বিজেপির ‘বিকশিত ভারতে’ বিকাশ কাদের!

১।      মাত্র ১ শতাংশ ধনীর হাতে জমা হয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। দেশের ৫০ শতাংশ সব চেয়ে নিচের তলার মানুষের ভাগে জুটেছে মাত্র ৬.৪ শতাংশ। (দি ইকনমিক টাইমস, ২১ মার্চ, ‘২৪)

২।      ভারতে ৯০ ভাগ মানুষের যা সম্পদ সেই পরিমাণ সম্পদ রয়েছে মাত্র ৫৭ জন পুঁজিপতির।

৩।     ২০১৮ সালে শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২ লক্ষ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭ লক্ষ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। তাঁর দৈনিক আয় ১৬৩ কোটি টাকা।

৪।      গৌতম আদানির ছিল ১ লক্ষ ৭০ হাজার ২৩০ কোটি টাকার সম্পত্তি। এখন ৫ বছর পর তা বেড়ে হয়েছে ৬ লক্ষ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। তাঁর দৈনিক আয় ১৬০০ কোটি টাকা।

৫।      স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ছেলের সম্পদ বেড়েছে ১৫ হাজার শতাংশ। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ নভেম্বর, ‘১৯)

৬।      বিজেপি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বাবা রামদেবেরও সম্পদ ২০১৩ সালে ছিল ১১০০ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০০০ কোটি টাকারও বেশি।

৭।      বিদেশ থেকে সস্তায় কিনে শুধুমাত্র পেট্রল-ডিজেলের উপর ট্যাক্স বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪-২০২২– এই ৮ বছরে আয় করেছে প্রায় ২৬ লক্ষ কোটি টাকা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এটি অন্যতম কারণ। তেল কোম্পানিগুলি গত বছর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে ৭০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২২ এপ্রিল ’২২ এবং ইকনমিক টাইমস, ৫ ফেব্রুয়ারি ‘২৪)

৮।      পুঁজিপতিদের বিগত ১০ বছরে ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব ও কনসেশন দিয়েছে মোদি সরকার। জনগণের উপর ট্যাক্সের বোঝা বাড়িয়েে( আর পুঁজিপতিদের উপর ট্যাক্স ৬ শতাংশ কমিয়েছে। প্রতি বছর ২৮.৩ লক্ষ কোটি কালো টাকা জমছে এবং বিদেশের ব্যাঙ্কে সঞ্চিত হচ্ছে যার এক পয়সাও সরকার উদ্ধার করেনি।

৯।      দেশ-বিদেশ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ১,৬৯,৪৬, ৬৩৬, ৮৫ কোটি টাকা ঋণ করেছে যে ২০২৩ সালের বাজেটে ধারের প্রতি ১০০ টাকায় ৪০ টাকা ঋণ শোধ করতে যায়। মন্ত্রী-এমপি-এমএলএ-দের বেতন, ভাতা বেড়েই চলেছে। প্রত্যেকেই বেশ কয়েক কোটি টাকা সম্পত্তির মালিক। বাসভবন ও পার্লামেন্ট হাউস থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর শখের জন্য নতুন পার্লামেন্ট ভবন ও বাসভবন তৈরির জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।

১০।    কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি গত পাঁচ বছরে ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা এবং শুধুমাত্র ২০২২-২০২৩ অর্থবর্ষে ২.০৯ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দিয়েছে বলে অর্থমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে পার্লামেন্টে এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন।

১১।    ভারতীয় পুঁজিপতিরা ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৬,৫৩,৩৫০ কোটি টাকা বিদেশে বিনিয়োগ করেছে।

বিকশিত ভারতের আসল চিত্র

১২।    বিশ্ব ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী ২০২৩ সালে বিশ্বের ১২৫টি ক্ষুধার্ত দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১ নম্বরে। ২০১৮ সালে ছিল ১০৩ নম্বরে।

১৩।    ২৪ ঘন্টার মধ্যে খাদ্য পায়নি এমন শিশুর সংখ্যা ভারতে ৬৭ লক্ষ। বিশ্বের ১৯.৩ শতাংশ ক্ষুধার্ত শিশু নিয়ে ভারত বিশ্বে স্থান পেয়েছে আফ্রিকার গিনি ও মালির উপরে। এর মধ্যে ২৮.৪ শতাংশ রয়েছে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশে।

১৪।    এ দেশে প্রতিদিন ২০ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায়।

১৫।    বিশ্বে যত গরিব আছে, তার তিন ভাগের এক ভাগ ভারতে।

১৬।    প্রধানমন্ত্রী নিজে গরিবের উদ্ধারকর্তা হয়ে ৮১ কোটি গরিব মানুষের জন্য রেশন ঘোষণা করতে গিয়ে নিজেই পরোক্ষভাবে স্বীকার করে ফেলেছেন যে, তাঁর ঘোষিত ‘অমৃতকাল’-এ দেশের ৫৭ শতাংশ মানুষের খাদ্য কেনার পয়সা নেই।

