বাকস্বাধীনতা থাকবে শুধু স্তাবকদের?

ভারতে কি সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা বিপন্ন? বেশিরভাগ মানুষের উত্তরটা হবে হ্যাঁ বাচক৷ যদিও, দেশের শীর্ষ আদালত একটি মামলায় বলছে, ‘ভারতের স্বাধীনতা ততদিন সুরক্ষিত থাকবে যতদিন দেশের সাংবাদিকরা ক্ষমতাসীনদের দমনমূলক হুমকির সামনে মাথা নত না করে সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে বলতে পারবেন৷’ ১৯ মে ২০২০ এই রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং এম আর শাহের বেঞ্চ আরও বলে, কোনও সাংবাদিককে তাঁর মত প্রকাশের দায়ে এফআইআর, মামলা ইত্যাদির মধ্যেই ফেঁসে যেতে হলে সাংবাদিকদের প্রশ্ন তোলার অধিকার, দেশের মানুষকে তথ্য জানানোর অধিকার খর্ব হয়৷ মামলাটি ছিল রিপাবলিক টিভির সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে৷ তিনি মহারাষ্ট্রে পালঘর এলাকায় সাধুদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁর টিভি চ্যানেলে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্য করেছেন, এই অভিযোগে কয়েকজন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন৷ শ্রী গোস্বামী সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে সাহায্য করে৷ সুপ্রিম কোর্টও তাঁকে একটি বাদে সব মামলা থেকে মুক্তি দিয়েছে শুধু তাই নয়, সেই মামলাটি কোন নিম্ন আদালতে শোনা হবে তাও তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী ঠিক করে দিয়েছে (দ্য ওয়্যার ২৮ জুন ২০২০)৷

আরও দু–একটি মামলায় বাক স্বাধীনতা রক্ষার পক্ষে অসাধারণ ভাষণ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত উকিলরা৷ আদালতে অভিযোগ এসেছিল কেন্দ্রীয় শাসকদলের পছন্দের টিভি সাংবাদিক অমিশ দেবগণ তাঁর একটি অনুষ্ঠানে ইতিহাস বিখ্যাত এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুফি সাধক মইনুদ্দিন চিস্তিকে ‘লুঠেরা চিস্তি’ বলেছেন৷ এতে বহু মানুষের ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে তাই নয়, ইতিহাসকেও বিকৃত করা হয়েছে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর ঢাল হয়ে দাঁড়ায়, ফলে হাইকোর্ট এড়িয়ে মামলা সরাসরি চলে যায় সুপ্রিম কোর্টে৷ সেখান থেকে সামান্য দুঃখপ্রকাশ করেই তিনি ছাড় পেয়ে গেছেন৷ ‘অপ–ইন্ডিয়া’ পোর্টাল পশ্চিমবঙ্গকে ‘ইসলামিক রাজ্য’ বলে চিহ্ণিত করেছিল৷ প্রচার করেছিল দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে জোর করে আজান দেওয়া হচ্ছে৷ এই ধরনের সাম্প্রদায়িক প্রচার তারা চালিয়ে গেছে অনেকদিন৷ এ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সাম্প্রদায়িক বক্তব্য বিশেষ করে প্রচার করার পর রাজ্য সরকার তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল৷ সেই মামলাও কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় হাইকোর্ট এড়িয়ে চলে গেছে সুপ্রিম কোর্টে৷ এবং– কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে কার্যত তাদের হয়ে মামলা লড়ে দিয়ে তাদের সব অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দিয়েছে৷

