চিনের বিক্ষোভ আসলে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধেই

গত নভেম্বরের শেষ দিকে সারা চিন জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ ফেটে পড়েছিল। রাজধানী বেজিং সহ নানা শহরে, অন্তত ১৫টি প্রদেশে এবং কমপক্ষে ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিক্ষোভ ছড়িয়েছিল। প্রাথমিকভাবে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত অতি কড়াকড়ি নিয়ে জনগণের ক্ষোভই এর প্রধান কারণ। ক্ষোভের আগুন উস্কে দিয়েছে জিনজিয়াংয়ে কোভিডজনিত লকডাউনে সরকারি নির্দেশে তালাবন্ধ একটি বহুতল বাড়িতে আগুন লেগে দশজন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা।

বিক্ষোভে এমনকি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। বিক্ষোভরত ছাত্রদের যতটুকু বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা চরম হতাশ, চাকরির সঙ্কট নিয়ে তারা প্রবল চিন্তিত। প্রথম দিকে চিনা সরকার উপেক্ষার অস্ত্রে বিক্ষোভকে স্তিমিত করার চেষ্টা করেছিল। তাতে ব্যর্থ হয়ে ব্যাপক সংখ্যায় বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার এমনকি রাস্তায় সামরিক ট্যাঙ্ক নামিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টাও করেছে। কিন্তু বিক্ষোভের তীব্রতার সামনে চিনা কর্তৃপক্ষ লকডাউন শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে।

পুঁজিবাদের রোগ-লক্ষণ ফুটে বেরিয়েছে দগদগে হয়ে

কিন্তু চিনের জনগণ কোভিডজনিত বিপদের কথা জেনেও সরকারের কোভিড সংক্রান্ত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বিরুদ্ধে এভাবে রুখে দাঁড়াল কেন? চিনের উহানে ২০১৯-এর শেষ লগ্নে কোভিড-১৯ ভাইরাস এবং রোগটি প্রথম চিহ্নিত হলেও সেই সময় চিন সরকার তা নিয়ে যথাযথ সতর্কতা নেয়নি। উহান থেকে সারা বিশ্বে বিমান বা জাহাজ চলাচল বন্ধ করেনি। চিনের পুঁজিবাদী অর্থনীতির মুনাফার স্বার্থে তারা গোটা বিশ্বের মানুষের জীবনকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। অন্যান্য পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশও একই রকমের অবহেলা দেখিয়েছে তখন। জীবন দিয়ে এর মাশুল গুনতে হয়েছে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে। আবার কোভিডের কারণে লকডাউন শুরু হতে একচেটিয়া পুঁজিমালিক ধনকুবেররা সরকারের সাহায্যে বিপুল মুনাফা কামানোর ব্যবস্থা করে নিয়েছে। অন্যদিকে লকডাউনে সাধারণ শ্রমিক, কৃষকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। পরে অন্যান্য দেশ লকডাউন তুলে নিলেও চিন সরকার তা অনেকাংশে চালিয়ে যেতে থাকে। কোভিড সতর্কতার নামে তারা দেশের বিরাট অংশের জনগণের ওপর কার্যত স্বৈরতান্ত্রিক জুলুম চালায়। এতে চিনের বড় বড় পুঁজিপতিদের কোনও অসুবিধা নেই। লকডাউনের সুযোগে কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে তারা শ্রমিকদের সমস্ত জীবনীশক্তি নিংড়ে কাজ করিয়ে নিতে পারছে। উপরন্তু কোভিডের অজুহাতেই শ্রমিকদের সমস্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে চলেছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধের সম্ভাবনাকেও কোভিডের অজুহাত দিয়েই গলা টিপে মারছে তারা। ফলে কোভিডজনিত সতর্কতার নামে প্রশাসনের অতি বাড়াবাড়ি আশু বিক্ষোভের কারণ হলেও এর পিছনে আছে নির্মম পুঁজিবাদী শোষণজনিত ক্ষোভ।

