রাশিয়ায় প্রিগোঝিন কাণ্ড যুদ্ধেও আজ আউটসোর্সিং

ইউক্রেনের সঙ্গে দীর্ঘ সংঘর্ষের কারণে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে রাশিয়ার নাম দেখতে পাওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ রাশিয়ার একটা অন্য রকম খবরে মানুষের কৌতুহল তুঙ্গে উঠেছে। সঙ্গে জন্ম নিয়েছে নানা প্রশ্ন।

খবরে প্রকাশ, রাশিয়ার একটি বেসরকারি সামরিক বাহিনী ‘ওয়াগনার’-এর কর্তা ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন ২৩ জুন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। নিজের ভাড়াটে সেনাবাহিনী নিয়ে প্রিগোঝিন রাজধানী মস্কোর দিকে এগোতে থাকেন এবং ২৪ জুন রাজধানীর দুশো কিলোমিটারের কাছাকাছি পৌঁছে যান। শেষ পর্যন্ত বেলারুশের প্রেসিডেন্টের মধ্যস্থতায় পুতিনের সঙ্গে প্রিগোঝিনের একটা বোঝাপড়া হয় এবং সেনাদের নিরস্ত করে তিনি ফিরে যান।

প্রিগোঝিনের এই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে নানা প্রশ্ন উঠে আসছে– কে এই প্রিগোঝিন, কেন তাঁর এই বিদ্রোহ, কী করে তাঁর বাহিনী বিনা বাধায় মস্কোর কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারল, ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রশ্নগুলির সব উত্তর স্পষ্ট নয়। নানা সংবাদসংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নানা লেখা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। জানা গেছে, প্রথম জীবনে ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন খাবার সরবরাহ অর্থাৎ ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা করতেন। সেখান থেকে প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেকনজরে আসেন তিনি। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নানা ব্যবসা থেকে মুনাফা করতে করতে আজ তিনি রাশিয়ার একজন নামজাদা কর্পোরেট পুঁজিপতি। এই উত্থানের পিছনে রয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। ২০১৪ সালে একটি বেসরকারি সামরিক বাহিনী গঠনের কথা তাঁর মাথায় আসে। তৈরি হয় ‘ওয়াগনার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি’। শোনা যায়, সেইসময় রাশিয়ার ক্রিমিয়া অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ওয়াগনার। পরে ওয়াগনার অন্য দেশে রুশ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির পাহারাদার হিসাবে কাজ চালাতে থাকে। লিবিয়া ও মধ্য আফ্রিকার নানা দেশে রুশ কর্পোরেট পুঁজিপতিদের কেনা খনি সহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদ পাহারা দেওয়ার কাজ করে প্রিগোঝিনের পেশাদার ভাড়াটে সেনাবাহিনী। ওইসব দেশের ভিতরকার নানা সংঘর্ষেও মালিকের নির্দেশমাফিক যোগ দেয় তারা। এই ওয়াগনার সেনারা ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সাম্প্রতিক যুদ্ধেও নাকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ চালানোর সময়ে নানা প্রশ্নে রাশিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ওয়াগনারের বিরোধ বাধে। সেই বিরোধ মেটাতে প্রেসিডেন্ট পুতিন উদ্যোগী হননি বলে অনেকদিন ধরেই অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন প্রিগোঝিন। এই বিরোধেরই এক পর্যায়ে নিজের বাহিনী নিয়ে মস্কো অভিযানে নামেন তিনি। এ নাকি ছিল তাঁর ‘ন্যায়ের দাবিতে পদযাত্রা। অন্তত তাঁর নিজের বক্তব্য এমনই। যদিও রাশিয়ার বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির মতে, প্রিগোঝিনের এই অসমাপ্ত অভ্যুত্থানের পিছনে রয়েছে রাশিয়ার একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীগুলির নিজেদের ভিতরকার দ্বন্দ্ব। অনেকের মতে এই দ্বন্দ্বে কোনও একটি গোষ্ঠীর ‘বোড়ে’ হিসাবে কাজ করেছেন প্রিগোঝিন।