যখন বাকস্বাধীনতার কথা মনেই পড়ছে না

কিন্তু সকলেই কি সমান ব্যবহার পেয়েছেন পুলিশ–প্রশাসন, আদালতের কাছ থেকে? তা হলে আসা যাক প্রবীণ সাংবাদিক বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে৷ একজন বিজেপি কর্মী হিমাচল প্রদেশের পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন, দিল্লিতে কর্মরত শ্রী বিনোদ দুয়া তাঁর টিভি আলোচনায় বলেছেন, দিল্লি দাঙ্গাকে বিজেপি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়৷ আর একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল এই মর্মে যে, তিনি কোভিড মহামারি মেকাবিলার প্রশ্ণে হিমাচল প্রদেশ এবং কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের ঘাটতি তুলে ধরে সমালোচনা করেছেন৷ সঙ্গে সঙ্গে হিমাচল প্রদেশ পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রুজু করে এবং লকডাউনের মধ্যেই ১২ জুন তাঁর দিল্লির বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পরের দিন সকাল ১০টার মধ্যে কুমারসাঁই থানায় উপস্থিত হতে বলে৷ দিল্লি থেকে সেখানে গাড়িতে যেতে লাগে অন্তত ২০ ঘন্টা৷ সাংবাদিক দুয়া দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে আদালত জানায় এই মামলার কোনও সারবত্তা নেই৷ প্রাথমিক (প্রাইমা ফেসি) প্রমাণও নেই, তাই এফআইআর বাতিল করতে হবে৷ সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়, শীর্ষ আদালতের তিন বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, যেহেতু দুয়া আগেই তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে সমস্ত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন, তাই তদন্ত চলবে, তাঁকে ২৪ ঘন্টার নোটিশ দিয়ে বাড়িতে বা ভিডিও কনফারেন্সে পুলিশ জেরা করতে পারবে৷ অর্থাৎ অভিযোগের সারবত্তা থাকুক আর না থাকুক, আইন মেনে চলার প্রতিশ্রুতিই চলে গেল তাঁর বিরুদ্ধে৷ তিনি সুনির্দিষ্ট ঘটনা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছেন, বর্তমান সময়ে একটা রীতিই দাঁড়িয়ে গেছে, হয় তুমি সরকারের ‘হ্যাঁ’ তে ‘হ্যাঁ’, ‘না’ তে ‘না’ বলতে শেখো, না হলে পুলিশি হয়রানির জন্য প্রস্তুত থেকো৷ বিনোদ দুয়া শীর্ষ আদালতের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা যাবে তা নির্দিষ্ট করে দিক আদালত৷(ওই)

হিমাচল প্রদেশেই সাংবাদিক অশ্বিনী সাইনি, ওম শর্মা সহ অন্তত ৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ৷ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে৷ তাদের কারও ‘অপরাধ’ কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলায় সরকারি ব্যবস্থার খামতি তুলে ধরা, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা বলেছেন, আবার লকডাউনের মধ্যে বেআইনিভাবে ইট ভাটা চালানোর খবরের জন্য সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ উত্তরপ্রদেশে লকডাউনের মধ্যে সরকারের সমালোচনা, রাস্তায় হাঁটা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য যাঁরা খাবারের বন্দোবস্ত করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদবিরোধী ইউএপিএ আইন প্রয়োগ করার খবর ফাঁস করে দেওয়া, অথবা কাজ হারানো শ্রমিকদের দুর্দশা তুলে ধরার জন্য ১১ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে রাজ্য পুলিশ৷ লকডাউনে গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা বেড়েছে এই কথার জন্য ‘দ্য স্ক্রোল’–এর সম্পাদক সুপ্রিয় শর্মার বিরুদ্ধে মামলা করেছে উত্তরপ্রদেশ সরকার৷ এমনকি ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পুরনো সংবাদসংস্থা পিটিআই সরকারের মনমতো কথা না বলায় তাদের সাবস্ক্রিপশন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন প্রসার ভারতী৷ চলছে অরও হুমকি৷

দিল্লির ‘রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস গ্রুপ’ জানাচ্ছে এই সময় শুধু সরকারের সমালোচনার জন্য ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের অনেকের উপর শারীরিক নির্যাতন চলেছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ কাউকে কাউকে দিয়ে আর কোনওদিন সরকারের সমালোচনা করব না বলে মুচলেকা লেখানো হয়েছে (দ্য ওয়্যার, ১৬ জুন, ২০২০)৷ দলিতদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন, মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওতে দলিতদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ, উত্তরপ্রদেশে মিড ডে মিল নিয়ে দুর্নীতির প্রতিবাদ এরকম অসংখ্য ঘটনায় প্রতিবাদী মানুষ কিংবা সাংবাদিককে সন্ত্রাসবাদ দমনের আইন ইউএপিএতে অভিযুক্ত করেছে সরকার৷ কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের পাঁচ বছরে বাক স্বাধীনতার নিরিখে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোরটার্স উইদাউট বর্ডার্স’ ভারতকে দুনিয়াতে ১৪২ নম্বর স্থান দিয়েছে৷ নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কার নিচে হয়েছে ভারতের স্থান৷

স্তাবকদেরই বাকস্বাধীনতা

এই প্রশ্নের উত্তর সরকার দিয়েই রেখেছে মানব দরদি চিকিৎসক ডাক্তার কাফিল খানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করে তাঁকে দীর্ঘদিন জেলবন্দি করে রাখার মধ্যে৷ উত্তর আছে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী সহ দেশজুড়ে বিরাট সংখ্যক সিএএ–এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনে মামলা করার মধ্যে৷ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, কোনও জনবিরোধী আইনের বিরুদ্ধেতা করাই এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সন্ত্রাসবাদের নামান্তর৷ সরকারের স্তাবক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ আনলে তখন সরকারি উকিল থেকে আদালত সকলের মনে পড়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের কথা৷ আর বিরোধী কণ্ঠস্বরের ক্ষেত্রে বিষয়টা হচ্ছে ঠিক উল্টো তাঁদের জন্য কোনও অধিকার নেই৷

কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার কিছুদিন আগে ইউএপিএ আইন (আনলফুল অ্যাক্টিভিটিস প্রিভেনশন অ্যাক্ট) সংশোধন করে যে রূপ দিয়েছে তাতে বাস্তবে যে কোনও লোককেই সরকার চাইলে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে আটক করতে পারে৷ তার জন্য কোনও বিচারবিভাগীয় অনুমোদনেরও দরকার নেই৷ এনআইএ–র মতো কেন্দ্রীয় আমলাদের নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা সংস্থা যে কোনও মানুষকে বিনা বিচারে যতদিন খুশি আটক রাখার অধিকার পেয়ে গেছে৷ সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, রাজনৈতিক বিরোধিতা রুখতে এই আইন ব্যবহার করা হবে না, সেটা তাঁরা নিশ্চিত করবেন৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে কোভিড–১৯ মহামারিতে অধিকাংশ মানুষ যখন ঘরবন্দি ঠিক সেই সময় কেন্দ্র কিংবা রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি সরকার সিএএ–এনআরসি বিরোধী আন্দোলন ভাঙতে একের পর এক আন্দোলনকারীর উপর ইউএপিএ প্রয়োগ করেছে৷ বিজেপি সরকার ২০১৭ থেকে ’১৯ পর্যন্ত ৩৬৮১ জনের বিরুদ্ধে ইউএপিএতে মামলা সাজিয়েছে৷ যাঁদের একটা বড় অংশ গ্রেপ্তার হয়েছেন দলিত, সংখ্যালঘু মানুষের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার দায়ে (নিউজ ক্লিক, ২২ নভেম্বর ২০১৯)৷ ইউএপিএ আইনে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হয়, সে নির্দোষ৷ অভিযোগ প্রমাণের কোনও দায় সরকার পক্ষের নেই৷ বর্তমান সংশোধনী অনুযায়ী অভিযুক্তকে কোর্টে হাজিরও করতে হয় না, উকিলদের কোনও সওয়াল জবাবেরও সুযোগ নেই৷ শুধু কাগজের লেখার ভিত্তিতেই বিচার হয়ে যায়৷ ফলে সরকারি বয়ানের বিপরীত কোনও রায় হওয়াই মুশকিল৷ তা সত্ত্বেও ৭৫ শতাংশ মামলায় তিন–চার বছর জেলে থেকে অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে গেছেন৷ কারণ পুলিশ বা এনআইএ আদৌ কোনও তদন্তই করেনি৷ ২০১৮ সালে ২০০৮টি কেসের মাত্র ৩১৭টিতে আদালতে বিচার শুরু হয়েছিল৷ বাকিরা বিনা বিচারেই জেলে থাকতে বাধ্য হয়েছেন (হিন্দুস্তান টাইমস, ৩০ জুন ২০২০)৷ কেবলমাত্র অপছন্দেরলোকেদের আটকে রাখাটাই উদ্দেশ্য না হলে এই ঘটনা ঘটতে পারত  কি?

জরুরি অবস্থার সমর্থক ছিল আর এস এস

বিচার বিভাগের উপর সরকারের ভয়াবহ চাপের কথাটাও সামনে আসছে বারবার৷ দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে সরকারকে কাঠগড়ায় তোলায় হাইকোর্টের বিচারপতিকে কীভাবে মাঝরাতে বদলি করা হয়েছে তা দেশবাসী সহজে ভুলতে পারে না৷ অপছন্দের বিচারকদের পদোন্নতিতে বাধা দেওয়া, অবসরপরবর্তী পদের লোভ দেখিয়ে বিচারপতিদের প্রভাবিত করা, বিচারপতিদের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে সরকারের পক্ষে রাখার চেষ্টা ইত্যাদি ঘটনার বেশ কয়েকটি উদাহরণ বিগত কয়েক বছরে সামনে এসেছে৷ এই পরিস্থিতি মনে করিয়ে দেয় কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলের সেই জরুরি অবস্থার দিনগুলিকে৷ সেই কালো দিনকে স্মরণ করেই নাকি গত ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছিলেন, তাঁদের কুর্নিশ’ জানাই’৷

