‘এনকাউন্টার’ অপরাধ দমনের হাতিয়ার হতে পারে না

এখন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সেমিনার থেকে শুরু করে পাড়ার চায়ের দোকান – সর্বত্রই কান পাতলে ‘এনকাউন্টার’ বিষয়ে ‘বিশেষজ্ঞদের’ মতামত শুনতে পাওয়া যায়। কিছু দিন পরপরই এনকাউন্টারে মৃত্যুর খবর আসে, তরঙ্গায়িত কোলাহল থেমে গিয়ে আবার তরঙ্গায়িত হয় আর একটা এনকাউন্টারের খবরে। এভাবেই চলতে থাকে। একটা ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের পক্ষে এ বড় সুখের সময় নয়।

১৯৯০-এর পর থেকে এনকাউন্টার শব্দটা এ দেশে বেশি করে শোনা যেতে থেকে। ২০০০ সালের মধ্যে শহরের মাফিয়াদের খতম করার কথা বলে মুম্বই পুলিশ ‘এনকাউন্টার হত্যা’ শুরু করে। দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে আত্মরক্ষার অজুহাত দেখালেও আসলে সাজানো (ফেক) এনকাউন্টারে খুন করাটা পুলিশের অধিকারে পরিণত হতে থাকে। যে কোনও মানুষকে সন্ত্রাসবাদী বা মাফিয়া নাম দিয়ে এইভাবে খুন করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে সারা দেশেই এনকাউন্টার খুন ছড়িয়ে পড়ে।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশিকায় এনকাউন্টার নিষিদ্ধ। এনকাউন্টার হলে, যে পুলিশ কর্মী এনকাউন্টার করল তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা হওয়ার কথা। তারপর তাকে কোর্টে প্রমাণ করতে হবে সে নির্দোষ, প্রমাণ করতে হবে সেটা সাজানো এনকাউন্টার নয়। ২০১১ সালে প্রকাশ কদম বনাম রামপ্রসাদ ভীষ্ম মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, পুলিশের বিরুদ্ধে বেআইনি হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেই পুলিশের মৃত্যুদণ্ড হওয়া দরকার। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এনকাউন্টারের পর পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও মামলাই দায়ের হয় না, হলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের কোনও শাস্তি হয় না। এ ভাবেই সমস্ত আইন, বিচার প্রক্রিয়া ও মানবাধিকারকে অস্বীকার করে চলতে থাকে এনকাউন্টার খুন। অনেকেরই মনে আছে ২০১৯-এ হায়দরাবাদে এক ভেটেনারি চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের দায় চাপিয়ে চারজনকে ‘এনকাউন্টারে’ হত্যা করেছিল পুলিশ। সোস্যাল মিডিয়ায় অনেক সমর্থনও মিলেছিল। তিন বছর পর ২০২২-এ বিচারপতি সিরপুরকরের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন জানায় ঠাণ্ডা মাথায় নিরপরাধদের অপরাধী সাজিয়ে খুন করেছিল পুলিশ।

বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের জন্মগত, আর আইন এই অধিকারকে রক্ষা করবে। সেই আইনের শাসন বলে, যে কোনও অভিযুক্তেরই আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। কোনও অভিযুক্ত যতক্ষণ না আদালতে দোষী প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ তাকে নির্দোষ হিসাবেই ধরতে হবে। কিন্তু ভারতে পুলিশ নিজেই আইন হয়ে উঠছে। বিচারের আগেই অভিযুক্তকে সাজানো এনকাউন্টারে মেরে দিচ্ছে। ইউনাইটেড নেশন হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল তাই এনকাউন্টারকে খুন হিসাবেই চিহ্নিত করেছে।

এই এনকাউন্টার খুনের পিছনে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন একটা বড় কারণ। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মালিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দলগুলি নীতি-আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতি করে না। একসময় মালিকের দেওয়া টাকা দিয়ে এই রাজনৈতিক দলগুলি মাফিয়া মস্তান পুষতো, এখন বাহুবলী মাফিয়ারাই এইসব রাজনৈতিক দলের নেতা-মন্ত্রী। ১৯৯৩-এর জুলাই মাসে নরসিমহা রাও সরকারের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এন এন ভোরার নেতৃত্বে কমিটির রিপোর্টের ভাষায়, দেশের নানা জায়গায় ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের সাথে পুলিশ, আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদদের আঁতাত এখন খুবই পরিষ্কার।