বিশ্বের মানুষের কাছে বৃহৎ পুঁজি পরিচালিত সংবাদমাধ্যম ধূর্ততার সঙ্গে প্রচার করে চিনের বর্তমান শাসকদের এই অত্যাচারী ঘৃণ্য মুখটাই হল সমাজতন্ত্রের আসল রূপ। চিনের বর্তমান শাসকরা সে দেশের এবং বিশ্বের খেটে খাওয়া মানুষকে ধোঁকা দিতে চিন বিপ্লবের রূপকার মহান মাও সে তুঙয়ের ছবি টাঙিয়ে রাখে। অথচ মাওয়ের পথের সাথে তাদের সব সম্পর্ক চুকে গেছে অনেক আগেই। পার্টির সাইনবোর্ডে তারা ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটা লিখে রেখেছে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। অথচ তারা বহুদিন আগেই কমিউনিজমের পথ ত্যাগ করেছে। ২০০৪-এ চিনে প্রতিবিপ্লব সম্পূর্ণ হয়ে পুরোপুরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজকের চিন বিশ্বের একটা বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত। পুঁজিবাদী সমাজের সমস্ত রোগ-লক্ষণই আজ একেবারে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটে বেরিয়েছে তার গোটা শরীরে। কোভিড মহামারি যদি নাও আসত, চিনের সাধারণ মানুষের এই দুর্দশা ঘটতই। মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, বেকারি, শ্রমিকদের খাটানোর সমস্ত নিয়ম-নীতি বিসর্জন দেওয়া, কৃষকদের সীমাহীন দুর্দশা, দারিদ্র এবং আর্থিক বৈষম্য বেড়ে চলা, ক্রমবর্ধমান অপরাধ, দুর্নীতি, মেয়েদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি সহ পুঁজিবাদের কোনও রোগই বাকি নেই। এই পরিস্থিতিতে দেখা দরকার একদা বিশ্বের মেহনতি মানুষের মুক্তিপথের অন্যতম লাইটহাউস সমাজতান্ত্রিক চিনের এই অধঃপতন কেন?

কার আর্থিক বৃদ্ধি?

চিনের পুঁজিবাদী শাসকরা অনেক বছর ধরে বিপুল আর্থিক বৃদ্ধির দাবি করে আসছেন। আজকের চিনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এই বৃদ্ধি মানে কার বৃদ্ধি– চিনের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের, নাকি জ্যাক মা-এর মতো ধনকুবরদের! সমাজতন্ত্র ধ্বংস করার ১৫-১৬ বছরের মধ্যেই দারিদ্র ছেয়ে ফেলেছে চিনকে। যে কোনও পুঁজিবাদী দেশের মতোই সেখানে অসাম্য প্রকট। ২০২১ সালেই দারিদ্র দূর করে ফেলার দাবি করেছিল চিন সরকার। অথচ সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ চিনা নাগরিকই বিশ্বব্যাঙ্কের মাপকাঠিতে দারিদ্রসীমার নিচে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বহু পরিবার সামান্য ডিম বা মাংসের মতো প্রোটিন দীর্ঘকাল পায় না। বহু শিশু স্কুলের মুখ দেখে না। ১৫ কোটির বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার। আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে ভয়াবহ হারে। দেশের মোট সম্পদের ৭০ শতাংশ ভোগ করে মাত্র ১০ শতাংশ অতি ধনী। চিনের শাসক পার্টির নেতারা এক একজন শীর্ষস্থানীয় বুরোক্র্যাটের মতো আচরণ করতে করতে নিজেরাই শিল্পপতিতে পরিণত হয়েছেন। সরকারি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, শিল্প-কারখানা নিজেরা কিনে নিয়ে মুনাফা করছেন। এই বুর্জোয়া পরিচালকদের হাতে চিনে উৎপাদনের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবেই মালিক-মজুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। শ্রম ও পুঁজির এই সম্পর্কে মালিকরা সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য শ্রমিকদের ওপর চরম শোষণ চালাচ্ছে। একদিন সমাজতন্ত্রের মধ্যে চিনের শ্রমিকরা যে উন্নত এবং মর্যাদাময় জীবনের স্বাদ পেয়েছিলেন, আজ তা কেবলই ইতিহাস। শ্রমিকদের বহু সময় লিখিত চুক্তির থেকে কম মজুরিতে কাজ করতে হয়। তাঁদের শ্রমে উৎপাদিত মূল্যের অতি সামান্যই তাঁরা পান। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বালাই নেই, ভয়াবহ রকমের লম্বা কাজের সময়, জোর করে আটকে রেখে কাজ করানো, শিশুশ্রমিকদের খাটানো এ সবই চলছে। ‘চায়না ব্লু’ নামে একটি তথ্যচিত্র তুলে ধরেছে চিনের নীল জিন্স পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের কাহিনি। সেখানে ঘণ্টা প্রতি মজুরি নূ্যনতম মজুরির থেকে অনেক কম। কাজ চলে দীর্ঘ সময়। সরবরাহ চুক্তির সাথে তাল মেলাতে শ্রমিকদের একটানা কয়েকদিন সারা দিন-রাত ধরে কাজ করতে হয়। স্পেশাল ইকনমিক জোন বা এসইজেড হচ্ছে চিনের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির শ্রমশক্তি নিষ্পেষণের সবচেয়ে বড় শক্তি। সমাজতন্ত্রের স্মৃতি হাতড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রমিকরা ভাবেন– কী সম্পদ হারিয়েছি আমরা!

ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতি, বেকারত্ব

চিনে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ২০২২-এ ‘ফ্যাক্টরি গেট’ মূল্য অর্থাৎ শিল্প দ্রব্যের পাইকারি মূল্য সর্বোচ্চ হারে ক্রমাগত বাড়ছে। সাধারণ মানুষের ভোগ্যপণ্য কেনার ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে। পোশাক থেকে শুরু করে বাড়ির প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী এমনকি খাদ্যের বিক্রিও কমছে। অন্য সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী দেশের মতোই জনগণকে ঋণনির্ভর কেনাকাটার দিকে ঠেলে দিয়ে পুঁজিপতিদের স্বার্থে বাজারে কৃত্রিম তেজিভাব আনার চেষ্টা করছে চিন সরকার।

অত্যধিক কর, স্থানীয় প্রশাসনের নানা স্তরের দুর্নীতি চিনের গ্রামাঞ্চলের জনগণকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সার, বীজ, পশুখাদ্য, কৃষি-উপকরণ ইত্যাদির অত্যধিক দামের ফলে কৃষকরা দুর্দশায়। গ্রামে কাজ না পেয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কর্মক্ষম মানুষ দলে দলে পাড়ি জমান দূর শহরে, এমনকি ভিন দেশে। বহু গ্রামে প্রায় সমস্ত পরিবারের শিশুরা থাকে তাদের বৃদ্ধ দাদু-দিদার কাছে– বাবা-মায়েরা কাজের খোঁজে পরিযায়ী শ্রমিকের দলে নাম লিখিয়ে বছরের পর বছর পড়ে থাকেন অনেক দূরের কোনও শহরে কিংবা এসইজেড-এ। গবেষকদের মতে, অন্তত ৫ কোটি ৮০ লক্ষ শিশু তাদের বাবা-মা দুজনেরই অথবা একজনের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত। বহু শিশু স্কুলের মুখ দেখে না।

বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ১৯.৯ শতাংশ। এই বছরের মধ্যে আরও অন্তত দেড় কোটি স্নাতক কাজের বাজারে লাইন দেবে। তাতে এই হার আরও বাড়বে।

সমাজতন্ত্রের সময়ে চিনের শহর এবং গ্রামে রোগ প্রতিরোধকে গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে শক্তিশালী জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। পুঁজিবাদী চিনে স্বাস্থ্য এখন মুনাফা লোটার উত্তম ক্ষেত্র। তা দাঁড়িয়ে আছে পুঁজিবাদী বাজারের চাহিদা-জোগানের তত্ত্বের উপর। উচ্চমূল্যে স্বাস্থ্যবিমা কেনার ক্ষমতাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা যেখানে বেশি, সেই সব শহর বা শিল্পকেন্দ্রেই বেশিরভাগ ক্লিনিক, হাসপাতাল কেন্দ্রীভূত হয়েছে। গ্রামীণ মানুষ বা মফস্বলের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। শিক্ষা প্রসারের কথা ব্যাপক প্রচার করলেও চিনের শিক্ষা ব্যবস্থায় দরিদ্র ঘরের ছাত্রদের স্থান কমছে। গ্রামীণ এলাকা, দরিদ্রদের বস্তি, পরিযায়ী শ্রমিকদের আস্তানা এলাকার মলিন ভগ্নপ্রায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে বড় শহরে অর্থবানদের ঝাঁ-চকচকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফারাক আসমান-জমিনের। ১৯৯৯ সালের মধ্যেই পুঁজিবাদী পথগামী চিনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন পুরোপুরি পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত চিন বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

