ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উত্তরাধিকার

বিদ্যাসাগরের জন্মের পর ২০০ বছর অতিক্রান্ত৷ এই সময়কালের মধ্যে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনে স্বাভাবিকভাবেই ঘটে গেছে নানা পরিবর্তন৷ আজ আমরা বিদ্যাসাগরের জীবনসংগ্রাম থেকে ঠিক কোন শিক্ষা গ্রহণ করব? আমরা যারা বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকারী হতে চাই, তাঁদের করণীয় কী?

মোটামুটি ১৮৪০ থেকে ১৮৯১ এই হল বিদ্যাসাগরের কর্মজীবনের সময়কাল৷ এই সময় সমাজে দেশিয় রাজা–জমিদার তথা সামন্ততন্ত্রের প্রবল দাপট৷ আবার, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে৷ পুরোহিত, উচ্চবর্ণ তথা ব্রাহ্মণদের প্রভাবশালীরা তখন সমাজে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা৷

সমাজে তখন বদ্ধমূল ধারণা– মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে অকালে বিধবা হবে, ব্যাভিচার বাড়বে, সমাজ উচ্ছন্নে যাবে৷ অতএব, মেয়েদের জন্য শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না৷ বাডির কাজকর্ম, রান্নাবান্না, সন্তান উৎপাদন ও তাদের প্রতিপালন– এই তাদের জীবন৷ ৬,৭,৮ বছরের মধ্যেই তাদের বিয়ে দেওয়াই ছিল সামাজিক প্রথা৷

অন্য দিকে কুলীন ব্রাহ্মণরা বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত একেকজন ৭০–৮০টাও বিয়ে করত৷ মেয়ের পিতারা বাধ্য ছিলেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এমনকি বৃদ্ধের সাথে হলেও মেয়ের বিয়ে দিতে৷ না হলে তাঁরা একঘরে হয়ে যাবেন, ধোপা নাপিত বন্ধ হয়ে যাবে৷ তখন ওই বিয়ে–ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময়ে বিয়ে করে মেয়ের বাপকে ‘উদ্ধার’ করত৷ বিয়ের পর মেয়েকে থাকতে হত বাপের বাডিতেই৷ কিন্ত স্বামী রত্নটিকে নিয়মিত টাকা দিতে হত৷ কিছু দিনের মধ্যেই বুড়ো বর মারা গেলে সেই ছোট্ট মেয়েটি সার জীবনের জন্য হয়ে গেল বিধবা৷ তখন থেকে তার সাদা থান, একবেলা নিরামিষ খাওয়া, মাসের নানা তিথিতে নির্জলা উপোস৷ কোনও শুভ কাজে তার ডাক নেই, কোনও উৎসবে তার প্রবেশ নেই৷ ধর্মের নামে নারীর ওপর এইসব চাপিয়ে রাখা হয়েছিল৷

এই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়েই বিদ্যাসাগরের উত্থান৷ বিদ্যাসাগরের আগে রামমোহন রায়ের সংগ্রামের ফলে বর্বর সতীদাহ রদের আইন হয়েছে৷ সাগরে সন্তান বিসর্জনের মতো কুপ্রথা আটকাতে আইন হয়েছে৷ এবার, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ বন্ধ করতে হবে, বিধবাবিবাহ চালু করতে হবে, মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে– এই হল বিদ্যাসাগরের সামনে সমাজ–সভ্যতার দাবি৷ যদিও, বিদ্যাসাগর কর্মজীবনে প্রবেশ করার অনেক আগেই এই বিষয়ে কিছু কিছু উদ্যোগ হয়েছিল৷ কিন্তু তা কার্যকরী অর্থে ঠিক দানা বাঁধেনি৷ বিদ্যাসাগরই সমাজ প্রগতির এই দাবিকে একটা শক্তিশালী আন্দোলনের রূপ দিতে সক্ষম হন এবং সফল হন৷ কেন? কী বিশেষত্ব ছিল বিদ্যাসাগরের মধ্যে?

সে কালে বিদ্যাসাগরের মতো তুখোড সংস্কৃত জানা, শহরের স্কুল–কলেজে পড়া উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত আরও কয়েকজন ছিলেন৷ ইউরোপীয় ভাষা, সাহিত্য, জ্ঞান–বিজ্ঞান শাস্ত্রে সুদক্ষ মানুষও ছিলেন৷ যুক্তিনিষ্ঠা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অনুভুতিশীল হৃদয়, আত্মমর্যাদাবোধ ইত্যাদিও একেবারে বিরল ছিল না৷ কিন্তু, এই সমস্ত কিছুর সাথে বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে যেটি আয়ত্ত করেছিলেন, সেটি হল, যুগোপযোগী সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি৷ ইউরোপীয় নবজাগরণের সব চেয়ে বলিষ্ঠ যে ধারা অর্থাৎ পার্থিব মানবতাবাদ, তা যেন এদেশের মাটিতে মূর্ত হয়ে উঠল বিদ্যাসাগরের চরিত্রে৷ তাই তাঁর আন্দোলনে, আচরণে যেমন বিন্দুমাত্র কোনও আপস নেই, তেমনি আবার নূ্যনতম কোনও জড়তা, দোদুল্যমানতা, হঠকারিতাও নেই৷ এ কারণেই, এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ বিদ্যাসাগরকে বলেছেন ‘খাঁটি হিউম্যানিস্ট’৷

জগদ্দল পাথরের মতো এই অন্ধকার, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে ধাক্কা দিয়ে নড়তে গেলে যে সমাজ থেকে দূরে যাওয়া চলে না, এই বাস্তবতাকে তিনি মর্মে মর্মে উপব্ধি করতে পেরেছিলেন৷ দেশের মাটির থেকে বিচ্ছিন্ন হননি কোনও দিন৷ কোনও বাধাই তাঁকে তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি৷ বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘‘বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম৷ এ জন্মে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই৷ এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ নহি৷’’ এই প্রতিজ্ঞা পালনের সবচেয়ে বড সাক্ষী তাঁর জীবন৷ শুধু বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গেই নয়, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রতিরোধেও তিনি এইভাবেই লডেছিলেন৷ সর্বসাধারণের জন্য বৈজ্ঞানিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার প্রসারেও বিদ্যাসাগর এইভাবেই সক্রিয় ছিলেন৷

তিনি চেয়েছিলেন দেশে একদল নতুন যথার্থ মানুষ তৈরি হোক, যারা হবে সমস্ত দিক থেকে উন্নত নীতি নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ সম্পন্ন৷ অথচ, আজকের সমাজ–পরিচালকরা নিজেদের কায়েমি স্বার্থে সমাজটাকে আরও অশিক্ষা, কুসংস্কার, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ মহান বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিজেকে গডে তুলতে গেলে তাঁর স্বপ্ণকে আজ রক্ষা করতেই হবে৷ সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য চাই বর্তমান যুগোপযোগী দর্শন তথা দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করা৷ এ পথ অবশ্যই কঠিন, কিন্তু সত্য৷ সত্যনিষ্ঠ কঠিন থেকে কঠিনতর পথে মাথা উঁচু করে নিরলস এগিয়ে চলার অফুরান প্রেরণাই তো বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকার৷