শুধু পাড়ায়-মহল্লায় গ্রামে-শহরে নয়, সংসদীয় রাজনীতিতে অপরাধীদের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে। ২০০৪ সালে সংসদের ২৪ শতাংশ সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন অবস্থায় ছিল। ২০০৯ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৩০ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৩৪ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৪৩ শতাংশ সাংসদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন অবস্থায় আছে। এই আশঙ্কাজনক চিত্র কম বেশি প্রায় সব রাজ্যের বিধানসভাগুলিতেও দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমান ভারতবর্ষে অপরাধের মৃগয়াক্ষেত্র উত্তরপ্রদেশের বিধানসভায় ৪০৩ জন সদস্যের অর্ধেকের বেশি ২০৫ জনের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস আছে। এদের মধ্যে আবার ১৫৮ জনের নামে মারাত্মক অভিযোগ আছে, যাদের অনেকে খুন, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ কেসে বন্দিও হয়েছিল।

উত্তরপ্রদেশে বিগত ৬ বছরে ৯৪৩৪টা এনকাউন্টার হয়েছে, দিনে গড়ে ৫টা করে। এতে ১৭০৮ জন আহত হয়েছে, প্রায় ১৬০ জন মারা গেছে। একটু খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিজেপির সাথে যুক্ত কোনও মাফিয়ার বিরুদ্ধে এনকাউন্টার হয়নি। কোনও রাজ্যেই শাসকদলের স্নেহধন্য মাফিয়া এনকাউন্টারে মরে না। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সাজানো এনকাউন্টারে মেরে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক। রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ-প্রশাসনের দুষ্টচক্রই নিজেদের কায়েমি স্বার্থে এনকাউন্টারের নামে আইন হাতে তুলে নেয়।

এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভূমিকা গণতন্ত্রের পক্ষে আশাপ্রদ নয়। একটা এনকাউন্টারের আগে ও পরে তারা কৌশলী উপস্থাপনায় এমন বাতাবরণ তৈরি করে, যেন অভিযুক্তকে এনকাউন্টারে মেরে ফেলাটা বৈধ। এনকাউন্টার নিয়ে একটার পর একটা চলচ্চিত্র হচ্ছে। অব তক ছাপ্পান, খাকি, চুলবুল পাণ্ডে, সিংঘম এমন অনেক চলচ্চিত্র যেখানে দেখা গেছে এনকাউন্টারের পর দর্শক উল্লসিত হয়েছে। ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ পুলিশকে সেখানে হিরো হিসাবে দেখানো হয়। এমনকি একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ‘এনকাউন্টার’ নামেই একটা জনপ্রিয় হিন্দি সিরিয়াল চলছে। এ ভাবে জন-মানসে এনকাউন্টারের পক্ষে একটা সমর্থন গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। একদল সাধারণ মানুষ, কোনও দুষ্কৃতীর এনকাউন্টারে মৃত্যু হলে আনন্দিত হন। আইনের ওপর, বিচারব্যবস্থার ওপর ভরসা হারানো মানুষ মনে করেন, বেশ হয়েছে, এদের এমন করেই মারা দরকার। বাস্তবে দিনের পর দিন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তাঁরা দেখেছেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার জন্য, আইনের মার-প্যাঁচে, টাকার জোরে, রাজনৈতিক সম্পর্কের জোরে অপরাধীরা সাজা পায় না। অসহায় মানুষ অত্যাচারিত হতে হতে, তীব্র রাগ ক্ষোভ বিদ্বেষে অপরাধীর ধ্বংস দেখতে চায়। অত্যাচারী শাসক এই সুযোগকে কাজে লাগায়। আইনের শাসনকে ধুলিসাৎ করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। যে কোনও প্রতিবাদী মানুষের গায়ে মনগড়া কিছু অভিযোগের কালি ছিটিয়ে তাদের হত্যা করার রাস্তা প্রশস্ত করে রাখে। এই অবস্থায় যদি সত্যিই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হয়, ন্যায়বিচার পেতে হয়, অপরাধ মুক্ত সমাজ সৃষ্টি করতে হয়, দলমতনির্বিশেষে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনকে তীব্রতর করতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনও পথ নেই।