মন্দির তৈরি কি সরকারের কাজ?

৫ আগস্ট অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস করার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির৷ বিজেপি নেতারা দিনটিকে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ঐতিহাসিক বলে প্রচার করছেন৷ কিন্তু কীসে তা ঐতিহাসিক? কাদের কাছে ঐতিহাসিক? দেশের একশো তিরিশ কোটি জনসাধারণ, যাঁরা এখন করোনা মহামারির সাথে মরণপণ লড়াই করছে, একটু চিকিৎসা পাওয়ার জন্য, একটু ওষুধ পাওয়ার জন্য, একটু অক্সিজেন পাওয়ার জন্য হাহাকার করছে, তাদের জন্য ঐতিহাসিক? যে কোটি কোটি শ্রমিক–কর্মচারী কাজ হারিয়ে দুটো পয়সা রোজগারের চেষ্টায় মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রাখছেন, করোনার প্রকোপে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন যে ছাত্রছাত্রীরা, তাদের জন্য ঐতিহাসিক? দেশের যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, স্বাধীনতার সাত দশকে যাদের জীবনে শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন বেকারি অনাহারের দুর্দশা থেকে এতটুকু রেহাই জোটেনি, তাদের কাছে ঐতিহাসিক? নাকি শুধু বিজেপি নেতাদের কাছেই তা ঐতিহাসিক, যাঁরা এই রামমন্দির রাজনীতিকে পুঁজি করে, দেশের ধর্মভীরু জনতার সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে আজ রাজ্যে রাজ্যে এবং কেন্দ্রের ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসেছেন?

আজ সারা দেশ করোনা আতঙ্কে কাঁপছে৷ প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে৷ পঞ্চাশ হাজার করে নতুন ভাবে আক্রান্ত হচ্ছে৷ তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী সেই আক্রান্ত, ভীত দেশবাসীর জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ, চিকিৎসা, হাসপাতালের ব্যবস্থার কথা না ভেবে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মন্দির নির্মাণ করতে ছুটছেন৷ অযোধ্যায় পুরোহিত, নিরাপত্তারক্ষীরা করোনায় আক্রান্ত৷ আক্রান্ত স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য মন্ত্রীরা৷ প্রধানমন্ত্রী নিজে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার সাবধান বাণী বারবার উচ্চারণ করছেন৷ অথচ নিজে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব নিষেধাজ্ঞাকে উড়িয়ে দিয়ে এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে চলেছেন৷ প্রধানমন্ত্রীর এমন অবৈজ্ঞানিক আচরণের পিছনে কীসের এত তাগিদ? তা কি কোনও গভীর ধর্মীয় আবেগ? ধর্মীয় আবেগের লেশমাত্রও থাকলে, ধর্মবিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও থাকলে কি প্রধানমন্ত্রী কিংবা এই সব বিজেপি, ভিএইচপি, আরএসএসের নেতারা তিনশ বছরের প্রাচীন এক ঐতিহাসিক স্মারককে গায়ের জোরে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে মন্দির তৈরির পরিকল্পনা করতে পারতেন? সবচেয়ে বড় ধর্ম তো মানবধর্ম৷ সে ধর্ম তো দেশের এই রকম এক সঙ্কটজনক সময়ে আর্ত দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানোর কথাই বলে৷ তা না করে মন্দির রাজনীতি নিয়ে এই নেতারা দেশজুড়ে উন্মাদনা তৈরিতে ব্যস্ত হতে পড়ছেন কী করে? আজ দেশের সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে হাসপাতাল তৈরি করা৷ তা না করে তাঁরা বিপুল ব্যয়ে মন্দির তৈরি করছেন কেন?

