কে বড় দুর্নীতিবাজ তারই প্রতিযোগিতা চলছে

কোচবিহারের নির্বাচনী জনসভায় ৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিনি কড়া হাতে দুর্নীতি দমন শুরু করেছেন। হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, মোদি দুর্নীতিগ্রস্তদের সাজা দিয়েই ছাড়বে। উত্তরপ্রদেশের মিরাটেও এক নির্বাচনী জনসভায় তিনি এ কথা বলেছেন। নিজেকে তিনি দুর্নীতি বিরোধী মহাযোদ্ধা রূপে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাধ সাধছে তার নিজেরই তৈরি কোম্পানি আইন সংশোধনী। এই সংশোধনীটি তিনি ২০১৭ সালে এনেছিলেন, যাতে পুঁজিপতিদের থেকে কোটি কোটি টাকা পার্টি ফান্ডে নেওয়া যায়।

অবশ্য ভোট প্রচারে গিয়ে কংগ্রেস এবং তৃণমূল নেতারাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছেন। কিন্তু লক্ষণীয় হল, তিন দলের প্রচার মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়– তারা অন্য দলকে নিজেদের চেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ বলে ঘোষণা করছেন। নিজেরা কোনও দুর্নীতি করেননি– এমন কথা কেউই বলতে পারছেন না। দুর্নীতিবাজ হিসাবে কে বড়, যেন তারই প্রতিযোগিতা চলছে।

নির্বাচনী বন্ডের নামে বিজেপির দলীয় তহবিলে পুঁজিপতিদের থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা এসেছে। এই কেলেঙ্কারিকে বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারি বলে উল্লেখ করেছেন মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রীর স্বামী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পরাকলা প্রভাকরও। আগে কোম্পানি আইনে উল্লেখ ছিল, কোম্পানি তার তিন বছরের মুনাফার সর্বোচ্চ ৭.৫ শতাংশ চাঁদা হিসাবে তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলকে দিতে পারবে। মোদি সংশোধনী এনে বললেন, মুনাফা না হলেও তারা তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিতে পারবে। এমনকি দেউলিয়া ঘোষিত কোম্পানিও যাতে চাঁদা দিতে পারে তার ব্যবস্থাও রাখা হয়। যতটুকু তথ্য সুপ্রিম কোর্টের চাপে প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এক পয়সা মুনাফা না করেও কোটি কোটি টাকা পুঁজিপতিদের বিভিন্ন কোম্পানি তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলকে দিয়েছে। দি হিন্দু পত্রিকা বন্ড তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে ৩৩টি কোম্পানির মোট ক্ষতি ১ লক্ষ কোটি টাকা সত্ত্বেও ৫৭৬.২ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে, যার ৭৪ শতাংশ টাকা পেয়েছে বিজেপি। লোকসান করেও এত টাকা তারা কী করে দিল? আসলে এই কোম্পানিগুলো বিভিন্নএকচেটিয়া পুঁজিপতির তৈরি ভুয়ো এবং স্রেফ কাগুজে কোম্পানি। এই ভুয়ো কোম্পানির আড়ালে আসলে একচেটিয়া মালিকরাই বিজেপিকে টাকা দিয়েছে, যাতে বিজেপি ক্ষমতাসীন হয়ে তাদের এর বহুগুণ টাকা তোলার ব্যবস্থা করে দিতে পারে।

৫ এপ্রিল হিন্দু পত্রিকা দেখিয়েছে, ৬টি কোম্পানি সাত বছরে যত লাভ করেছে, তার থেকে বেশি টাকা অর্থাৎ ৬৪৬ কোটি টাকা বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে দিয়েছে, যার ৯৩ শতাংশ টাকা পেয়েছে বিজেপি।

যতটুকু খবরে প্রকাশ তাতে দেখা যাচ্ছে, বন্ড কেনার আগে বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রথমে ইডি-কে পাঠানো হয়েছে। আর তার পরে পরেই কোটি কোটি টাকা বিজেপিকে দিয়েছে ওই সব কোম্পানি। অর্থাৎ ইডি হানার ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা তোলা হয়েছে। এটা তো সংগঠিত সরকারি তোলাবাজির ঘৃণ্য নমুনা।

মোদি নাকি দুর্নীতিবাজদের সাজা দেবেন! কেন মোদি জোর গলায় এ সব কথা বলছেন? আসলে দলের দুন¹তি ঢাকতেই তাঁকে এসব প্রচার করতে হচ্ছে। এদিকে দেখা যাচ্ছে, অন্য দলের অভিযুক্ত ব্যক্তি বিজেপিতে ঢুকলেই ধোওয়া তুলসীপাতা হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে ২৫ জন বিরোধী নেতা, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এক সময় বিজেপি সোচ্চার ছিল, তাঁরা বিজেপিতে ঢুকতেই ইডি বোবা হয়ে গেছে। বিজেপিতে তাঁরা এখন নেতার পদ পেয়ে গেছেন। এগুলি কি দুর্নীতি দমনের লক্ষণ?

পুঁজিপতিরা তাদের শ্রেণিস্বার্থে কাজ করাতে সেবাদাস দলগুলিকে টাকা দেয়– এটা কোনও নতুন কথা নয়। এতদিন এ নিয়ে যেটুকু আড়াল ছিল নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারিতে তা একেবারে বে-আব্রু হয়ে গেছে। এখন দেশের মানুষের কাছে এটা স্পষ্ট যে, বিজেপি ভারতীয় পুঁজিপতিদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য দল। বিজেপি নামটার সাথে ‘ভারতীয় জনতা’ শব্দটা যতই জুড়ে থাক না কেন, তা শুধু জনতাকে ঠকানোর জন্যই জোড়া। বিজেপি পুরোপুরি পুঁজিপতি শ্রেণির দল। পুঁজিপতি শ্রেণিরই সেবাদাস এবং রাজনৈতিক ম্যানেজার ছাড়া বিজেপি আর কিছু নয়। অন্যান্য সংসদীয় দলগুলির ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। তাই তারাও বন্ডের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনও ভাবে কর্পোরেট পুঁজি মালিকদের থেকে টাকা পেয়েছে।

তা হলে জনসাধারণের স্বার্থ নিয়ে কোনও দল যথার্থ অর্থে লড়াই করলে, সেই দলের টাকার উৎস কী হবে? তেমন একটি পার্টি যেহেতু শ্রমিক শ্রেণির পার্টি, শোষিত মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী পার্টি, ফলে শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষই তার শক্তির উৎস, অর্থের উৎস। এই কারণে দেখা যায় বিপ্লবী বামপন্থী লাইন নিয়ে চলা এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) নির্বাচনী সংগ্রাম থেকে শুরু করে সমস্ত কর্মকাণ্ডের জন্যই জনগণের থেকেই তিল তিল করে অর্থসংগ্রহ করে এবং তা দিয়েই সমস্ত রকমের খরচ চালায়। কোনও পুঁজিপতির দয়ার দানের উপর এই দল নির্ভর করে না। তাই শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের হয়ে কোনও বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়তে তাদের এতটুকু অসুবিধা হয় না। মেকি বামপন্থীদের মতো বিশেষ কোনও পুঁজিপতিকে প্রগতিশীল বলে তুলে ধরে তার তাঁবেদারি করা এবং শোষিত মানুষের সাথে প্রতারণা করার দরকারও এই দলের হয় না।