নির্বাচন কমিশন সরকার–ভজা, জানা কথাটাই উঠে এল সুপ্রিম কোর্টে

নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে যে অবিশ্বাস, অনাস্থার কথা এতদিন অহরহ শোনা যেত, এবার সেই একই কথা শোনা গেল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মুখে৷ সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ প্রশ্ন তুলেছে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিয়োগের পদ্ধতি এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে৷

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে অরুণ গয়াল নামে এক আমলাকে৷ তিনি ভারী শিল্প মন্ত্রকের সচিব ছিলেন৷ তাঁর অবসর নেওয়ার কথা ৩১ ডিসেম্বর৷ কিন্তু ১৮ নভেম্বর তিনি স্বেচ্ছাবসর নেন৷ আর পরের দিনই তাঁকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ করা হয়৷ যে বিদ্যুৎ গতিতে এই নিয়োগ করা হয়েছে, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়োগ পদ্ধতি এবং উদ্দেশ্য নিয়ে বিচারপতিদের সন্দেহ দৃৃ হয়৷ নির্বাচন কমিশনের এইপদটি মে মাস থেকে খালি পড়ে ছিল৷ তা হলে হঠাৎ এত তড়িঘড়ি এক দিনের মধ্যে এমন ভাবে নিয়োগের প্রয়োজন হল কেন? বিচারপতি অজয় রাস্তোগি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যে দিন আবেদন জমা পড়ল, সে দিনই গৃহীত হল, সে দিনেই নিয়োগ হল, ফাইল পাশ হতে ২৪ ঘন্টাও লাগল না৷ কী রকম যাচাই হল?’ বিচারপতিদের বেঞ্চ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সরকারের থেকে নিয়োগের ফাইল চেয়ে পাঠায়৷

স্বাভাবিক ভাবেই জনমনেও এই প্রশ্ন উঠেছে যে, একজন আমলাকে এমন তড়িঘড়ি স্বেচ্ছাবসর করিয়ে কমিশনার পদে বসানো হল কেন? দেশে কি এই পদে বসার মতো যোগ্য লোকের অভাব পড়ে গিয়েছিল? এই প্রশ্নও উঠছে যে, বিজেপি ঘনিষ্ঠ এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র হিসাবেই কি তাঁকে বেছে নেওয়া হল?

একজন নির্বাচন কমিশনার ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত পদে থাকতে পারেন৷ ২০২৫–এ বর্তমান মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের মেয়াদ শেষ হলে গয়ালই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হবেন এবং ২০২৭ পর্যন্ত এই দায়িত্বে থাকবেন৷ এ কথা আজ আর কারও অজানা নয় যে, নিজেদের অনুগত লোকদেরই বিজেপি সরকার নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ করে৷ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার পদে এই দীর্ঘ সময়ের জন্য একজন ‘নিজেদের লোক’ বেছে নেওয়ার জন্যই কি এই তড়িঘড়ি?

অতীতেও বারবার দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থাকে সরকারি দলগুলি বারবার নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে৷ রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলিও নির্বাচন কমিশনকে একই ভাবে নিজ নিজ স্বার্থে কাজে লাগিয়ে আসছে৷ এই কদিন আগেই দেশের মানুষ দেখল হিমাচল প্রদেশের সাথে একই সঙ্গে গুজরাট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও কী নির্লজ্জ ভাবে শাসক বিজেপিকে সুবিধে পাইয়ে দিতে গুজরাটের নির্বাচন ঘোষণা পিছিয়ে দিল নির্বাচন কমিশন৷ যত দিন পর্যন্ত না প্রধানমন্ত্রীর সব শিলান্যাস, প্রকল্পের উদ্বোধন শেষ হয়েছে তত দিন নির্বাচনের দিন ঘোষণা আটকে রাখা হয়েছে৷ বাস্তবিক কংগ্রেস আমল থেকেই নির্বাচন কমিশন এ ভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার হয়ে আসছে৷ এ রাজ্যেও সিপিএমের আমলে নির্বাচনের নামে ছাপ্পা, বুথ দখল, সন্ত্রাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে যখন নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে, জনগণ যখন কমিশনের কাছ থেকে একটা কড়া পদক্ষেপ আশা করেছে, তখন প্রায় সব সময়ই দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনের ফাটা রেকর্ড বেজেছে–দু–একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণই হয়েছে৷ তৃণমূল শাসনে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্য জুড়ে প্রবল সন্ত্রাস তৈরি করে বিরোধীদের দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি৷ কয়েক মাস আগে কলকাতা কর্পোরেশন সহ রাজ্যের সর্বত্র নির্বাচনে দুষ্কৃতীদের রিভলবার হাতে ছোটাছুটির ছবি টিভিতে এবং খবরের কাগজে ছাপা হলেও এ–সব কোনও কিছুই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের চোখে পড়েনি৷ অর্থাৎ ভোটসর্বস্ব সংসদীয় দলগুলি যে যখন সুযোগ পায় নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো করে রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগায়৷ স্বাভাবিক ভাবেই জনমনে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে৷ জনগণ ধরেই নিয়েছে, যে যখন যেখানে ক্ষমতায় থাকবে এ ভাবেই কমিশনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে৷