এই সব নেতা–মন্ত্রীদের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে এটা স্পষ্ট যে কোনও ধর্মবিশ্বাস থেকে তাঁরা এ কাজ করছেন না৷ এঁদের জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনও পরিচয় দেশবাসী পায়নি৷ ভণ্ডামিই এঁদের একমাত্র ধর্ম, একমাত্র দেবতা দেশি–বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা৷ এই সব পুঁজিপতিদের সেবাই তাঁদের একমাত্র ধর্মাচরণ৷ তাই মাসের পর মাস লকডাউনে মানুষ যখন দুবেলা কী খাবে ভেবে পাচ্ছে না, তার কোনও ব্যবস্থা না করে সরকার এই সময়টিকেই বেছে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় সব সম্পদ এবং সম্পত্তি দেশি–বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির মালিকদের মধ্যে নির্বিচারে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য৷ বিনিময়ে অর্থ দিয়ে, প্রচার দিয়ে এই পুঁজিপতিরা তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে৷ রাজ্যে রাজ্যে বিরোধী সরকারগুলি ভাঙতে, হাজার হাজার কোটি টাকায় এমএলএ–এমপিদের কিনতে টাকার জোগান দিচ্ছে এই পুঁজিপতিরা৷ গত লোকসভা নির্বাচনেই প্রধানমন্ত্রীর ভোটের সমস্ত খরচ, ইচ্ছা মতো বিমান ব্যবহারের খরচ জুগিয়েছে আম্বানি–আদানিরা৷ বাস্তবে বিজেপি আজ এ দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছে৷

তাই এই মন্দির নির্মাণের পিছনে বিজেপি নেতাদের কোনও ধর্মীয় বিশ্বাস বা আবেগ নেই, রয়েছে একটিই উদ্দেশ্য, তা হল হিন্দ ভোটব্যাঙ্ক তৈরি৷ দেশজুড়ে মন্দির নির্মাণের প্রচারকে তুঙ্গে তুলে তারা এটাকে সমস্ত হিন্দুর দাবি বলে প্রমাণ করতে চায়৷ অথচ এর থেকে বড় মিথ্যা আর কিছু হয় না৷ বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর দলের ঝুলিতে আজ দেশের মানুষকে দেওয়ার মতো কিচ্ছু নেই৷ মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির একটিরও সমাধান করার ক্ষমতা তাদের নেই৷ বরং পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সমাজের নানা ক্ষেত্রে মানুষের অধিকারগুলিকেও কেড়ে নিচ্ছে৷ শ্রমিক–কর্মচারীদের আট ঘণ্ঢা কাজের অধিকার কেড়ে নিয়ে যথেচ্ছ খাটানোর অধিকার মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছে৷ ব্যাপক বেসরকারিকরণ ঘটিয়ে মানুষের শিক্ষা এবং চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারকে কেড়ে নিচ্ছে৷ বিপরীতে মানুষকে তারা যা দিচ্ছে তা হল, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, অনিশ্চয়তা, হতাশা৷ আর এ সবকে ঢাকতেই ধর্মের বড়ি গেলাচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালাচ্ছে৷

অনেক দুর্বলতা নিয়েও ভারতের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতার যে চরিত্র ছিল, রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর এই শিলান্যাস কর্মসূচি সেই ঐতিহ্যের উপর এক চূড়ান্ত আক্রমণ৷ বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে এই আক্রমণের সূচনা হয়েছিল৷ রামমন্দির নির্মাণ কর্মসূচি তাকে চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে দিল৷ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের যে দীর্ঘ ঐতিহ্য ভারতের ছিল তাকেও তারা ধুলিসাৎ করে দিল৷

