রাম মন্দির উদ্বোধনঃ আজ যদি বেঁচে থাকতেন মাধব গোডবোলে!

আজ যদি বেঁচে থাকতেন নিষ্ঠাবান হিন্দু মাধব গোডবোলে!

চাকরির সূত্রে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯২, অর্থাৎ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৩ দিন পর তাঁকে অযোধ্যা যেতে হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে। কারণ মসজিদ ভাঙার পর রামলালা দর্শনের ব্যবস্থাপনা কতটা তৈরি তা পরিদর্শনের দায়িত্ব ছিল তাঁর। তিনি পরবর্তীকালে তাঁর বই ‘আনফিনিশড ইনিংস’-এ সে দিনের স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, ‘সেদিন আমি আগের মতো রামলালা দর্শন করার ইচ্ছা অনুভব করিনি, প্রসাদও নিতে পারিনি। যদিও আমি একজন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ, তবুও সেদিন অযোধ্যায় আমি কোনও টান অনুভব করিনি। মন থেকে অনুভব করেছি শঠতা, প্রতারণা আর ভয়াবহ হিংসার জোরে তৈরি মন্দিরে আমার দেবতা বাস করতে পারেন না’।

এখন সেই জায়গাতেই প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে ঘটতে চলেছে নতুন রামমন্দিরের উদ্বোধন। তা নিয়ে বিজেপি দেশজোড়া হইচই তুলছে।কিন্তু ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষ তাতে কী দেখছেন? তাঁরা অনুভব করছেন, এই উচ্চগ্রামের কোলাহলে ‘ভক্তের একান্ত নিবেদনের’ কোনও স্থান নেই, এতে ধর্মের ভাগের থেকে বেশি প্রকট সামনের লোকসভা নির্বাচনে শাসক দলের ঘর গোছানোর কাজের ভাগটাই।

প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে ২২ জানুয়ারি দ্বিতীয় দেওয়ালি পালনের ডাক দিয়ে প্রদীপ জ্বালাতে বলেছেন। আরও বলেছেন, এই রাম মন্দির দেশবাসীর জীবনে উন্নতি ডেকে আনবে। অবশ্য জানা নেই, মাত্র মাস দুই আগের অযোধ্যারই একটা ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর মনে পড়বে কি না! গত নভেম্বরে দেওয়ালির দিনে সরযূ নদীর তীরে বাইশ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে নাকি বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ! ঠিক পরের দিন বহু সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছিল এক মর্মান্তিক ছবি– নিভে যাওয়া প্রদীপ থেকে পোড়া তেল সংগ্রহের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে শতাধিক শিশু-কিশোর। এই তেল তাদের কারও ঘরে রান্নায় কাজে লাগবে, কোনও ঘরে একটু আলো হয়ত জ্বলবে এই কুড়ানো তেলের ভরসাতেই! এদের জীবনে কোন উন্নতিটা মন্দিরের মাধ্যমে আনবেন প্রধানমন্ত্রী? কোন উন্নতি তিনি আনবেন এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য উচ্ছেদ হওয়া অসংখ্য ছোট দোকানদার, হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জীবনে?

খবরে যতটুকু প্রকাশ, তাতে ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মাথা তুলবে অযোধ্যার নতুন রাম মন্দির। যদিও এখনও তা পুরোপুরি তৈরি হয়নি। দ্বিতল মন্দিরের বহু কাজই বাকি। তবু ২২ জানুয়ারিতেই তার উদ্বোধন করে দিতে হবে। কারণ দেরি করলে এসে যাবে লোকসভা ভোট। সেই ভোটের ময়দানে জনসভায় দাঁড়িয়ে বিজেপি সরকারের আর কোন কৃতিত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল গলা ফাটাবেন! তাঁদের সরকারের ‘রাম রাজত্বে’ দেশের ৭৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে, অপুষ্টিজনিত নানা রোগে প্রতিদিন ৭ হাজার ভারতবাসীর মৃত্যু হয়। কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে, এ দেশে শিশুমৃত্যুর ৬৯ শতাংশই ঘটে অপুষ্টির কারণে। বেকারত্ব বাড়ছে প্রতিদিন, কিন্তু সরকারি দপ্তরে লক্ষ লক্ষ খালি পদে নিয়োগ নেই। দিনে দিনে বাড়ছে ঋণের জালে জড়িয়ে কৃষকের আত্মহত্যার সংখ্যা। একের পর এক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, এই ভারতে আজ কর্মসংস্থান নেই শুধু নয়, কর্মক্ষম জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ কাজ না পেতে পেতে কাজের খোঁজ করাই ছেড়ে দিয়েছেন। যে ক’জনের কাজ জোটে তাঁরাও বাঁচার মতো বেতনটুকু পান না।স্থায়ী চাকরি বলে কোনও কিছু দেশে প্রায় রাখছেই না কেন্দ্রীয় সরকার। মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বলে কার্যত কিছু যে অবশিষ্ট নেই। যে কারণে নতুন করে সরকারকে দেশের ৮০ কোটি মানুষের জন্য রেশনে বিনামূল্যে খাদ্যশস্যের ব্যবস্থা নতুন করে করতে হয়েছে।

অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই রাম মন্দিরের উদ্বোধন করার জন্য মোদিজির কেন এত তাড়া এই তথ্যগুলিই তা দেখিয়ে দিচ্ছে। তিনি খুব ভালই জানেন শুধু সরযূর তীরে জ্বালানো প্রদীপ দিয়ে কোভিডের সময় গঙ্গায় ভেসে যাওয়া শত শত মানুষের মৃতদেহের মর্মান্তিক ছবিকে জনমানস থেকে পুরোপুরি আড়াল করা যাবে না। জনজীবনের কোনও একটি সংকটকে সামান্য কমানোর ক্ষেত্রেও বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের চরম ব্যর্থতা এতটাই প্রকট যে, মোদিজি নিজেও সদ্যসমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে একটি বারের জন্যও বিজেপি সরকারের সাফল্য নিয়ে বাক্যব্যয় করেননি। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও মোদিজি এবং তাঁর দলের একমাত্র হাতিয়ার হতে চলেছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের উৎকট প্রচার।সে জন্যই তাঁকে রাম মন্দিরের আড়াল নিতে হচ্ছে।গত কয়েক বছরে তাঁরা যা কিছু করেছেন, তা চালিয়েছেন, ‘রাম কে নাম পর’ অর্থাৎ রামের নামে। এখন রাম নামকেও কার্যত পিছনে পাঠিয়ে দিয়ে মোদিজিকেই প্রায় অবতারের পর্যায়ে স্থাপনের অপচেষ্টা চলছে। তাই এই মন্দিরের শিলান্যাস অনুষ্ঠানের সময় নরেন্দ্র মোদির সাষ্টাঙ্গ প্রণামের নানা ভঙ্গির ছবি যত প্রচারিত হয়েছে রামলালাকে তত দেখা যায়নি। এমনকি প্রাচীন ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ ভাঙার কুকর্মটির নেতা যাঁরা ছিলেন সেই এল কে আদবানী, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতীরা এখন বিজেপির কাছেও প্রায় বিস্মৃত। এখন ‘ভোট কে নাম পর’ দরকার মোদিজির মুখ, তাই তিনিই প্রধান পূজ্য হয়ে উঠেছেন।

এ ক্ষেত্রে বিজেপির আরও সুবিধা করে দিচ্ছে বিজেপির বিরোধী হিসাবে পরিচিত কংগ্রস, তৃণমূল কংগ্রেস সহ ইন্ডিয়া জোটের দলগুলির ভূমিকা। কংগ্রেসই স্বাধীনতার কিছুদিনের মধ্যেই বাবরি মসজিদে রামলালা মূর্তি চুপিসারে বসিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। বাবরি মসজিদের তালাও খুলিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী। মাত্র কিছুদিন আগেই মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস নেতারা দাবি করেছেন, আমাদের জন্যই বিজেপি রাম মন্দির তৈরি করতে পেরেছে।কার্যত বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাছে নতিস্বীকার করে কংগ্রেস, তৃণমূল সহ তাদের ইন্ডিয়া জোটের অন্য দলগুলি তথাকথিত নরম সাম্প্রদায়িকতার রাস্তা নিয়েছে।দুটি রাস্তাই সাম্প্রদায়িক, যা গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে।মুমূর্ষু পুঁজিবাদের সেবাদাস ভোটসর্বস্ব দলগুলির কাছ থেকে সাধারণ মানুষের আজ এর বেশি কিছু আশা করাই বৃথা।

ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষকে ভাবতে হবে, একটা কেন, এমন শত শত মন্দির বানালেও বিজেপি তার একচেটিয়া পুঁজিপতির সেবাদাসের ভূমিকা পরিত্যাগ করবে কি? তা যদি না করে তাহলে আদানি, আম্বানিদের মতো ধনকুবেরদের স্বার্থে জনসাধারণের ওপর শোষণের স্টিম রোলার চালানোর প্রক্রিয়া যে নামেই হোক না কেন, তা কি ধর্ম-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে সকল সাধারণ মানুষের ওপরেই চলবে না? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কে শোষিত হবে, কে শোষণ করবে তা ঠিক হয় কি ধর্মের নিরিখে? নাকি ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত নির্বিশেষে সমস্ত নিপীড়িত মানুষের ওপরই পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ একই রকমভাবে চলে! বুঝতে হবে সমস্ত মেহনতি মানুষের স্বার্থ এক এবং অভিন্ন।শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে বিজেপি সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছড়িয়ে খেটে খাওয়া মানুষকে বিভক্ত করে রাখতে তৎপর।

পুঁজি মালিকদের অন্য সবসেবাদাস কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস সহ ইন্ডিয়া জোটের দলগুলি এর বিরোধিতায় যে ‘নরম সাম্প্রদায়িকতা’র লাইন নিয়েছে তা এর মোকাবিলায় একেবারে অক্ষম। রাম মন্দির উদ্বোধন নিয়ে বিজেপির আসল পরিকল্পনা ফাঁস করবে কি, তারা নিজেরাই ভাবতে বসেছে এর থেকে কিছু ফয়দা নেওয়া যায় কি না! মেহনতি মানুষের স্বার্থের বিরোধী এই রাজনীতির বিকল্প হতে পারে একমাত্র সংগ্রামী বামপন্থা ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথে চলা সঠিক রাজনীতি। তাই রাম মন্দির মাথা তুলল কি না, তার কৃতিত্বই বা কার কতটুকু, এসবের থেকে খেটেখাওয়া মানুষের যে প্রশ্নের উত্তরটা জানা বেশি দরকার– তা হল এই শোষণ, জুলুমের অবসানের লক্ষ্যে সঠিক পথটা কী এবং কে সেই পথ দেখাচ্ছে তা চেনা এবং সবদিক থেকে শক্তিশালী করা।