ডি এ মেটানো, স্বচ্ছ নিয়োগ ও অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ী করার দাবিতে ১০ মার্চ ধর্মঘট

১০ মার্চ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, চিকিৎসক, নার্স, সরকারি কর্মচারী সহ রাজ্যের নানা পেশার শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠন সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। তাদের দাবি, সর্বভারতীয় মূল্যসূচক অনুযায়ী প্রাপ্য বকেয়া সহ ডি এ মেটানো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের শূন্যপদে স্বচ্ছভাবে নিয়োগ ও অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ী করা।

সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ২০২২ সালের ১ জুলাই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারী ইউনিয়ন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ইউনিয়ন, নার্সেস ইউনিটি, বিপিটিএ, এসটিইএ, সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম, উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচারস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট অ্যাসিস্ট্যান্টস, ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (নব পর্যায়) সহ ২৮টি সংগঠনকে নিয়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল এই সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। বর্তমানে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চে সংগঠনের সংখ্যা ৫১, যা ক্রমাগত বাড়ছে। গত ২৭ জানুয়ারি থেকে শহিদ মিনারের পাদদেশে লাগাতার অবস্থান ও অনশন চালিয়ে যাচ্ছে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছে এবং আন্দোলনের তীব্রতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনশনরত অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের পাশাপাশি, সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের সাথে নেই এমন সরকারি কর্মী ও শিক্ষকদের সংগঠন নিয়ে গঠিত যৌথ মঞ্চও ১০ মার্চ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের অনুগামী সংগঠন বাদে সমস্ত সংগঠন এই ধর্মঘটে সামিল।

এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)। এআইইউটিইউসি সহ ৮টি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন এই ধর্মঘটকে সমর্থন করে রাস্তায় নেমেছে। ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও ওই দিনেই ৮ হাজার ২০৭টি স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল এবং জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ বাতিলের দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছে।

প্রাপ্য ডিএ না পাওয়ার সমস্যা সিপিএম আমল থেকেই চলছে। বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলেও প্রাপ্য ডিএ-র দাবিতে এবং শূন্যপদ পূরণ করার দাবিতে আন্দোলন চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনের গতিপথে গড়ে উঠেছে এই সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। রাজ্য সরকারি দপ্তর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদ আছে প্রায় ১০ লক্ষ, যার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৬ লক্ষ পদ শূন্য। বামফ্রন্ট জমানা থেকেই শূন্যপদে নিয়োগ প্রায় বন্ধ। অনেক পদ তুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, যতটুকু নিয়োগ হয়েছে, তাও দুর্নীতিতে ভরা। যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের বঞ্চিত করে টাকার বিনিময়ে চাকরি বেচাকেনা হচ্ছে। এই দুর্নীতির কোটি কোটি টাকায় স্ফীত শাসক দলের প্রভাবশালীরা। ৬০ শতাংশ পদ শূন্য হওয়ায় সরকারি কাজকর্ম বা জনপরিষেবা প্রবলভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এই ধর্মঘট কর্মচারীদের পেশাগত দাবিতে ডাকা হলেও এর সঙ্গে জনস্বার্থ গভীরভাবে জড়িত। মঞ্চের আহ্বানে ২৭ জানুয়ারি মহামিছিলের শেষে শহিদ মিনার ময়দানে শুরু হয় লাগাতার অবস্থান বিক্ষোভ ও ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে লাগাতার অনশন। এই অবস্থান মঞ্চে সংহতি জানাতে গিয়েছিলেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও প্রাক্তন সাংসদ ডাঃ তরুণ মণ্ডলের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল। আন্দোলনের প্রথম দিন থেকে একাধিকবার এআইইউটিইউসি-র রাজ্য নেতৃত্ব অবস্থান মঞ্চে যান সংহতি জানানোর জন্য। সেখানে নেতৃবৃন্দ বলেন, কোর্ট কেস কখনও কখনও প্রয়োজনীয় হলেও, লাগাতার শক্তিশালী আন্দোলন ছাড়া কোনও সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করা যায় না। নেতৃবৃন্দ দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী শক্তিশালী শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলন গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এ পথেই দাবি আদায় করা সম্ভব। ধর্মঘটকে সমর্থন করে এআইইউটিইউসি-র পক্ষ থেকে ৬ মার্চ মঞ্চের উদ্দেশে চিঠি দেওয়া হয়।

সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের আহ্বানে ২৭ জানুয়ারি গণছুটি, ১ ফেব্রুয়ারি দু’ঘন্টার কর্মবিরতি, ১৩ ফেব্রুয়ারি এক দিনের কর্মবিরতি ও ২০-২১ ফেব্রুয়ারির দু’দিনের কর্মবিরতিতেও জেলায় জেলায় ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক সহ হাজার হাজার কর্মচারী সরকারি দমন পীড়ন উপেক্ষা করে আন্দোলনের নয়া ইতিহাস তৈরি করেছেন। এই আন্দোলনের চাপে রাজ্য সরকার বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিনেই বকেয়া ৩৯ শতাংশ ডি এ-র মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ ডি এ ঘোষণা করে। কিন্তু আন্দোলনকারী শ্রমিক-কর্মচারীরা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং পূর্ণ ডিএ-র দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

ধর্মঘটের প্রচার করতে গেলে শাসক দলের দুষ্কৃতীরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ নামিয়ে আনছে। শুধু তাই নয়, ধর্মঘটকে বানচাল করার জন্য সরকার হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের আহ্বায়ক বিশ্বজিৎ মিত্র সহ অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে। পুলিশ পাঠিয়ে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের অনেক নেতার বাড়িতেই ভয়-ভীতি দেখানো শুরু হয়েছে। সমস্ত শাসকরাই শ্রমিক কর্মচারীদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনকে ভয় পায় এবং তারা এই সংঘবদ্ধ আন্দোলনকে ভাঙতে সমস্ত রকম জুলুম অত্যাচার নামিয়ে আনে শ্রমিক-কর্মচারীদের উপর। পূর্বের কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম পরিচালিত সরকারের মতো বর্তমান তৃণমূল সরকার সেই রাস্তাতেই হাঁটছে। সমস্ত ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে ও বিভেদকামী শক্তিকে পরাস্ত করে ১০ মার্চের ধর্মঘট সফল করার জন্য সর্বস্তরের শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, সরকারি কর্মচারীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন মঞ্চের নেতৃবৃন্দ। তাদের প্রত্যাশা, সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই আহ্বানে সাড়া দেবেন এবং এই আন্দোলনকে বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন।