জানেন কি, স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল আরএসএস

বিজেপি নেতারা ক্ষমতায় এসে নিজেদের জাতীয়তাবাদের চ্যাম্পিয়ন হিসাবে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। কেন তাঁদের এই মরিয়া চেষ্টা? তবে কি গোড়াতেই কোনও গলদ আছে? দেখা যাক বিজেপির পূর্বসূরী হিন্দু মহাসভা এবং আদর্শগত অভিভাবক আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে কী ভূমিকা নিয়েছে।

১৯০৯ সালে গোপালকৃষ্ণ গোখলে পাঞ্জাবে হিন্দু সভা গঠন সম্পর্কে বলছেন, ‘‘এই আন্দোলন খোলাখুলি মুসলমান বিরোধী, যেমন মুসলিম লিগ খোলাখুলি হিন্দু বিরোধী এবং উভয়েই জাতীয়তাবাদ বিরোধী।’’

১৯১৯-এ পাঞ্জাবের অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশের চালানো গণহত্যার পর সারা দেশ যখন এই গণহত্যার নিন্দায় মুখর তখন ‘পাঞ্জাব হিন্দু সভা’ রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। শুধু তাই নয়– ইতিহাস দেখাচ্ছে, জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর সত্যাগ্রহের নামে ‘এই অরাজকতার নিন্দা’ করে তারা ব্রিটিশের প্রতি ‘গভীর আনুগত্যের’ শপথ নিয়েছিল (কে এল তুতেজা- ‘দ্য পাঞ্জাব হিন্দু মহাসভা অ্যান্ড কমিউনাল পলিটি’, ১৯০৬-১৯২৩, ফ্রন্টলাইন ১৪ মার্চ ২০০৩-নিউ ব্র্যান্ড অফ হিস্ট্রি, বিশ্বমোহন ঝা)। ব্রিটিশ রাজের ভারত আগমনকে প্রণতি জানিয়ে তারা বলেছিল, ‘ঈশ্বরের অসীম কৃপায় আর্যজাতির গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা যা সুদূর অতীতে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, আবার এক হতে পেরেছে। এক জাতি অপরটিকে রাজনৈতিক পথনির্দেশ এবং সুরক্ষা প্রদান করছে। যে সাম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্ত যায় না, তার প্রজা হিসাবে আমরা গর্বিত এবং এই প্রাপ্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রমাণ করতে আমরা সর্বদাই সচেষ্ট।’ (ওই)

১৯২৫-এ নাগপুরে প্রতিষ্ঠা হয় আরএসএস। তখন থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও কিছুতে অংশ নেওয়া দূরে থাক, তার বিরোধিতা করে গেছে তারা। আরএসএস-এর তাত্ত্বিক নেতা গোলওয়ালকার বলছেন, ‘‘… আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এই কথাই বলে যে, সমস্ত কিছু করেছে একমাত্র হিন্দুরা। এর অর্থ কেবল হিন্দুরাই এই মাটিতে সন্তান হিসাবে এখানে বসবাস করেছে’’ (চিন্তাচয়ন, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২৩-২৪)। অথচ সেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আরএসএসের বক্তব্য কী? এই গোলওয়ালকর স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধাদের অভিহিত করেছেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে। তারই পাশাপাশি দাঙ্গাকারীদের দেখিয়েছেন ‘দেশপ্রেমিক’ হিসাবে। হেডগেওয়ার তাঁর ‘তাত্ত্বিক’ বই ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’-এ মুসলমান বিদ্বেষের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নীরব। বইটির একটি মাত্র অনুচ্ছেদে ব্রিটিশ শাসনের উল্লেখ রয়েছে। এই উল্লেখটির উদ্দেশ্য হল ‘ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদের’ তীব্র সমালোচনা করা। তিনি বলেছেন, ‘‘আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ ও সর্বজনীন বিপদের তত্ত্ব থেকে আমাদের জাতিত্বের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। তার ফলে আমাদের প্রকৃত হিন্দু জাতিত্বের সদর্থক অনুপ্রেরণা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু আন্দোলনই নিছক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধিতার সঙ্গে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করে দেখা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, তার নেতৃবর্গ এবং সাধারণ মানুষের ওপরে এই প্রতিক্রিয়াশীল মতের প্রভাব সর্বনাশা হয়েছে।’’ তিনি বলছেন, ‘‘স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকগুলিকেই কার্যত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করা হয়েছিল। ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হয়েছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের ওপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছে (চিন্তাচয়ন, ১ম খণ্ড, পৃঃ১২৫)।’’

