এঁরা অতিথিকেও সম্মান দিতে জানেন না

বিজেপি–আরএসএস নেতারা মাঝেমধ্যেই বৈদিক ভারতের গৌরবগাথা প্রচার করেন৷ যদিও তাঁদের ক’জন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিরহিত বেদকালিক জীবনযাপন করেন জানা নেই৷

প্রাচীন ভারতে অতিথিদের যে খুবই মর্যাদা দেওয়া হত, তা উপনিষদের ‘অতিথি দেবো ভব’ (অতিথি হলেন ভগবান) থেকেই স্পষ্ট৷ অথচ পাকিস্তানের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, কবি মুনিজা হাশমি, যিনি কিংবদন্তী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কন্যা, তাঁকে এ দেশে আমন্ত্রণ করে এনে তাঁর সাথে যে আচরণ বিজেপি নেতা মন্ত্রীরা করলেন, যে ভাবে তাঁকে স্পষ্টত অপমান ক’রে পাকিস্তানে ফিরে যেতে বাধ্য করলেন, তা আতিথ্য সম্পর্কে শুধু প্রাচীন ভারত কেন, কোনও সভ্য সমাজের সঙ্গেই মানানসই নয়৷

বাস্তবিক তাঁদের আচরণ গোটা বিশ্বের কাছে ভারতীয়দের মাথা হেঁট করে দিয়েছে৷ কেউ যদি বলেন, আমন্ত্রিত অতিথিদের ন্যূনতম সম্মানটুকুও দিতে এঁরা জানেন না, তবে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় কি? তাঁরা তো জানবেন না, ভারতীয়রা এত হীন নয়, বরং ভারতীয়রা এ ঘটনায় মর্মাহত, লজ্জিত৷

মুনিজা হাশমিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল দিল্লিতে পঞ্চদশ এশিয়া মিডিয়া সামিটে বক্তব্য রাখার জন্য৷ কিন্তু কনফারেন্সের ঠিক আগে সরকারি দপ্তর থেকে আয়োজকদের জানিয়ে দেওয়া হয়, মুনিজা বক্তব্য রাখতে পারবেন না৷ এমনকী তাঁর জন্য নির্দিষ্ট হোটেলেও তিনি থাকতে পারবেন না৷ অগত্যা আয়োজকদের অন্যত্র তাঁর থাকার ব্যবস্থা করতে হয় এবং পরদিন সকালেই মুনিজাকে পাকিস্তানে ফিরে যেতে হয়৷

কেন? কী অপরাধ মুনিজা হাশমির? অপরাধ তাঁর একটাই৷ তিনি জন্মসূত্রে পাকিস্তানি৷ আর বিজেপি–আরএসএস–এর চোখে ভিন্ন ধর্মের দেশ পাকিস্তান হল ভারতের শত্রুরাষ্ট্র৷ প্রায় প্রতিদিনই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে দেখা যায় শাসক বিজেপির নানা স্তরের নেতাদের৷ দেশের ভেতরকার অসংখ্য সমস্যার দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে রাখার এর চেয়ে ভাল উপায় আর কী আছে তাই বারবার ঘটে চলে এ ধরনের লজ্জাজনক ঘটনা৷ পাকিস্তানের সঙ্গীত শিল্পী, নাট্য শিল্পীদের ঘোষিত অনুষ্ঠানে গেরুয়াবাহিনী তাণ্ডব চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে এ দেশেই৷ মুনিজা অবশ্য ভারত সরকারের এই আচরণের প্রতিক্রিয়ায় ফয়েজের কবিতার একটা পঙক্তি ব্যবহার করেছেন মাত্র৷ যেখানে বলা আছে, ‘লম্বি হ্যায় গম কি শাম, মগর শাম হি তো হ্যায়!’ অর্থাৎ, দীর্ঘ এ দুঃখের রাত, তবু সে তো রাতেই সীমাবদ্ধ৷ তিনি বিশ্বাস করেন, ভারতের কোনও অতিথি পাকিস্তানে কখনও অসম্মানিত হবেন না৷

বিজেপি নেতাদের যে আচরণে ভারতীয়দের মাথা হেঁট হল, যতই তাঁরা শাসন ক্ষমতায় থাকুন, তাঁদের এমন আচরণের অধিকার ভারতবাসী দেয়নি৷ বিজেপি যে জাতীয়তাবাদের প্রচার করে তা যে কত হীন, কত সংকীর্ণ, মুনিজার সাথে তাঁদের এই অভব্যতায় আবার তা প্রমাণিত হল৷ বিজেপি–আরএসএসের এই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তার কোনও সম্পর্ক নেই৷

অন্য সব সংস্কৃতির মতো ভারতীয় সংস্কৃতিরও অন্যতম পরিচয় আতিথেয়তা৷ সেই সংস্কৃতির পরিচয় বিজেপি নেতারা দিতে পারেননি৷ এঁরা আসলে ধর্ম–ব্যবসায়ী৷ ধর্মের নামে এই বর্বরতার প্রতিবাদ করা উচিত ভারতীয় মাত্রেরই৷ সোচ্চারে ঘোষণা করা উচিত– না, অতিথিকে অপমান করা ভারতীয় সংস্কৃতি নয়৷ ভারতীয় সংস্কৃতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত৷ অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের এই বর্বরতা সম্পূর্ণভাবেই বিজেপি–আরএসএসের নিজস্ব৷ দেশের মানুষ সরকারের এই আচরণের তীব্র নিন্দা করছে৷ প্রতিবাদ না করলে এই ছদ্ম–জাতীয়তাবাদীদে আচরণে বারে বারেই ভারতীয় হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট হতে থাকবে৷

(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)