১৭।    এ দেশে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪ লক্ষ কৃষক ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। দৈনিক গড়ে ১৫৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব রাজ্য খোদ গুজরাটে গত ৩ বছরে ২৫ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছেন যার মধ্যে ৫০০ জন ছাত্র।

১৮।    দেশে প্রতিদিন ৭ হাজার লোক অনাহারে এবং ১০ হাজার লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। ৩ হাজার শিশু অপুষ্টিতে মারা যায় প্রতিদিন।

১৯।    নারী পাচারে ও নারী ধর্ষণে ভারত বিশ্বের প্রায় শীর্ষস্থানে।

২০।    গত লোকসভা ভোটের আগে রেলে কর্মখালির বিজ্ঞাপনে ৯০ হাজার পোস্টের জন্য আবেদন করেছিলেন ১ কোটি ৫০ লক্ষ বেকার যুবক। উত্তরপ্রদেশে ৩৬২টি পিওনের পোস্টে আবেদন করেছিলেন ২৩ লক্ষ এবং তার মধ্যে ২৫৫ জন পিএইচডি ছাড়াও এমএ, এমএসসি এবং গ্র্যাজুয়েটরাও ছিলেন। সম্প্রতি সেখানে ৬০ হাজার কনস্টেবল পোস্টের জন্য ৪৮ লক্ষ আবেদন জমা হয়েছে। সেক্রেটারিয়েটে ৪১১টি পদের জন্য আবেদন করেছেন ১০৭৬০০ জন।

২১।    পশ্চিমবাংলায় ৫ হাজার ৪০০ গ্রুপ-ডি পোস্টের জন্য পরীক্ষার্থী ছিল ১৮ লক্ষ, এর মধ্যেও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, পিএইচডি ডিগ্রিধারীরাও ছিলেন।

২২।    দু’বছর আগের হিসাবে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৯ কোটি ৬০ লক্ষ থেকে কমে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ হয়েছে। বাকি ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ সর্বহারায় পরিণত হয়েছে। (পিউ রিসার্চ, ১৮ অক্টোবর ‘২৩)

২৩।   শুধুমাত্র ২০২২ সালেই ৭ লক্ষ ২৪ হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে কয়েক কোটি শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে।

২৪।    দেশের ৬০ শতাংশ লোকের দৈনিক রোজগার ১৬০ টাকা এবং ৩০ শতাংশ লোকের দৈনিক রোজগার ৮০ টাকা। একেবারে কর্মহীন বেকারের সংখ্যা ৩২ কোটি ৬ লক্ষ। (বিজনেস টুডে, ৮ সেপ্টেম্বর ‘২২)

দুর্নীতিগ্রস্তদের স্বর্গরাজ্য 

বন্ড কেলেঙ্কারিঃ ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থিক দুর্নীতি নির্বাচনী বন্ড’, বলেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর স্বামী পরাকলা প্রভাকর। এই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে বিজেপি। ৩৫টি ওষুধ কোম্পানি এই বন্ডে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঢেলেছে। অভিযোগ, এর মধ্যে দিয়ে ওষুধের দাম যথেচ্ছ বাড়ানোর ছাড়পত্র পেয়েছে তারা। ৭টি ওষুধ কোম্পানির ওষুধ গুণমানের পরীক্ষায় ফেল করার পরেই তারা নির্বাচনী বন্ড কিনে টাকা ঢেলেছে। তারপরেই ছাড়পত্র পেয়ে গেছে তারা।

৩৩টি কোম্পানি নিজেদের মুনাফার থেকেও অনেক বেশি টাকার বন্ড কিনে বিজেপি সহ নানা দলকে দিয়েছে। অভিযোগ, এদের বেশিরভাগই শেল কোম্পানি অর্থাৎ কোম্পানির খোলসটাই আছে, আসলে ভুয়ো। বৃহৎ পুঁজিপতিদের হয়ে বিজেপির তহবিলে টাকা ঢালতেই এদের সৃষ্টি বলে অভিযোগ উঠেছে।

ইডি-সিবিআই-আয়কর দপ্তরের তদন্তের আওতায় থাকা ৪১টি কোম্পানি বিজেপির তহবিলে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ঢেলেছে ২,৪৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬৯৮ কোটি টাকা ঢালা হয়েছে কোম্পানির দফতরে ইডি, সিবিআই বা আয়করের হানার তিন মাসের মধ্যে। অরবিন্দ ফার্মা, ডিএলএফ-এর মতো কোম্পানি বিজেপির ফান্ডে নির্বাচনী বন্ড ঢালার পরেই তদন্ত ঢিলে হয়ে গেছে, মালিকরা জামিন পেয়েছেন।