আরএসএস-এর অন্যতম নেতা ডাঃ কেশবরাও হেডগেওয়ার বা ডাক্তারজি বলছেন, ‘‘অদ্ভূত, ভারী অদ্ভূত যে, বিশ্বাসঘাতকদের জাতীয় বীররূপে সিংহাসনে বসানো হয় এবং দেশপ্রেমিকদের উপর কলঙ্ক নিক্ষেপ করা হয়।’’ আর এস এস প্রকাশিত তাঁর জীবনীগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘‘১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্যের ডাক দিয়েছিলেন। ডাঃ হেডগেওয়ার সব জায়গায় খবর পাঠালেন, এই সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করবেন না। … এর অর্থ হল সংঘের কোনও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।’’ (সি পি ভিশিকর, ডাঃ কেশব রাও হেডগেওয়ার, নিউ দিল্লি, ১৯৯৪, পৃঃ ২০)। এই জীবনী গ্রন্থই দেখাচ্ছে, যে যুবকরা তাঁর কাছে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পরামর্শ নিতে আসত, তিনি তাদের নানাভাবে নিরুৎসাহিত করে সংঘে যোগ দিতে বলতেন। তা হলে তিনি নিজেই অমান্য আন্দোলনে হঠাৎ যোগ দিয়েছিলেন কেন? সেখানেও ছিল আন্দোলনকে ভাঙার পরিকল্পনা। ইতিহাস বলছে, ‘‘ডাক্তারজি চিন্তা করে দেখলেন যে এই সময়ে সম্পূর্ণ সমাজের মন্থন হয়ে দেশভক্তিপূর্ণ যথার্থ কর্মকর্তারা কারাগারের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই একত্রিত হবেন। যদি এই রকম সম্ভাবনাময় তথা দেশভক্তির ভাবনাযুক্ত তরুণ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠতা লাভের সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে সংঘের দিক থেকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে এক এক জনকে খুঁজে বেড়াবার থেকে অধিক লাভজনক কাজ হবে।’’ (জীবন চরিত, ডাঃ হেডগেওয়ার, নারায়ণ হরি পালকর, প্রথম সংস্করণ, পৃঃ ২০৬)।

উল্লেখ্য, আরএসএস-এর ছয়টি উৎসব বা পরবের মধ্যে চারটিই হিন্দুদের প্রথাগত উৎসব এবং একটিতেও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কথা নেই।

