেই রাষ্ট্রের ‘বিপ্লবী ও উত্তরণকালীন রূপের’ উপর জোর দিয়েছিলেন। কিছু সময়ের জন্য সর্বহারা শ্রেণির রাষ্ট্র প্রয়োজন। লক্ষ্য হিসাবে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির প্রশ্নে নৈরাজ্যবাদীদের সাথে আমাদের আদৌ কোনও মতপার্থক্য নেই। আমরা মনে করি, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে, কিছু সময়ের জন্য আমাদের রাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে হবে, শোষকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির সমস্ত উপকরণ, শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। যেমন, শ্রেণি অবলুপ্তির জন্য শোষিত শ্রেণির একনায়কত্ব প্রয়োজন। এই একনায়কত্ব হবে সাময়িক। মার্ক্স নৈরাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায়, তীক্ষ্ণভাবে তাঁর বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন– পুঁজিবাদী জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার পর শ্রমিকরা কি তাঁদের ‘অস্ত্র নামিয়ে রাখবে’, নাকি পুঁজিপতিদের প্রতিরোধ চূর্ণ করার জন্য সেই অস্ত্র ব্যবহার করবে? কিন্তু, যদি উত্তরণকালীন রাষ্ট্র না থাকে তা হলে এক শ্রেণির বিরুদ্ধে অন্য শ্রেণি কেমন ভাবে সুপরিকল্পিত রূপে সেই অস্ত্র ব্যবহার করবে?

সমস্ত সোসাল ডেমোক্র্যাট নিজেদের প্রশ্ন করুক– নৈরাজ্যবাদীদের সাথে রাষ্ট্র সম্পর্কে বিতর্কে মার্ক্স কি বিষয়টিকে এই ভাবে আলোচনা করেছেন? দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অধিকাংশ নিয়মতান্ত্রিক সোসালিস্ট পার্টিগুলো কি বিষয়টিকে এইভাবে দেখছে?

এই একই চিন্তা এঙ্গেলস আরও বিস্তৃত রূপে, আরও সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সর্বপ্রথমে তিনি প্রুধোঁপন্থীদের ঘোলাটে চিন্তাকে ব্যঙ্গ করেছেন। এরা সব ধরনের কর্তৃত্ব, সব ধরনের অধীনতা, সব ধরনের শক্তিকেই অস্বীকার করে, নিজেদের সব ধরনের ‘কর্তৃত্ববাদ বিরোধী’ বলে অভিহিত করে। এঙ্গেলস বলেছিলেন, একটা কারখানা, একটা রেলওয়ে, গভীর সমুদ্রে একটা জাহাজের কথা ভাবুন। নানা ধরনের যন্ত্র ও অনেক মানুষের পরিকল্পিত সহযোগিতার ভিত্তিতে তৈরি এই জটিল যন্ত্রগুলোর একটাও নির্দিষ্ট ধরনের অধীনতা, নির্দিষ্ট ধরনের শক্তি বা কর্তৃত্ব ছাড়া কাজ করতে পারবে না, এটা কি পরিষ্কার নয়?

‘কট্টর’ কর্তৃত্ব-বিরোধীদের কাছে যখন আমি এই যুক্তি তুলে ধরি, তখন একটা জবাবই তাঁরা দিতে পারেন– হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু যে ধরনের কর্তৃত্ব আমরা আমাদের প্রতিনিধিদের হাতে অর্পণ করি, এখানে সেই ধরনের কর্তৃত্বের প্রশ্ন উঠছে না। এখানে আমরা অন্যকে দায়িত্ব দিচ্ছি। এইসব ভদ্রলোকেরা মনে করেন, নাম পাল্টে দিলে, জিনিসটাই পাল্টে যায়।

এইভাবে এঙ্গেলস দেখালেন, কর্তৃত্ব ও স্বায়ত্বশাসন– এই দুটো হল আপেক্ষিক শব্দ। সমাজের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে এদের প্রয়োগের ক্ষেত্র পাল্টে যায়। এদের চরম বলে মনে করা একেবারেই ভুল। এঙ্গেলস আরও দেখালেন, যন্ত্র ও বৃহদায়তন উৎপাদনের প্রয়োগের ক্ষেত্র ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। এর পর এঙ্গেলস কর্তৃত্ব সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা থেকে চলে গেলেন রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনায়। তিনি লিখেছেন,