নারীদেহ আজ পণ্য

চিনে মানুষ পাচার, গায়ের জোরে ধরে রেখে দাসত্ব করানো, শিশুদের আটকে রেখে কাজ করানোর বেশ কিছু খবর নানা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সমাজবিরোধী কার্যকলাপ, অপরাধ, চরম দুর্নীতি প্রবল বেড়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজেই স্বীকার করেছেন, দুর্নীতির সমস্যা দেশে ব্যাপক এবং জটিল আকার নিচ্ছে। ২০২১-এ ৫০ লক্ষের বেশি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছিল। যতদিন যাচ্ছে তা বাড়ছে। পর্যটকদের বেড়ানোর জায়গা, সাবওয়ে স্টেশনের মতো জায়গায় ভিখারির সংখ্যা সারা চিন জুড়েই বেশ বেড়েছে। ডনজুয়ানের শিল্পতালুক গুয়াংডঙে বহু প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরকে জোর করে আটকে রেখে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য করে একদল মাফিয়া গোষ্ঠী। একই সাথে বেড়েছে পতিতাবৃত্তি। পাঁচতারা হোটেল থেকে শুরু করে বি’ং ক্লাব, বিউটি পার্লারের আড়ালে নারীদেহ নিয়ে ব্যবসা চলছে। একদা সমাজতন্ত্রের ছোঁয়ায় নারীকে যথার্থ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা চিনের মাটিতে আজ ১০ লক্ষ নারী দেহ বিক্রি করেই জীবন ধারণ করতে বাধ্য হন। এ ছাড়াও অন্তত ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি মহিলা আংশিক সময়ে টাকা কিংবা অন্য কোনও কারণে ক্ষমতাশালীদের তুষ্ট করতে দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হন বলে সমীক্ষকদের মত।

১৯৪৯ সালে চিন বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পরেই মহান নেতা মাও সে তুঙ-এর নেতৃত্বে নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমানাধিকার অর্জন করার সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পেয়েছিলেন। মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে এবং রক্ষিতা রাখার প্রথা নিষিদ্ধ হয়। ১৯৫০-এ গ্রামীণ ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা তিনগুণ বাড়ানো সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান মাও পুরুষদের সঙ্গে সমান হারে মেয়েদের ‘ওয়ার্ক পয়েন্ট’ বা কাজের মূল্যায়ন নম্বর দিতে বলেন। তাঁর ভাষায়– মেয়েরা ভরে আছেন ‘অর্ধেক আকাশ’। সেই চিন আজ অদৃশ্য। আজকের চিনে প্রতি ৭.৪ সেকেন্ডে একজন নারী গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। বস্তুত প্রতি চারজনে একজন নারী নিজের ঘনিষ্ঠবৃত্তেই হেনস্থার শিকার। প্রতি বছর অন্তত ৮০ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অন্তত ৩ কোটি শিশু সে দেশে যৌন নিপীড়নের শিকার। সমাজবিজ্ঞানের গবেষকদের মতে বেশিরভাগ নির্যাতনের ঘটনাই অসচেতনতা অথবা সামাজিক লজ্জার ভয়ে প্রশাসনের কাছে নিপীড়িতরা জানাতে পারে না।

কেন এই পরিস্থিতি?

কেন চিনের জনগণের এই পরিস্থিতি? দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা পেয়েছিলেন উন্নত জীবনের স্বাদ। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, অর্থনৈতিক-সামাজিক দিক থেকে বহু পিছনে পড়ে থাকা চিন ১৯৪৯ সালে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের পথে এগিয়েছিল। বহু বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজ। পিছিয়ে পড়া একটা দেশ কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল অন্যতম সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসাবে। সে দেশের মানুষ আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে পেয়েছিল এমন এক সমাজ, যার জন্য বহু যুগ ধরে মানুষ স্বপ্ন দেখেছে। সেই চিন আজ কেবলমাত্র একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অন্যতম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে সে দাঁড়িয়ে আছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বের বিস্তীর্ণ এলাকায় সাম্রাজ্যবাদের শিকল পরিয়ে নিজের প্রভাবাধীন অঞ্চল বিস্তারের কাজে লিপ্ত চিন। দুনিয়া জুড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি লগ্নি চিনের পুঁজিপতিরা করেছে। অথচ আজ চিনের বিরাট সংখ্যক জনগণ নিমজ্জিত চরম দারিদ্র এবং এক অসম্মানের জীবনে।

প্রসঙ্গত, বামপন্থী বলে পরিচিত নানা দল ও তাত্ত্বিক চিনের পার্টির সাইনবোর্ড দেখেই চিনকে সমাজতান্ত্রিক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু এদের স্বরূপ চিনতে এস ইউ সি আই (সি)-র কোনও দিনই অসুবিধা হয়নি। ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে বিক্ষোভের ওপর সংশোধনবাদী চিন সরকারের দমন-পীড়নকে কেন্দ্র করে বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন উঠেছিল। একে কেন্দ্র করে সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রচার তুঙ্গে তুলেছিল বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম। সেই সময় মাক্সর্বাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে এস ইউ সি আই (সি) দেখিয়েছিল, মহান মাও সে তুঙ-এর তুলে ধরা আধুনিক সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামের পতাকা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিনের তৎকালীন নেতৃত্ব পুঁজিবাদের পথে দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন। তার অবশ্যম্ভাবী ফল জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান দুর্দশা, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ, দমন-পীড়নের পথে মানুষের ক্ষোভকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা। যার ফল এই বিক্ষোভ। চিনের জনসাধারণ যদি মহান মাও সে তুঙয়ের দেখানো পথ আঁকড়ে ধরে দৃঢ় প্রত্যয়ে শ্রেণিসংগ্রামের রাস্তায় অগ্রসর হতে না পারেন, মাও সে তুঙয়ের চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটা সংশোধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সে দেশের কমিউনিস্টরা সচেতন তীব্র সংগ্রাম শুরু না করেন– তাহলে অচিরেই চিন একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সে দিন আমাদের এই হুঁশিয়ারিতে অনেকেই কান দেননি। এই আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হল ২০০৪-এ এসে।

সমাজতন্ত্রের সামনে সংশোধনবাদী আক্রমণের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে মহান নেতা মাও সে তুঙ ১৯৬২ সালের একটি বত্তৃতায় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রজন্ম যদি সংশোধনবাদের রাস্তায় গিয়ে উল্টোমুখে হাঁটে, তাহলে তাদের জন্য নামেমাত্র সমাজতন্ত্র থাকলেও তা হবে আসলে পুঁজিবাদী শাসন।’ তিনি বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এবং চিনের মধ্যেও সংশোধনবাদের বিপদ লক্ষ করে ১৯৬৬ সালে ডাক দিয়েছিলেন ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’। অর্থনীতি, সমাজ, পার্টি সংগঠন, সমাজতান্ত্রিক প্রশাসন, সেনাবাহিনী, সংস্কৃতি, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য সমস্ত ক্ষেত্রকে জড়িত করে এই বিপ্লব চিনের মধ্যে নতুন প্রাণের জোয়ার এনেছিল। বিশ্বের বহু বামপন্থী এমনকি কমিউনিস্ট বলে পরিচিত নেতাও এর গুরুত্ব বুঝতে না পেরে সমালোচনা শুরু করেছিলেন। সে সময় এই বিপ্লবের মহত্বকে তুলে ধরে মহান মাক্সর্বাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছিলেন, কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এই বিপ্লব ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’ (মহান)। কিন্তু ১৯৭৬-এ মাও সে তুঙয়ের মৃত্যুর পর দেঙ সিয়াও পিং নেতৃত্ব চিনের বাইরে এবং ভিতরের সমাজতন্ত্রবিরোধী শক্তির সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে। এই দেঙকে মাও সে তুঙ তাঁর জীবদ্দশায় আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘ক্যাপিটালিস্ট রোডার’ বা পুঁজিবাদী পথগামী। সোভিয়েত ইউনিয়নের সংশোধনবাদী নেতা ত্রুশ্চেভের সাথে তাঁর তুলনা করে বলেছিলেন ‘চাইনিজ ত্রুশ্চেভ’। তিনি মাক্সর্বাদ-লেনিনবাদ-মাও সে তুঙয়ের চিন্তার বিপরীতে গিয়ে বুর্জোয়া উদারনীতিবাদের রাস্তা নিলেন। সমাজের শোষণমুক্তি ছাড়া যে ব্যক্তি-মানুষের মুক্তি হতে পারে না, এই সত্য চাপা দিতে তিনি বলতে শুরু করলেন সমাজতন্ত্রের ‘মানবিক মুখ’ চাই। এক শতাংশ বুর্জোয়ার উপর দেশের নিরানব্বই শতাংশ শ্রমিক কৃষকের স্বার্থে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন মাও সে তুঙ। তাকে দুর্বল করে দেঙ বুর্জোয়া একনায়কত্বের রাস্তা খুলতে স্লোগান তুললেন, ‘ধনী হওয়া বিশেষ গৌরবের বিষয়’। কৃষি এবং শিল্পে ব্যক্তিমালিকানার দরজা খুলে দিলেন। তাঁর বিখ্যাত স্লোগান আজ সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যতম হাতিয়ার– ‘বিড়াল কালো না সাদা তাতে কিছু এসে যায় না, দেখতে হবে সে ইঁদুর ধরে কি না।’ অর্থাৎ সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ– কোন নিয়মে উৎপাদন হচ্ছে তা দেখার দরকার নেই, আর্থিক বৃদ্ধির গ্রাফটা উপরে উঠলেই হল। মহান মাও সে তুঙ দেখিয়েছিলেন, উৎপাদন বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সমাজের সমস্ত অগ্রগতির প্রশ্নে শুধু অর্থনৈতিক মাপকাঠিটাই প্রধান নয়। প্রধান হল কোন নিয়মে তা পরিচালিত হচ্ছে, কোন রাজনৈতিক আদর্শ তাকে পথ দেখাচ্ছে। তাঁর ভাষায় ‘পলিটিকস ইন কম্যান্ড’। মাক্সর্বাদী বিজ্ঞানের এই অমোঘ সত্যকে চাপা দিয়ে চিনের সংশোধনবাদী নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়াতে আওড়াতেই যে সর্বনাশা পথ নিলেন, তার ফলে ২০০৪-এর মধ্যেই চিন প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি পুঁজিবাদী দেশে অধঃপতিত হল। তার বিষময় ফল আজ চিনের জনগণকে ভোগ করতে হচ্ছে।

