ব্রিগেড সমাবেশের টুকরো ছবি

দেশের নানা প্রান্ত থেকে ব্রিগেড সমাবেশে উপস্থিত মানুষ

 

৫ আগস্টের ব্রিগেড সমাবেশ উপলক্ষে দীর্ঘ প্রচারপর্বে, সমাবেশ চলাকালীন এবং সমাবেশের পরে দলের কর্মী-সমর্থকরা জনসাধারণের সাথে কথাবার্তা বলতে গিয়ে নানা আকর্ষণীয় ও প্রেরণাদায়ক অভিজ্ঞতার ভাগীদার হয়েছেন ও হয়ে চলেছেন। সেগুলি থেকে কয়েকটি প্রকাশ করা হল।

‘দুঃখে ছিলাম, মন ভাল হয়ে গেল’

দলের এক চিকিৎসক কর্মীর পেশেন্ট প্রখ্যাত এক বিজ্ঞানী ব্রিগেড সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। পরদিন কর্মীটিকে ফোন করে তিনি বললেন, ‘‘আগে আমি সিপিএম-কে সমর্থন করতাম। প্রশান্ত শূরের আমলে অনেক টাকা-পয়সা দিয়েছি, সাহায্য করেছি। তারপর ওদের কাজেকর্মে উৎসাহ হারাই। নিজে বামপন্থী বলে সিপিএমের দুর্দশা দেখে মনে মনে খুব দুঃখে ছিলাম। আপনাদের ব্রিগেড সমাবেশ দেখে মন ভাল হয়ে গেল। সাহস পেলাম। এখন থেকে আপনাদের সাহায্য করব।”

উনি সমাবেশে আগতদের থাকার ক্যাম্পে ব্যবহারের জন্য নিজের আবিষ্কৃত ২০০ বোতল জল-পরিশোধক ওষুধ ও ২০ হাজার টাকা দলকে সাহায্য করেছেন।

‘নিজেরাই হিসেব করে পুরো দাম দিয়ে যাচ্ছে’

সমাবেশ উপলক্ষে ‘উত্তীর্ণে’ যে ক্যাম্প হয়েছিল, সেখানকার এক স্বেচ্ছাসেবক নিজের অভিজ্ঞতা জানালেন। বললেন, ‘‘সমাবেশের পরদিন সকাল ১০টা নাগাদ কাজের ফাঁকে ন্যাশনাল লাইব্রেরির সামনে চা খেতে গিয়েছিলাম। প্রবল বৃষ্টি। ফুটপাতে চায়ের দোকানের টাঙানো প্লাস্টিক ছাউনির নিচে অনেকেই ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। দু-একজন ছাউনির নিচেও ছাতা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দলের এক কর্মী সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় ছাতা বন্ধ করে একটু জায়গা দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন একজনকে। তাঁকে দেখেই উপস্থিত এক পুলিশ তাঁর সহকর্মীকে বললেন, ‘‘এস ইউ সি-র লোকদের শৃঙ্খলা দেখেছিস! একজনকেও কিছু বলতে হয় না! কেউ সিগারেট খেলেও আড়াল খুঁজছে!” বললেন, ‘‘গতকালের মিটিংয়ে কোথাও কোনও সমস্যা হয়েছে শুনেছিস? আমরা তো সব বারেই দেখি। কারা কী করে জানতে আমাদের বাকি নেই। মুখ বন্ধ করে দেখতে হয়, বলার উপায় নেই।”

চা দোকানি তাঁর কথায় সমর্থন জানিয়ে বললেন, ‘‘আমি তো কতগুলো চা দিচ্ছি হিসেবও রাখতে পারছি না। কম বললে ওরা নিজেরাই শুধরে দিয়ে পুরো দাম দিয়ে যাচ্ছে!”

‘এক টাকাও বেশি নিবি না’

‘উত্তীর্ণে’র এক স্বেচ্ছাসেবক জানালেন, দক্ষিণ ভারতের কমরেডরা সমাবেশের পরদিন ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছিলেন। তখন ওখানে কর্তব্যরত একজন পুলিশ নিজেই ট্যাক্সি জোগাড় করে তাঁদের তুলে দেন এবং ড্রাইভারকে বলেন, ‘‘এরা এস ইউ সি-র লোক। এদের টাকা-পয়সা নেই। অনেক কষ্ট করে অন্য রাজ্য থেকে পার্টি প্রোগ্রামে এসেছে। যেখানে যাবে নিয়ে যাবি, মিটারে যা উঠবে নিবি। এক টাকাও বেশি নিবি না।”

