কমরেড কাজল চক্রবর্তীর জীবনাবসান

এস ইউ সি আই (সি) দলের কোচবিহার জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গণআন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব কমরেড কাজল চক্রবর্তী ২৭ এপ্রিল ভোরে স্থানীয় এক নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের কর্মী-সমর্থকরা নার্সিংহোমে এসে উপস্থিত হন। তাঁর মরদেহ মিছিল সহকারে নিয়ে যাওয়া হয় ক্ষুদিরাম মূর্তির পাদদেশে। সেখানে দলের জেলা সম্পাদক কমরেড শিশির সরকার, অসিত দে, নেপাল মিত্র, নৃপেন কার্যী সহ অন্য অনেকেই শ্রদ্ধা জানান। স্থানীয় শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। বহু সাধারণ নাগরিক শোক প্রকাশ করেন এবং বিভিন্ন এলাকায় মানুষ সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

১৯৭৪ সালে কমরেড কাজল চক্রবর্তী দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর প্রাক্তন সদস্য কোচবিহারের প্রথম জেলা সম্পাদক প্রয়াত কমরেড সুব্রত চৌধুরীর সংস্পর্শে আসেন এবং এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী চিন্তানায়ক মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাকে জীবনাদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই তিনি দল ও দলের বিভিন্ন গণ সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। উজ্জ্বল কেরিয়ারের প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও কমরেড কাজল চক্রবর্তী কষ্টকর অথচ মর্যাদাময় রাজনৈতিক জীবনকেই গ্রহণ করেছেন।

১৯৭৮ সালে কোচবিহারে এআইডিএসও-র প্রথম জেলা সম্মেলনে কমরেড কাজল চক্রবর্তী সংগঠনের জেলা সভাপতি নির্বাচিত হন। কোচবিহার শহরের এমজেএন হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ওয়েলফেয়ার সংগঠন গড়ে তুলে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেন। ভাষাশিক্ষা আন্দোলনে পার্টির নির্দেশে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য প্রয়াত কমরেড সুকোমল দাশগুপ্ত ও কমরেড সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাত্রদের দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি, জেলার শিক্ষক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে যুক্ত করে শিক্ষার অধিকার রক্ষা কমিটি গড়ে তোলায় অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তিনি বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কাজকর্ম শুরু করেন। এই সমিতির প্রথম জেলা সম্পাদক ও পরবর্তীকালে জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জেলা জুড়ে শিক্ষক আন্দোলন গড়ে তুলতে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। শিক্ষক সংগঠগুলির যৌথ মঞ্চ জয়েন্ট কাউন্সিল অফ স্কুল টিচিং অ্যান্ড নন-টিচিং এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের আন্দোলনেও তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। সরকারি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁর স্কুলে তিনি পাশ-ফেল প্রথা ও ইংরেজি চালু রেখেছিলেন। সরকার ও ক্ষমতাসীন শাসকদলের বহু আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে চতুর্থ শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা চালু করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি বৃত্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, ছাত্রদের কাছে একজন সংবেদনশীল আদর্শ শিক্ষক ও অভিভাবক।

বাসভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিয়ে তিনি ভয়াবহ পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। তাঁকে দীর্ঘ কারাবাস করতে হয় এবং বহু মিথ্যা মামলায় তখনকার শাসকদল তাঁকে জড়িয়ে দেয়। ছিটমহল বিনিময়ের আন্দোলন, এনআরসি বিরোধী আন্দোলন, নারী নির্যাতন ও খুনের প্রতিবাদে নাগরিক কমিটির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন, উত্তরবঙ্গ পাটচাষি আন্দোলন, পৌর এলাকার সমস্যা নিয়ে আন্দোলন প্রভৃতিতে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেন। কোচবিহারে দলের প্রথম জেলা সম্মেলনে তিনি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

কোচবিহার এবং পার্শ্ববর্তী জেলাতেও বিদ্যুৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন কোচবিহার জেলায় বিদ্যুৎ গ্রাহক সমিতির জেলা সম্পাদক ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সহ-সভাপতি।

শরৎ জন্মশতবর্ষ উদযাপন, শহিদ ক্ষুদিরামের মূর্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মনীষী চর্চায় তার উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। তিনি জেলায় প্রোগ্রেসিভ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি নানা ধরনের সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজ করতেন। করোনা আবহের মধ্যেও অসম সাহসিকতার সঙ্গে রিলিফ ওয়ার্ক, রক্তদান শিবির, চিকিৎসায় সাহায্য করার কাজ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়ে পরিচালনা করেছেন। কমরেড কাজল চক্রবর্তীর জ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তিনি ‘নয়া প্রতিরোধ’, ‘চিন্তা’ সহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। দলের কাজ শুরুর প্রথম দিকে বহু দূরবর্তী প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে যোগাযোগ করেছেন। তাঁর কাছে জুনিয়র কর্মীরা মনের সমস্ত কথা নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে বলতে পারতেন। শাসকদলের ভয়াবহ আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

ছোট বড় সকলের সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক ছিল আন্তরিক। অহংবোধ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তাঁর সচেতন সংগ্রাম ছিল। নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা গ্রহণ করতে এবং নির্দ্বিধায় তা মেনে চলতে পারতেন। তাঁর জীবন ছিল সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর। নিজের বাড়িতে থেকে শিক্ষকতা করেও তিনি সর্বক্ষণের কর্মীর মতোই কাজ করেছেন। শারীরিক অসুবিধা সত্ত্বেও প্রশ্নহীনভাবে তিনি দলের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ বছরেও নির্বাচন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের নির্দেশিত উন্নত রুচি-সংস্কৃতির আধারের ভিত্তিতে জীবন সংগ্রামে তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। দলই ছিল তাঁর জীবন। বাড়িঘর সহ সমস্ত কিছু দলের কাছে সমর্পণ করতে কখনওই দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দলের সঙ্গে একাত্মতার সংগ্রাম করেছেন। তাঁর প্রয়াণে গণতান্ত্রিক মানুষ হারাল তাদের এক আপনজনকে। বর্তমান সংকটকালে বামপন্থী আন্দোলনের এবং দলের বিরাট ক্ষতি হল। দল হারাল একনিষ্ঠ উন্নত চরিত্রের অধিকারী এক নেতাকে।

কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার জেলায় দলের সমস্ত লোকাল কমিটি তাঁর স্মরণসভার আয়োজন করে। কোচবিহার শহরের বিভিন্ন কমিটি, ক্লাব স্মরণসভা করে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। ১৯ মে কোচবিহার জেলা কমিটি অয়োজিত স্মরণসভায় ফরওয়ার্ড ব্লক এবং সিপিএমের জেলা নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখা হয়। সিপিআইএমএল-এর পক্ষ থেকে শোকবার্তা পাঠানো হয়। প্রধান বক্তা ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির অফিস সম্পাদক কমরেড স্বপন ঘোষ। সভাপতিত্ব করেন কোচবিহার জেলা সম্পাদক কমরেড শিশির সরকার।

কমরেড কাজল চক্রবর্তী লাল সেলাম

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা