নজরুলের গানের এই বিকৃতি অপরাধ

সম্প্রতি ‘পিপ্পা’ সিনেমায় ব্যবহৃত বিপ্লবী কবি নজরুল রচিত ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানের বিকৃতি প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ১৯২৪-এর মে মাসে তারকেশ্বরের ঘটনা। সেদিন নজরুলের গানে উদ্বেলিত হয়ে মোহন্তদের নিযুক্ত লাঠিয়ালদের সর্দার লাঠি নামিয়ে রেখে শপথ নিয়েছিলেন দেশের মানুষের বিরুদ্ধে লাঠি না ধরার।

মনে পড়ে, কলকাতার অ্যালবার্ট হলে নজরুলের সংবর্ধনা সভায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে, আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।’ বাস্তবে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুলের গান, কবিতা উদ্দীপনা অনুপ্রেরণার মশাল হয়ে জ্বলে উঠেছে বারবার। যে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটির বিকৃতিকে ঘিরে আজ প্রশ্ন উঠেছে, সেই ‘ভাঙার গান’-এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা বারুদের স্তূপকে চিনতে কিন্তু দেরি করেনি সে দিনের ব্রিটিশ সরকার। প্রকাশের সাথে সাথে এই গান তারা বাজেয়াপ্ত করেছে।

১৯২৯ সালের ২৩ আগস্ট ‘নবশক্তি’ পত্রিকার সম্পাদককে লেখা চিঠিতে নজরুল ইসলাম তাঁর নিজের গানের কথা ও সুরের বিকৃতি নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন। নজরুল লিখছেন, ‘… একদিন একজন রেডিও স্টার আমার ‘আমারে চোখ ইশারায়’ গানটার ল্যাজা-মুড়ো হাত-পা নিয়ে এমন তাল পাকিয়ে দিলেন যে তা দেখে মনে হল, বুঝি বা গানটার ওপরে একটা মোটরগাড়ি চলে গেছে। …’ ‘পিপ্পা’ চলচ্চিত্রে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি নিয়ে যে ছেলেখেলা করা হয়েছে, তা ওই গানের ওপর দিয়ে মোটরগাড়ি চলে যাওয়ার সামিল।

চলচ্চিত্রে এই গান ব্যবহার হয়েছে আগেও। ১৯৪৯ সালে নির্মল চৌধুরি পরিচালিত ছবি ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন।’ সেখানে একটি দৃশ্যে নজরুলের এই গান গাইছেন ব্রিটিশ জেলে বন্দি বিপ্লবীরা। শুনলে আজও শিহরণ জাগে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্রিটিশ পদানত ভারতবর্ষে বিপ্লবীদের অদম্য তেজ, কারাগারের বন্ধনকে পরোয়া না করার বিপ্লবী স্পর্ধা। ১৯৭০-এ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার এবং মুক্তিযোদ্ধা জহির রায়হান তাঁর ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করেছিলেন। জেলবন্দি মুক্তিযোদ্ধারা কারার ওই লৌহকপাট গাইছেন, প্রত্যয়ে জ্বলে উঠছে তাঁদের চোখ। সাম্প্রতিক কালের ‘উইংকল টুইংকল’ নাটকের শেষ দৃশ্যেও এই গানের চমৎকার প্রয়োগ দেখেছি আমরা। গানটি একাত্ম হয়ে আছে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাহস, শাসকের বন্দিশালা ভেঙে বেরিয়ে আসার তেজের সাথে। নজরুল ইসলামের এই ঐতিহাসিক সৃষ্টিকে কোথাও ব্যবহার করতে চাইলে সবার আগে গানের এই বিদ্রোহী সত্তার প্রতি, বিপ্লবী তেজের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে যখন গ্রেপ্তার করেছে ব্রিটিশ পুলিশ, তাঁর সম্পাদিত ‘বাঙ্গালার কথা’ পত্রিকার জন্য দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে এই গান লিখছেন নজরুল। যে নজরুলের কলমকে থামাতে ব্রিটিশের কারাগার তাঁকে বন্দি করেছে, জেলে বসেও যে বিদ্রোহী কবি অনশন-আন্দোলন জারি রেখেছেন। ‘ওরে ও তরুণ ঈশান বাজা তোর প্রলয় বিষাণ ধ্বংস-নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি’ বা ‘দে রে দেখি ভীমকারার ওই ভিত্তি নাড়ি’– এমন আগুনঝরা আখর যে গানের, তার সুর বদল করে খেয়ালখুশি মতো যে কোনও প্রেক্ষিতে নিছক বিনোদনের উপকরণ হিসাবে এ গান জুড়ে দেওয়া শুধু অজ্ঞতা নয়, অপরাধ। ‘পিপ্পা’য় ঠিক সেটাই করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে মুক্তি আকাঙক্ষার উন্মেষ, তারই ধারাবাহিকতায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগণ বুকের রক্ত ঢেলেছিলেন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ’র শৌর্য, আত্মবলিদানের ইতিহাস আজও শোষিত মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা। ‘পিপ্পা’ ছবিটি ‘মুক্তিযুদ্ধে’র যথার্থ ইতিহাসের সাথেও প্রতারণা করেছে। এ ছবিতে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের শোষিত জনগণ নয়, ভারতীয় সেনারা সে দেশের মুক্তিযুদ্ধটা যেন লড়ে দিচ্ছে, সে দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে তুলছে, যুদ্ধ করতে শেখাচ্ছে যেন শুধু তৎকালীন ভারত সরকারের বদান্যতাতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের এই যুদ্ধে তেমন কোনও ভূমিকা কিছু নেই– এই হচ্ছে মোটামুটি ছবির বয়ান। সেখানে ভারতীয় সেনা অফিসারদের মনোরঞ্জনের জন্য একটি নাচগানের আসরে মুক্তিযোদ্ধারা এমন অদ্ভূত পীড়াদায়ক সুরে ঝিমিয়ে পড়া তালে ছন্দে এই গান গাইছে। অর্থাৎ যা ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জাগানো উদ্দীপনার গান, তাকে নামিয়ে আনা হল যে কোনও একটি আসরের গানের স্তরে। এক কথায় গানটি থেকে তার ইতিহাস এবং প্রাণসত্তাকে উপড়ে ফেলা হল। এবং তা সংলগ্ন হয়ে রইল এমন একটি ছবির সাথে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের আবরণে আজকের উগ্র দেশপ্রেমের ছবির মতো রাষ্ট্রের সেনামাহাত্ম্য বর্ণনাই মূল উদ্দেশ্য। কাজেই, ‘কারার ওই লৌহকপাট’-এর এই প্রয়োগকে ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’, ‘মানুষ না চাইলে শুনবে না’, ‘পরিবারের অনুমতি’ বা ‘কপিরাইট’ এসব প্রশ্ন দিয়ে লঘু করে দেখা চলে না। ছবির আখ্যান এবং উপস্থাপনার সাথে যুক্ত করেই একে বিচার করতে হবে। কোনও কালজয়ী শিল্পসৃষ্টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেউ করতেই পারেন, কিন্তু তা করতে হবে সেই সৃষ্টির মর্মবস্তুকে অক্ষুণ্ন রেখে তার আবেদনকে আরও জোরালো, কার্যকরী করার উদ্দেশ্যেই। পিপ্পা ছবিতে গানটি ব্যবহারের এমন কোনও উদ্দেশ্য ছিল না এবং স্বভাবতই গানটি কোনও আবেদন তৈরি করতে পারেনি, বরং সচেতন রসিক শ্রোতার বিরক্তি উৎপাদন করেছে। সঙ্গতভাবেই বহু মানুষ এবং শিল্পী-সাংস্কৃতিক সংগঠন এর প্রতিবাদ করেছেন, গানটি প্রত্যাহারের বা প্রয়োজনে মূল সুর ও ভাব অক্ষুণ্ন রেখে ব্যবহারের দাবি উঠেছে।

এ আর রহমানের মতো গুণী সুরকার নজরুল ইসলামের জীবন ও রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে কিছু না জেনেই এমনটা করে ফেলেছেন এ কথা বিশ্বাস করা কষ্টকর। বরং নিজের ক্ষমতাকে তিনি যেভাবে ব্যবহার করলেন বা ব্যবহৃত হতে দিলেন, তা খুবই দুঃখজনক। এই ঘটনা আবারও শিখিয়ে গেল, শিল্পীর দক্ষতা এবং প্রতিভার সাথে তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নটিও অত্যন্ত জরুরি।