‘ভাল কাজ করছিস তোরা’

দলের এক চিকিৎসক কর্মী তাঁর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বললেন, ‘‘কলকাতা মেডিকেল কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কর্মরত একজন বিশিষ্ট শিক্ষকের কাছে যখন আমরা সমাবেশের প্রচারে যাই, তিনি আমাদের দলের কর্মীদের সততা এবং ডেডিকেশনের প্রশংসা করেন। সেদিন তাঁর কাছে বেশি টাকা না থাকায় পরদিন কলেজ ছুটির পর আরেকবার যেতে বলেন। পরদিন কর্মীদের ডেকে নিয়ে তিনি চার হাজার টাকা দেন।” কর্মীটি জানালেন, ‘‘সমাবেশের পরে একদিন স্যারের কাছে একটা দরকারে গিয়েছিলাম। স্যার আমাকে দেখেই বললেন, টিভিতে দেখলাম তোদের ব্রিগেডে তো প্রচুর মানুষ এসেছিলেন! কোন কোন রাজ্য থেকে মানুষ এসেছিলেন তা তিনি জানতে চান। সারা দেশে দলের বিস্তৃতির খবর শুনে স্যার বলেন, গুড। খুব ভাল কাজ করছিস তোরা। চালিয়ে যা।”

‘যে দিকে তাকাই লাল পতাকা’

 ওই চিকিৎসক কর্মীই মেডিকেল কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের আর একজন বিশিষ্ট শিক্ষকের কাছে সমাবেশের প্রচারে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘তোরা তো পুরো কলকাতা লাল পতাকায় সাজিয়ে দিয়েছিস! রাস্তায় যেতে যেতে যেদিকেই তাকাই লাল পতাকা! এ রকম দেখেও খুব ভালো লাগে।”

কর্মীটি জানান, কলেজে কর্মচারীদের কাছে ৫ই আগস্টের সমাবেশের প্রচার করতে গেলে একজন সিপিএম সমর্থক তাঁর সহকর্মীদের বলেন, ‘‘এঁরাও বামপন্থী। এঁদের শক্তিবৃদ্ধি হওয়া দরকার। তবেই বামপন্থা শক্তিশালী হবে।” কলেজে আর কোথায় কোথায় কর্মচারীদের মধ্যে প্রচার করা দরকার, সে ব্যাপারে তিনি পরামর্শ দেন।

‘মতবিরোধ থাকলেও তোদের ভাল লাগে’

দলের এক কর্মী হুগলিতে তাঁর পুরনো স্কুলে সমাবেশের প্রচারে গিয়েছিলেন। সেখানে বিজেপি-সমর্থক এক শিক্ষক সমাবেশের কথা শোনামাত্রই বললেন, ‘‘আমি অবশ্যই যাব। তোদের পার্টির চিন্তাধারার সাথে আমার মতবিরোধ থাকলেও তোদের কর্মীদের আমার খুবই ভাল লাগে। তোদের মতো একটা দল একা ব্রিগেড ডাকার সাহস দেখাচ্ছে, এটাতেই আমার ভাল লাগছে।”

ওই কর্মীই স্কুলের আরেকজন শিক্ষকের কাছে গেলে তিনি জানান, দলের বিভিন্ন আন্দোলন দেখে ইতিমধ্যেই তিনি এস ইউ সি আই (সি)-কে সমর্থন করতে শুরু করেছেন। দল ব্রিগেডে সমাবেশ করছে শুনে তিনি চমকে ওঠেন। কী ভাবে এই বিশাল আয়োজন সম্ভব হবে, সে ব্যাপারে জানতে চান। সব কিছু শুনে বলেন, তা হলে তো প্রচুর টাকার দরকার! এই বলে নিজের মানিব্যাগ বের করে সামান্য কিছু রেখে বাকি সব টাকা কর্মীটির হাতে তুলে দিলেন।”

‘ব্যথা নিয়ে দলটা করছি’

এক এস ইউ সি আই (সি) কর্মী ব্রিগেড সমাবেশের প্রচারে সিপিএম-সমর্থক এক শিক্ষকের কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘‘যারা এসইউসি করে তারা পড়াশোনা করে। তোদের মধ্যে এখনও এই চলটা আছে।” তিনি খুব আবেগ নিয়ে বলেন, ‘‘আমরা যারা সিপিএম করি, বুকে যে কী ব্যথা নিয়ে দলটা করছি, আমরাই তা জানি।”