‘‘… যদি স্বায়ত্তশাসনবাদীরা এই কথার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখত যে, ভবিষ্যতের সমাজ সংগঠন কর্তৃত্বকে তত দূর পর্যন্ত স্বীকার করবে, যত দূর পর্যন্ত উৎপাদনের শর্তগুলি তার সীমা নির্দিষ্ট করে দেবে, তা হলে তাদের সঙ্গে একটা বোঝাবুঝিতে আসা যেত। কিন্তু যে সব ঘটনা কর্তৃত্বকে আবশ্যক করে সেগুলি সম্পর্কে তারা অন্ধ এবং একবগ্গা ভাবে তারা এই শব্দটির বিরোধিতা করে।

‘‘কর্তৃত্ব-বিরোধীরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে না কেন? সমস্ত সমাজতন্ত্রীরা এই বিষয়ে একমত যে, আসন্ন সমাজবিপ্লবের ফলে রাষ্ট্র এবং তার সাথে রাজনৈতিক কর্তৃত্বও অবলুপ্ত হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, সরকারি কাজকর্ম তার রাজনৈতিক চরিত্র হারাবে, তা পরিণত হবে সামাজিক স্বার্থের তত্ত্বাবধায়ক সাধারণ প্রশাসনিক কাজকর্মে। কিন্তু কর্তৃত্ব-বিরোধীরা দাবি করে, রাজনৈতিক রাষ্ট্রকে এক ধাক্কায় অবলুপ্ত করতে হবে, এমনকি তা করতে হবে যে-সব সামাজিক সম্পর্কগুলি এই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, সেই সম্পর্কগুলি লোপ পাওয়ার আগেই। তারা দাবি করেন, সামাজিক বিপ্লবের প্রথম কাজই হবে কর্তৃত্বের অবসান ঘটানো।

‘‘এই সব ভদ্রমহোদয়েরা কি কখনও কোনও বিপ্লব দেখেছেন? সব কিছুর মধ্যে বিপ্লব অবশ্যই সবচেয়ে কর্তৃত্বমূলক বিষয়। এ এমন একটা কাজ, যেখানে সমাজের একটা অংশ রাইফেল, বেয়নেট ও কামানের সাহায্যে নিজেদের ইচ্ছা সমাজের অন্য অংশের উপর চাপিয়ে দেয়। এগুলি সবই প্রবল কর্তৃত্বকারী উপায়। এবং বিজয়ী দল প্রতিক্রিয়াশীলদের উপর তার আধিপত্য বজায় রাখে যে ভীতি সঞ্চারের মধ্যে দিয়ে, তা আসে তার অস্তে্রর শক্তির জোরে। প্যারিস কমিউন যদি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে তার সশস্ত্র জনগণের কর্তৃত্ব প্রয়োগ না করত, তা কি একদিনও টিকে থাকত? বরং সে কর্তৃত্ব বড়ই কম ব্যবহার করেছে বলে আমরা তাকে দোষারোপ করি না কি? তাই, এই দুটোর মধ্যে একটা– হয় কর্তৃত্ব-বিরোধীরা জানেন না তাঁরা কী নিয়ে কথা বলছেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁরা শুধু বিভ্রান্তিই তৈরি করছেন। অথবা, তাঁরা সবই জানেন, এবং সেই ক্ষেত্রে তাঁরা সর্বহারা শ্রেণির স্বার্থের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। এই দুই ক্ষেত্রেই তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের সেবা করছেন।’’ (পৃষ্ঠা ৩৯)

এই আলোচনা প্রসঙ্গে যে প্রশ্নগুলি উঠে এসেছে সেগুলির বিচার করতে হবে– রাষ্ট্রের বিলুপ্তির সময়ে (এই বিষয়টি পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা হবে) রাজনীতি এবং অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক কী দাঁড়ায়, তার পরিপ্রেক্ষিতে। প্রশ্নগুলি হলঃ সরকারি কাজের রাজনৈতিক প্রকৃতি লোপ পেয়ে সহজ সরল প্রশাসনিক কাজে রূপান্তর এবং ‘‘রাজনৈতিক রাষ্ট্র’’। এই শেষ যে কথাটি বিভ্রান্তি তৈরি করে, তা রাষ্ট্রের অবলুপ্তিরই ইঙ্গিত দেয়, যে, এই প্রক্রিয়ার একটা নির্দিষ্ট স্তরে রাষ্ট্র যখন অবলুপ্ত হতে থাকবে, তখন তাকে অরাজনৈতিক রাষ্ট্র বলা যেতে পারে।