আরএসএস-বিজেপির আইকন হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর প্রথম জীবনে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করলেও অল্পদিনের মধ্যেই সে পথ ছেড়ে দেন। ১৯২০-এর দশকের সমসাময়িককাল থেকে তিনি ‘হিন্দুত্বের’ তাত্ত্বিক নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ব্রিটিশ বিরোধিতা ত্যাগ করেন। এই সময় তিনি ব্রিটিশের কাছে মুচলেকাও দেন। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সাভারকর বিভিন্ন পৌর ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, আইনসভা এবং বিভিন্ন চাকরিতে হিন্দু মহাসভার সদস্যদের–নিজ নিজ পদে অবিচল থেকে দৈনন্দিন কাজকর্ম করে যেতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময়ে তাঁর স্লোগান ছিল, ‘রাজনীতির হিন্দুকরণ এবং হিন্দুধর্মের সামরিকীকরণ।’ যখন সারা দেশের জনগণ ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে আন্দোলনে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, আজাদ হিন্দ বাহিনী নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে জীবনপণ করে লড়ছে, সেই সময় সাভারকর ১৯৪১-এ হিন্দু মহাসভার ভাগলপুর অধিবেশনে বলছেন, ‘‘…ভারত সরকারের সমস্ত যুদ্ধ প্রস্তুতিকে হিন্দুদের অবশ্যই দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন করতে হবে’’ (সাভারকর সমগ্র, খণ্ড ৬, মহারাষ্ট্র প্রান্তিক হিন্দুসভা প্রকাশিত, পৃঃ ৪৬০)। সাভারকরের না জানার কথা নয় ব্রিটিশের হয়ে যুদ্ধ মানে তখন উত্তরপূর্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা। কিন্তু তিনি ডাক দিচ্ছেন, ‘‘…হিন্দু বন্ধুরা আসুন, হাজারে হাজারে লাখে লাখে যোগ দিন সামরিকবাহিনীতে, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীতে।’’ (বিনায়ক দামোদর সাভারকরস হোয়াইরল উইন্ড প্রোপাগান্ডা–এএস ভিডে, পৃঃ২৬)। এই গোলামির পুরস্কার হিসাবে ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে সাভারকরের পছন্দমতো লোক মনোনীত করা হয়েছিল। তিনিও ভাইসরয়কে টেলিগ্রাম করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। (ওই, পৃঃ ৪৫১)

১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে হিন্দু মহাসভার নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেছিলেন, ‘‘আমি মনে করি না যে, গত তিন মাসের মধ্যে যেসব অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা এবং নাশকতামূলক কাজ করা হয়েছে তার দ্বারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভে সহায়তা হবে।’’ আরও একধাপ এগিয়ে তিনি মিত্রশক্তিকে অর্থাৎ ব্রিটিশকে সহযোগিতা করার কথাও বলেছিলেন, ‘‘এখন যুদ্ধকালীন অবস্থায় ভারতবর্ষের … জাতীয় গভর্নমেন্ট এমনভাবে গঠিত হবে, যাতে মিত্রপক্ষের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতার সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব হবে।’’ (রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী)। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর একটি চিঠি সংযুক্ত করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে শ্যামাপ্রসাদ লিখছেন ব্রিটিশের বিপদ তাঁদেরও বিপদ। আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারকে লিখছেন, ‘‘বঙ্গদেশকে রক্ষা করিবার জন্য একটা গৃহবাহিনী গঠনের অধিকার আমাদের দেওয়া হউক। … বর্তমানে প্রবল বিপদ আমাদের দ্বারে হানা দিয়াছে। … আজ আমাদের গুরুতর প্রয়োজনের সময়েও যদি সৈন্যবাহিনী গঠনের অধিকার দিতে আপনারা অস্বীকৃত হন তবে ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিচারে আপনারা অপরাধী বলিয়া সাব্যস্ত হইবেন।’’ প্রসঙ্গত, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর গঠিত জনসংঘ থেকেই জন্ম বিজেপির।

সংঘ পরিবারের ব্রিটিশ সহযোগিতার আরও স্পষ্ট প্রমাণ মেলে ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তর থেকে। ১৯৪০ সালের ২ ডিসেম্বর বম্বে প্রদেশের স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আরএসএস নেতা অভয়ঙ্কর ও অন্যান্যদের আলোচনার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নোটে বলা হয়েছে, ‘অভয়ঙ্কর আরএসএস-এর পোশাক, কুচকাওয়াজ ইত্যাদি বিষয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দান করেন। তিনি আরও প্রতিশ্রুতি দেন যে, সংঘ তার সদস্যদের বৃহত্তর সংখ্যায় সিভিক গার্ডে যোগ দিতে উৎসাহ দেবে। এই মর্মে বোঝাপড়া হয় যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্যরা সিভিক গার্ডে যোগদান করলে সিভিক গার্ডের প্রতি তাদের দায়িত্বকে সার্বভৌম বলে গ্রহণ করবে।’ ’৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪, বোম্বের স্বরাষ্ট্র সচিব এইচ ভি আঙ্গোয়ার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে জানান যে, ‘সংঘ নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেকে সরকারি আইনের চৌহদ্দির মধ্যে রেখেছে ও বিশেষ উল্লেখযোগ্য, ১৯৪২ সালে যে গোলমাল শুরু হয়েছিল সংঘ তাতে কোনও রকম অংশগ্রহণ করেনি।’ ১৯৪৬ সালের ১৯ জুন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তরের একটি নোটে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সংগ্রাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়। হিন্দু মহাসভার ১৯৩৩ সালের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ভাই পরমানন্দ অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘‘সরকারের বিরোধিতা করে সরকারি শুভদৃষ্টি হারানো হিন্দুদের অনুচিত হবে। বিশেষত যখন সরকার দৃঢ়ভাবে ক্ষমতাসীন এবং কৃপা করার মনোভাবও সরকারের আছে।’’ ১৯৩৯ সালে ভি ডি সাভারকর গোপনে ভাইসরয়কে জানান যে, ‘‘ব্রিটিশ ও হিন্দুদের পরস্পর বন্ধু হওয়া উচিত।’’