প্রিগোঝিনের মস্কো অভিযানের পিছনে কারণ যাই থাক, এই ঘটনা থেকে একটি সত্য সামনে চলে এল। দেখা যাচ্ছে, আজকের দিনে পুঁজিপতিরা শুধু ব্যাক-অফিস বা এই ধরনের কাজগুলি কম পয়সায় সারতে আউটসোর্সিং করে তাই নয়, যুদ্ধেও এখন চলে আউটসোর্সিং। আর্থিক ভাবে ক্রমাগত নিচের দিকে নামতে থাকা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সামগ্রিক ভাবে যখন মন্দার ছায়া, তখন যুদ্ধের এই আউটসোর্সিং আজকের দিনে পুঁজিপতিদের মুনাফার একটি চমৎকার উৎস হিসাবে নিজের জায়গা করেছে।

প্রিগোঝিনের ওয়াগনার কোম্পানি দেখিয়ে দিয়ে গেল, যুদ্ধ শুধু দেশের সেনাবাহিনী করে না, বেসরকারি মালিকরাও কোম্পানি খুলে যুদ্ধ করতে পাঠায় ভাড়াটে সেনাদের। বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে যে বিপুল টাকা মালিক পায়, ভাড়াটে সেনাদের পাওনা মেটাবার পরে তার একটা বড় অংশ মুনাফা হিসেবে থেকে যায় তার নিজের পকেটে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় হানাদারিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভাড়াটে সেনারা কীভাবে অত্যাচার চালিয়েছিল, মানুষের তা মনে আছে।

অর্থাৎ যুদ্ধের সঙ্গে আজ আর দেশরক্ষার তাগিদ তথা দেশপ্রেম জড়িয়ে নেই। এ এখন এক লাভদায়ক ব্যবসা। সেনাদের প্রাণ, তাদের ঘাম-রক্ত নিয়ে ব্যবসা করে মুনাফা লোটে প্রিগোঝিনের মতো যুদ্ধ-ব্যবসার মালিকরা। আর হতভাগ্য বেকার তরুণ-যুবকের দল রোজগারের তাগিদে, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার বাধ্যতায় প্রাণ বাজি রেখে নাম লেখায় ওয়াগনারের মতো সেনা-কোম্পানিতে। যুদ্ধ শেষ হতে হতে ঝরে যায় কত না জীবন। আর যারা ঘরে ফেরে, কেউ পঙ্গু হয়ে, কেউ বিনা-কারণে মানুষ-মারার গ্লানিতে ভেতরে ভেতরে মরে গিয়ে অভিশাপ দিতে থাকে এই সমাজকে, ‘পুঁজিবাদী সভ্যতা’ নামের এই অসভ্যতাকে।

মনে পড়ে যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। এই রাশিয়া তখন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। মহান স্ট্যালিনের প্রেরণায় গোটা দেশের প্রতিটি মানুষ প্রাণপণ লড়াই করে বিশ্বকে মুক্ত করেছিল মানবসভ্যতার জঘন্যতম শত্রু হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাত থেকে। গোটা দুনিয়া জুড়ে দেশপ্রেম ও বীরত্বের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনী ‘লালফৌজ’। সেই ঐতিহাসিক অসমসাহসী লড়াইয়ে ব্যক্তিগত মুনাফার কোনও ভাবনাও ছিল না। ছিল বর্বর ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করে সভ্যতা রক্ষার দুর্নিবার আকাঙক্ষা। আজ পচা-গলা অবক্ষয়িত সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ায় লালফৌজের জায়গা দখল করেছে ওয়াগনার সেনা কোম্পানি। আস্ফালন করছে মুনাফা-লুটেরা প্রিগোঝিনরা, সমাজতন্ত্র ভেঙে দিয়ে দেশের সম্পদের দখল নিয়ে ধনকুবের বনে যাওয়া পুতিনরা।