কিন্তু তিনি বলেননি, তাঁর আমলে যে পরিস্থিতি চলছে তা জরুরি অবস্থার থেকে কম কীসে? পার্থক্য একটাই, তখন ছিল ঘোষিত জরুরি অবস্থা৷ আজ তার থেকেও খারাপ ভাবে চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা৷ আর একটা কথা নরেন্দ্র মোদীজি বলতে ভুলে গেছেন, তিনি যে সংগঠনের‘গর্বিত সদস্য’, সেই আরএসএস ছিল জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধী এবং জরুরি অবস্থার ঘোষিত সমর্থক৷

গণতন্ত্রের খোলসে কায়েম হচ্ছে ফ্যাসিবাদ

গণতন্ত্রের বাইরের খোলসটা বজায় রেখে নরেন্দ্র মোদির জমানায় বিজেপি সরকার যে ‘গণতন্ত্র’ কায়েম করেছে তার অপর নাম প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদ৷ ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরেই এই ব্যবস্থার যাত্রা এ দেশে শুরু৷ আজ মোদী সাহেবদের পরম বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেব, কিংবা ব্রাজিলের বোলসোনারো সকলেই এই পথ ধরেই চলেন৷ বহুদিন আগেই মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়ে গেছেন, আজকের পুঁজির চরম একচেটিয়াকরণের যুগে সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষকরা ওপরে ওপরে গণতন্ত্রের ঠাটবাটটুকু বজায় রেখে তার ভিতরের সব বস্তুকে শেষ করছে৷ এই পথেই কায়েম করছে ফ্যাসিবাদ৷ পুঁজি যত মুষ্টিমেয়র হাতে কুক্ষিগত হচ্ছে তত কমছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের পরিসর৷ আজ এতটুকু বিরোধী স্বরকে পুঁজির রক্ষকরা সহ্য করে না৷ কিন্তু তাদের ছুরিটা লুকোন থাকে সংসদীয় রাজনীতির আলখাল্লার তলায়৷ পুরনো ধাঁচায় ফ্যাসিবাদকে খুঁজতে গেলে আজ পাওয়া যাবে না৷ তাই এদেশে যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়বে, তাদের সেই লড়াইকে সংসদীয় রাজনীতির চোরাগলিতে ঢুকিয়ে দেওয়া চলে না৷ যেমন চলে না এই ফ্যাসিবাদকে ভারতের মাটিতে যারা লালন পালন করে বড় করে তুলেছে, সেই কংগ্রেসের হাত ধরে বিজেপিকে আটকানোর মিথ্যা আশায় মানুষকে ভোলানো৷ কংগ্রেস আর বিজেপির রাজনীতি যে একচেটিয়া মালিকদের পদলেহনকারী একই রাজনীতির এপিঠ–ওপিঠ, এদের মধ্যে যে কোনও পার্থক্যই নেই তা তুলে ধরা আজ বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম কর্তব্য৷

অবশ্য, তথাকথিত বৃহৎ বাম দলগুলি জরুরি অবস্থার আগে এবং পরে যে ভূমিকা নিয়েছিল তাতে একদিকে যেমন চরম ফ্যাসিবাদী দমন নীতি নিতে ইন্দিরা গান্ধীর সুবিধা হয়েছিল, অন্যদিকে জনসংঘ এবং তার হাত ধরে আজকের বিজেপির রাজনীতির জমি তাঁরাই প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন৷ সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে এস ইউ সি আই (সি)–র আবেদন সত্ত্বেও সিপিএম–সিপিআই নেতৃত্ব অংশ নিতে চাননি৷ অজুহাত, ওতে জনসংঘ আছে৷ আর সিপিআই সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকেই সমর্থন করে৷ এর ফলে আন্দোলনের উপরে বামপন্থী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়৷ আন্দোলনের প্রতি মানুষের সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে জনসংঘের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিই মাথা তোলার জায়গা পায়৷ অথচ জরুরি অবস্থার পর যখন কেন্দ্রে জনসংঘকে নিয়েই জনতা পার্টির সরকার গঠিত হল, এই সিপিএম–সিপিআই তাকে সমর্থন করল৷ বিজেপি সেই শক্তি নিয়েই আবির্ভূত হয় ১৯৮০ সালে৷ আজও দেশকে সেই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে বিজেপি সরকারের তীব্র আক্রমণ রোখার একটাই পথ, তা হল বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করা৷ যা কংগ্রেসের সাথে মিলে নির্বাচনী ফয়দার রাজনীতির পথে অসম্ভব৷

জনজীবনের ভয়াবহ সংকটকে ঘিরে আবার আজ মানুষ আন্দোলনে নামতে চাইছে৷ তা ভোটের বুথের ঘেরাটোপেই আটকে গেলে এক শাসকের বদলে আর একজন আসবে, যন্ত্রণার অবসানের পথ মিলবে না৷