আজ চিনের সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শাসকরা কমিউনিস্ট পার্টির সাইনবোর্ডটাকে ব্যবহার করছে চরম স্বৈরাচারী একদলীয় ফ্যাসিস্ট শাসনের মাধ্যমে জনগণকে দাবিয়ে রাখতে। সাইনবোর্ডে যাই লেখা থাক এই পার্টিটি এখন চরম অধঃপতিত একটি বুর্জোয়া পার্টি ছাড়া কিছু নয়। পুঁজিবাদী শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আবার সে দেশে নতুন করে যথার্থ একটি মাক্সর্বাদী লেনিনবাদী দল গড়ে উঠবেই। এই সম্ভাবনাটাকেই চিনের পুঁজিবাদী শাসকরা ভয় পাচ্ছে। তাই তাদের এই বজ্রমুষ্টি।

মাক্সর্বাদ-লেনিনবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের সার্বিক উন্নতির দিশা দেখায়। বুর্জোয়া শাসকরা জানে সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম নামটাই বিশ্বের খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে আবেগ সঞ্চার করে। তাই তারা একদিকে কমিউনিজমের মহান আদর্শের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচার চালায়, অন্যদিকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের এজেন্ট ঢুকিয়ে শ্রমিক শ্রেণির লড়াইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। আজ চিনের ধূর্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজবাদী শাসকরা ‘মাও সে তুঙ’ এবং ‘সমাজতন্ত্র’ এই দুটো নামকে হীন উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবহার করে চলেছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘চিনের স্বপ্ন’ স্লোগানের আড়ালে মানুষের দেশপ্রেমের আবেগকে ব্যবহার করে আরও বেশি বেশি করে স্বৈরাচারী শাসনের মুঠিকে দৃঢ় করতে চাইছে।

চিনের জনগণ এই ফ্যাসিবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছে এটাই আশার কথা। মাক্সর্বাদ-লেনিনবাদ-মাও সে তুঙয়ের চিন্তাধারা এবং এ যুগে এই আদর্শের উন্নততর উপলব্ধি কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে এই আন্দোলনকে পুঁজিবাদ উচ্ছেদের রাস্তায় চালিত করতে হবে। সারা বিশ্বেই আজ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে খেটে-খাওয়া মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছেন, চিনের জনগণও সেই পথ নিয়ে আবার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে শোষণ-জুলুম অবসানের পথে যাবেন এই আশা নিয়ে দুনিয়ার মেহনতি মানুষ তাঁদের প্রতিবাদী আন্দোলনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে স্মরণ করা দরকার মহান মাও সে তুঙ-এর সেই ঐতিহাসিক শিক্ষাকে– ‘বিপ্লবীদের প্রতিক্রিয়ার স্রোতের বিরুদ্ধে যেতে হবে’।