আবার, এঙ্গেলস নৈরাজ্যবাদীদের বিরোধিতার বিষয়টিকে যে ভাবে উত্থাপন করেছেন, সেটিই হল এই বিতর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিশিষ্টতা।এঙ্গেলসের অনুগামী বলে দাবি করা সোসাল ডেমোক্র্যাটরা, ১৮৭৩ সালের পর থেকে নৈরাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লক্ষ বার এই বিষয়ে যুক্তি উত্থাপন করেছেন, কিন্তু মার্ক্সবাদীরা যে ভাবে যুক্তি উত্থাপন করে, বা তাঁদের যেভাবে তা উত্থাপন করা উচিত, তা তাঁরা করেননি। রাষ্ট্রের অবলুপ্তি বিষয়ে নৈরাজ্যবাদী ধারণাকে এঙ্গেলস অবিপ্লবী ও তালগোল পাকানো বলেই বলেছেন। মোট কথা, বিপ্লবের অগ্রগতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে হিংসা, কর্তৃত্ব, শক্তি, রাষ্ট্র ইত্যাদির সুনির্দিষ্ট ভূমিকা কী, তা নৈরাজ্যবাদীরা দেখতে চায় না।

আধুনিক সোসাল ডেমোক্র্যাটরা নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনাকে নির্ভেজাল কূপমণ্ডুক গতানুগতিকতায় নামিয়ে এনেছে– ‘‘আমরা বাপু রাষ্ট্রকে স্বীকার করি, নৈরাজ্যবাদীরা করে না!’’ স্বাভাবিক ভাবেই এই ধরনের তুচ্ছ সমালোচনা, যাঁরা বিপ্লবী ও যাদের চিন্তা করার সামান্য ক্ষমতা আছে, সেই সব শ্রমিকদের দূরেই ঠেলে দেয়। এঙ্গেলস একেবারে আলাদা কথা বলেছেন। তিনি এই সত্যের উপর জোর দিয়েছেন যে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে রাষ্ট্র অবলুপ্ত হবে, এ কথা সব সমাজতন্ত্রীই স্বীকার করে। তারপর তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বিপ্লবের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছেন– সোসাল ডেমোক্র্যাটরা তাদের সুবিধাবাদী চরিত্রের জন্য এই বিপ্লবের প্রশ্নটি এড়িয়ে যান, পরিত্যাগ করেন, বলতে গেলে, এর সমাধানের বিষয়টিকে তাঁরা নৈরাজ্যবাদীদের জন্যই ছেড়ে রেখেছেন। এবং প্রশ্নটি নিয়ে এঙ্গেলস যখন আলোচনা করেছেন তখন একেবারে তার ঝুঁটি চেপে ধরেছেন। বলেছেন, কমিউনের কি রাষ্ট্রের বিপ্লবী শক্তিকে, শাসক শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত সর্বহারার সশস্ত্র শক্তিকে, আরও জোরের সাথে ব্যবহার করা উচিত ছিল না?

বর্তমান দিনের নিয়মতান্ত্রিক সোসাল ডেমোক্রেসি বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণির সুনির্দিষ্ট দায়িত্বকে অবহেলায় উড়িয়ে দেয়। উড়িয়ে দেয় পণ্ডিত-মূর্খ তাচ্ছিল্যের সুরে, বা বড় জোর পরিশীলিত ঢঙে এড়িয়ে গিয়ে বলেঃ ‘‘অপেক্ষা করে দেখাই যাক না’’। ফলে এই প্রশ্নে নৈরাজ্যবাদীরা এই ধরনের সোসাল ডেমোক্রেসি সম্পর্কে এ কথা বলার সুযোগ পায় যে, ওরা শ্রমিকদের বিপ্লবী শিক্ষা দেওয়ার কর্তব্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। রাষ্ট্র ও ব্যাঙ্ক সম্পর্কে সর্বহারা বিপ্লবের কী করা উচিত এবং কী ভাবে করা উচিত, মূলত এই সুনির্দিষ্ট কর্তব্য নির্ধারণের জন্য এঙ্গেলস সর্বশেষ সর্বহারা বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন। (চলবে)