১৯৪২-এর আন্দোলনে বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী কী ভূমিকা নিয়েছিলেন? তিনি ওই বছর ২৭ আগস্ট যুক্তপ্রদেশের (এখন উত্তরপ্রদেশ) আগ্রা জেলার বটেশ্বর গ্রামে হওয়া গণবিক্ষোভের ব্যাপারে পুলিশকে মুচলেকা দিয়েছিলেন ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪২। তিনি আন্দোলনের নেতা লীলাধর বাজপেয়ীর নাম ফাঁস করে দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর বয়ান, ‘‘আমি একজন দর্শক ছিলাম ও সরকারি ভবন ভাঙার কাজে আমি কোনও ভাবেই অংশগ্রহণ করিনি এবং লীলাধর বাজপেয়ী ছাড়া আর কারুর নাম আমি জানি না।’’ এই স্বীকারোক্তি পুলিশ সরাসরি আদালতে পেশ না করলেও এই বয়ানকে ভিত্তি করেই সরকারি উকিল সওয়াল করেছিলেন। ফলে লীলাধর বাজপেয়ীর ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয় ও গোটা গ্রামের ১০ হাজার টাকা জরিমানা হয়।

দেশভাগের জন্যও মুসলিম লিগের সাথে সমান দায়ী আরএসএস-হিন্দুমহাসভা ও জনসংঘ। মুসলিম লিগ ১৯৪০-এর ২৩ মার্চ তাদের লাহোর অধিবেশনে দেশভাগের দাবি তুলেছিল। কিন্তু তার ঢের আগে ১৯২৩-এ সাভারকর ‘হিন্দুত্ব’ নামক বইতে এই দ্বিজাতি তত্তে্বর অবতারণা করেছিলেন। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক পথে ভারত বিভাগের ধারণাটির উদ্ভাবনের জন্য বিপুল পরিমাণে দায়ী হল হিন্দু মহাসভা।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুসলিম লিগ সাভারকরের ওই বক্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করেছিল।’ উল্লেখ করা দরকার, হিন্দু মুসলিম বৈরিতার যত স্লোগানই জনসংঘ এবং হিন্দু মহাসভা তুলুক না কেন, তারা দীর্ঘদিন ব্রিটিশ রাজত্বের শেষভাগে বাংলায় এবং একসময় সিন্ধুপ্রদেশেও মুসলিম লিগের সাথে যৌথ সরকার চালিয়েছে।

এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন বলিষ্ঠ যোদ্ধা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই ভূমিকা দেখেই বলেছিলেন, ‘‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোটভিক্ষায় পাঠিয়েছে। ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দুমাত্রেই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেরই এর নিন্দা করা কর্তব্য। … এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন। তাদের কথা কেউ শুনবেন না।’’ (১৯৪০ ঝাড়গ্রামের ভাষণ) নিজেদের এই ইতিহাস নিয়েই আজ আরএসএস-বিজেপি দেশপ্রেমের পাঠ দিচ্ছে জনগণকে!