সর্বোচ্চ ঘুষখোর প্রশাসনঃ

‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’-এর সমীক্ষা বলছে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ‘এশিয়ার সর্বোচ্চ ঘুষখোর’ প্রশাসনের তকমা পেয়েছে ভারত। সরকারি দপ্তর থেকে কোনও সার্টিফিকেট, রেজিস্ট্রেশন, ন্যায্য সুবিধা, নামী স্কুল-কলেজে ভর্তি ইত্যাদির ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঘুষের টাকা তৈরি রেখে দরখাস্ত করতে হয়। এই প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে। (দ্য ওয়্যার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০) বিজেপি শাসনে সরকারি দপ্তরে আরটিআই করে তথ্য জানতে পারা বিরল হয়ে উঠছে। ফলে সরকারি কাজের স্বচ্ছতা কমছে। (ওই)

কর্ণাটকের খনি কেলেঙ্কারিঃ

জমি এবং খনি কেলেঙ্কারির একাধিক ঘটনায় বিজেপি নেতা ইয়েদুরাপ্পা ও রেড্ডি ভাইরা অভিযুক্ত। ৩৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। বিজেপির শীর্ষ স্তরের নেতা, পুলিশ, আমলা, বিচারক, সরকারি আইনজীবীদের ঘুষ দিয়ে বেআইনি কারবার ফাঁদার অভিযোগ একাধিক মামলায় আছে। কিন্তু সিবিআই নাকি কিছুতেই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না! তাই ‘প্রমাণ নেই’ বলে ফাইল ধামাচাপা! সম্প্রতি এই রেড্ডি ভাইদের অন্যতম একজনকে বিজেপি সাদরে গ্রহণ করেছে নতুন করে।

আসামের লুইস বার্জার’ জলপ্রকল্প কেলেঙ্কারিঃ

এক সময় অমিত শাহের নামে প্রচারিত লিফলেটে আসামের জলপ্রকল্প সংক্রান্ত লুইস বার্জার কেলেঙ্কারির জন্য বিজেপি যাঁকে অভিযুক্ত করেছিল, সেই হিমন্ত বিশ্বশর্মা এখন বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর আসন আলো করছেন। অভিযোগ, গোয়াতে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্তে সিবিআই এগোলেও আসামে পৌঁছলেই তাদের পা যেন আর চলতে চায় না!

ব্যাপম কেলেঙ্কারিঃ

মধ্যপ্রদেশে সরকারি চাকরি ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত দুর্নীতিতে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার ঘুষের কারবার হয়েছে। এর প্রতিবাদ করে এবং খোঁজ নিতে গিয়ে একাধিক সাংবাদিক সহ প্রায় ৫০ জন মানুষের রহস্যমৃত্যু ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির শিবরাজ সিং চৌহান। কোনও শাস্তি হয়নি।

ছত্তিশগড়ের রেশন কেলেঙ্কারিঃ

৩৬ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ সিং বাঘেলার আমলে। কোথায় সিবিআই? এছাড়াও রাজস্থানে বিজেপি সরকারের আমলে ৪৫ হাজার কোটি টাকার খনি দুর্নীতি, ওই রাজ্যেই বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর নামে ঢোলপুর প্যালেস দখলের অভিযোগ, ললিত মোদি, নীরব মোদি, মেহুল চোক্সি, বিজয় মালিয়া ইত্যাদি ব্যাঙ্ক লুঠেরা ও জালিয়াতদের সাথে বিজেপি নেতাদের দহরম-মহরম কেউ অস্বীকার করতে পারে না। গুজরাট স্টেট পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে দুর্নীতি, আদানি পাওয়ারকে বাড়তি ৫০ হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়ার দুর্নীতি, পিএম কেয়ার্স ফান্ড দুর্নীতি, রাফাল দুর্নীতি, বালকো দুর্নীতি, ডাল দুর্নীতিতে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গায়েব, ন্যানো কারখানার জমি নিয়ে গুজরাটে ৩৩ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি, এরকম অজস্র আছে। সম্প্রতি অযোধ্যার রামমন্দিরের জমি নিয়েও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সেই বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে নারদা, সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতারা বিজেপিতে নাম লেখানোর পর সিবিআই ইডির চোখে কেমন করে অদৃশ্য হয়ে আছেন সেটাও বেশ রহস্যের। নোট বাতিলের পর গুজরাট থেকে বিজেপির প্রাক্তন এমএলএ শচীন ওঝা ওই রাজ্যের সমবায় ব্যাঙ্ক ও বিজেপির উঁচুতলার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন। কোনও পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন কি?