প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা প্রায়ই দেশের মানুষকে শোনান, কংগ্রেসি ধারাবাহিকতা থেকে তাঁরা দেশকে বের করে আনতে চান৷ এই কি তাঁদের সেই বের করার ধরন? বোফর্স কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধীর জনসমর্থন যখন তলানিতে, তখনই হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরির স্বার্থে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বাবরি মসজিদের তালা পুজোর জন্য খুলে দিয়েছিলেন তিনি৷ আর সেই মসজিদটিকেই ভেঙে দিয়ে আজ সেখানে মন্দির তৈরি করছে বিজেপি একই হিন্দু ভোটের লোভে৷ ভোটের স্বার্থেই দিল্লির শিখ–গণহত্যা সহ সারা দেশে কয়েক হাজার ছোট–বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছিল কংগ্রেস৷ বিজেপি কংগ্রেসের হাত থেকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ব্যাটনটা কেড়ে নিযে তাদের ভোট রাজনীতির দৌড়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে৷ রাহুল গান্ধী শিবভক্ত সেজে কিংবা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেও সে দৌড়ে আর এঁটে উঠতে পারছেন না৷ আজ আবার বিজেপির সাথে প্রতিযোগিতায় মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস নেতারা রামের মামারবাড়ির ঠিকা নিচ্ছেন৷ উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস নেতারা বুঝেই উঠতে পারছেন না বিজেপির বদলে কংগ্রেসকে হিন্দুত্ববাদের চ্যাম্পিয়ান সাজাতে গেলে এখন কী করা দরকার এই হল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধিতার স্বরূপ৷ কোথায় পার্থক্য?

এখনও বাবরি মসজি ভাঙার বিচার শেষ হয়নি৷ যদিও বিচারব্যবস্থাকে তারা কতখানি পঙ্গু করে দিয়েছে, তার স্বাধীন চরিত্রকে কতখানি ধ্বংস করে দিয়েছে, অযোধ্যা মামলায় যুক্তি–প্রমাণকে উড়িয়ে দিয়ে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়ার কথা বলে যখন রামমন্দির নির্মাণের রায় দেওয়া হল এবং তড়িঘড়ি তার বিচারককে রাজ্যসভায় মনোনীত করে পুরসৃক্ত করলেন বিজেপি নেতারা তখনই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ এই মামলাতেও হয়ত কোনও দোষীরই শাস্তি হবে না৷ কিন্তু তার আগে অভিযুক্ত বিজেপি–আরএসএস নেতাদের শিলান্যাস সমারোহে যে ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হল, তাতেই স্পষ্ট প্রমাণ হয়, বিজেপি নেতাদের, তা তিনি প্রধানমন্ত্রীই হোন বা অন্য কোনও নেতা–মন্ত্রী, আইনের শাসনের প্রতি নূ্যনতম শ্রদ্ধাবোধ কারওরই নেই৷ এ যাঁদের নেই, দেশের মানুষ তাঁদের থেকে কী করে আশা করতে পারে যে তাঁরা দেশে আইনের শাসন জারি রাখবেন? বাস্তবেও ঠিক তাই, বিজেপি শাসনে আইনের শাসন আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে৷

গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়৷ আর তাকে যখন রাষ্ট্রীয় মদতে সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় তখন তা সাধারণ মানুষের জীবনে সর্বনাশ নামিয়ে আনে৷ জনজীবনের মূল সমস্যাগুলিকে শাসকরা পিছনে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়৷ বিজেপি নেতারাও আজ তাই করছেন৷ আজ দেশের মানুষকে বুঝতে হবে, ধর্ম নয়, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাই প্রভৃতি সমস্যাগুলিই তাদের জীবনকে ছেয়ে রয়েছে৷ এই সহজ সত্যটাই ধূর্ত বিজেপি নেতারা মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চায়৷ এই ধূর্ত রাজনীতিকে পরাস্ত করতে জনগণের সঙঘশক্তিই আজ প্রধান শক্তি৷ আজ যদি মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বেসরকারিকরণ যদি বন্ধ করতে হয়, কোটি কোটি শ্রমিক–কর্মচারীর ছাঁটাই যদি বন্ধ করতে হয়, তবে শোষিত–বঞ্চিত মানুষকে আজ ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদে প্রতিরোধে নামতে হবে৷ কারণ শাসক শ্রেণি, যারা সাধারণ মানুষের উপর একের পর এক আক্রমণ নামিয়ে আনছে তারা সংঘবদ্ধ৷ রাষ্ট্রের সব শক্তি তাদের হাতে৷ এমন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে হলে সচেতন ভাবে এবং সঠিক নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলাই জনগণের সামনে একমাত্র রাস্তা৷