এ ব্যথা কমবে না

দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার দলের এক কর্মী মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে কলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি হন। বেডে শুয়ে তাঁকে কাঁদতে দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক ভাবেন, প্রবল যন্ত্রণায় উনি বোধহয় কাঁদছেন। বলেন, ওষুধ দিচ্ছি, এখনই ব্যথা কমে যাবে। উত্তরে রোগী বলেন, ‘‘এ শরীরের ব্যথা নয়। পার্টির ব্রিগেড সমাবেশ দেখা হল না! এ ব্যথা আমার কমবে না।”

চিকিৎসক অভিভূত হয়ে পড়েন। পরে তাঁর বন্ধু দলের এক কর্মীকে তিনি ঘটনাটি জানান।

‘সিপিএম হয়েও এ কথা বলছি’

দক্ষিণ কলকাতায় গণদাবী পত্রিকার একজন নিয়মিত পাঠকের কাছে গিয়েছিলেন দলের এক কর্মী। ভদ্রলোক সিপিএম-এর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। কর্মীটির আহ্বানে ৫ আগস্ট তিনি নিজে ব্রিগেডে গিয়েছিলেন শুধু তাই নয়, নিজের বোন ও ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সমাবেশ থেকে ফিরে পরদিন কর্মীটিকে তিনি জানালেন, ‘‘আগেও ব্রিগেডে গেছি, কিন্তু এত সুন্দর সমাবেশ আমি আগে দেখিনি। একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছি।” বলেছেন, ‘‘কমরেড প্রভাস ঘোষ খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন। সিপিএম সম্পর্কে উনি যা বলেছেন, আমি নিজে সিপিএম হয়েও বলছি, তা একদম সঠিক।” মন্তব্য করেছেন, ‘‘এমন সুশৃঙ্খল ভাবে এত বিশাল সমাবেশ করা একমাত্র এস ইউ সি-র পক্ষেই বোধহয় সম্ভব।”

‘আলোচনার ভিডিও দাও’

বেহালায় দলের এক কর্মী একটি কো-অপারেটিভের ক্যাশ কাউন্টারে বসেন। নিজের কিছু অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘ব্রিগেড সমাবেশের পরের দিন কাউন্টারে এসে প্রথম কাস্টমারই বললেন, ‘তোমাদের তো দারুণ ব্রিগেড হয়েছে! প্রভাস বাবুর বক্তব্য চমৎকার ছিল! ব্রিগেডে অনেক লোক হয়েছিল! আমি নিজে সিপিএম কর্মী হয়ে বলছি, এই মুহূর্তে একক ক্ষমতায় কোনও বামপন্থী দলের পক্ষে ব্রিগেড ডাকা অসম্ভব। কিন্তু তোমরা তা করে দেখালে’।” কর্মীটি জানিয়েছেন, শুধু ইনি নয়, তার পরেও অনেকে এসে ব্রিগেড সমাবেশ নিয়ে তাঁদের মুগ্ধতা ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অনেকে তাঁর কাছে সেদিনের আলোচনার ভিডিও চেয়েছেন।

‘গণদাবী’ কেনার আগ্রহ লক্ষ করার মতো

ব্রিগেড সমাবেশ নিয়ে প্রকাশিত দলের বাংলা মুখপত্র ‘গণদাবী’ বিক্রি করতে গিয়ে কর্মীরা মানুষের ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করেছেন। ৯ আগস্ট বিকালে বিধাননগরের করুণাময়ী অঞ্চলে গণদাবী বিক্রির কর্মসূচি চলছিল। অতি দ্রুত প্রায় আড়াইশো কপি বিক্রি হয়ে যায়। শুরুতে যখন ব্যানার, ফ্ল্যাগ লাগানো হচ্ছে, তখনই এক ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে এসে গণদাবী নিয়ে গেলেন। পত্রিকা হাতে নিয়ে অনুরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সকলেই গণদাবী নিয়েছেন। নিজেদের বামপন্থী বলে পরিচয় দিয়ে অনেকে পত্রিকা নিয়ে গেছেন সাগ্রহে। উৎসাহিত কর্মীরা গণদাবী আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

‘অন্ধকার কাটবেই’

বিধাননগরের করুণাময়ীতেই ১১ আগস্ট দুই কর্মী গণদাবী বিক্রি করছিলেন। তাঁরা লক্ষ করেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ় তাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁকে গণদাবী নেওয়ার অনুরোধ করতেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি পকেট থেকে টাকা বের করে বললেন, ‘‘আমরা তো শেষ, আপনারাই আছেন। এই অন্ধকার সময় কাটবেই।”