অবশ্য গণতন্ত্র জাহান্নামে গেলেও এই সব দলগুলির কিছু যায় আসে না৷ শুধু নির্বাচন কমিশনই বা কেন, নিরপেক্ষ প্রায় সব সংস্থাগুলিতেই বিজেপি–আরএসএস নিজেদের লোক বসিয়ে সেগুলিকে কুক্ষিগত করছে৷ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টরিক্যাল রিসার্চ থেকে বিজ্ঞান কমিশন সব জায়গাতেই এখন আরএসএসের লোক৷ সমস্ত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আরএসএসের লোকদেরই উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ করা হচ্ছে৷ হাইকোর্টের বা সুপ্রিম কোর্টের যে বিচারপতিরা নিরপেক্ষ ভূমিকা নিচ্ছেন বা যাঁদের রায় সরকারের পছন্দ হয়নি তাঁদের বদলি করে দেওয়া হচ্ছে বা পদোন্নতি আটকে রাখা হচ্ছে৷ ঠিক একই রকম ভাবে বিজেপি–আরএসএসের হিন্দুত্বের কর্মসূচি কার্যকর করতে নতুন ইতিহাস লেখার নামে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাতে ইতিহাস কমিশনকে কাজে লাগানো হচ্ছে৷ যেমন অযোধ্যার রামমন্দিরে রামের মাথায় সূর্যের প্রথম আলো ফেলতে কাজে লাগানো হচ্ছে সিএসআইআর–কে৷ অথচ এই বিজ্ঞান সংস্থাটি গড়েই উঠেছিল জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানচিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে৷ বাস্তবে তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে অন্ধতা আর কুসংস্কার ছড়াতে৷ ফলে নির্বাচন কমিশনে নিজেদের পছন্দের লোক বসিয়ে নিয়মকানুন–বিধি সব যেমন শাসকদের পছন্দমতো তৈরি হয়ে যাচ্ছে, বিজেপি নেতারা চরম অন্যায়, অগণতান্ত্রিক, বেআইনি কিছু করলেও কমিশন ঠুঁটো হয়ে থাকছে, তেমনই বিরোধীদের শায়েস্তা করতে কমিশনকে অতি তৎপর ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে৷

এই রকম পরিস্থিতিতে নানা মহল থেকে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগে স্বচ্ছতা চেয়ে এবং যাতে নির্বাচন কমিশন দলীয় নিয়ন্ত্রণের দ্বারা পরিচালিত না হয়, যাতে তা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে, সেই আবেদন নিয়ে একগুচ্ছ মামলা হয়েছিল৷ এই মামলাতেই সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ, নির্বাচন কমিশনার এবং মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বেছে নেওয়ার প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের ধাঁচে কলেজিয়াম ব্যবস্থা চালু করা যায় কি না এবং সেই প্রক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতি উপস্থিত থাকতে পারেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে৷

বাস্তবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চালু রাখার একটি অন্যতম অঙ্গ হিসাবে এসেছিল নির্বাচন কমিশন৷ কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী চরিত্র অর্জন করার পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সব অঙ্গকেই আজ দু–পায়ে মাড়িয়ে চলেছে৷ পুঁজির চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবনের মধ্য দিয়ে নূ্নতম গণতান্ত্রিক অধিকারও আজ পুঁজিপতি শ্রেণির কাছে বর্জনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষায় শাসক দলগুলি যে নগ্ন ভূমিকা নিয়ে চলেছে তাতে জনস্বার্থকে নগ্ন ভাবে বলি দেওয়া হচ্ছে৷ তাই শাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জনগণের সমর্থন লাভ আজ আর তাদের কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না৷ কারচুপি, জালিয়াতি, অর্থবল, পেশির জোর, পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়ার ব্যবহার ছাড়া জেতার তাদের আরও কোনও রাস্তাই খোলা নেই৷ এই রকম অবস্থায় স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন স্বাভাবিক ভাবেই শাসকদের ঘোর অপছন্দের৷

কিন্তু পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করে ক্ষমতায় টিকে থাকা শাসক দলগুলির নির্বাচন কমিশনকে এমন ইচ্ছামতো ব্যবহার জনগণ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না৷ স্বাধীন চিন্তামতো ভোটাধিকার প্রয়োগ প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার৷ বুর্জোয়া শ্রেণি আজ নিজেদের তৈরি সংবিধানকে নিজেরাই মাড়িয়ে যাচ্ছে৷ এই অবস্থায় গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের সাথেই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার দাবি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং জরুরি৷