সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে এবার শিখদের ইতিহাসকে বিকৃত করছে বিজেপি

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে বিজেপি এবার হাতিয়ার করেছে শিখ ঐতিহ্যকে। শিখদের পালনীয় ‘সাহিবজাদে শহিদ দিবস’-এর নাম পাল্টে দিনটিকে ‘বীর বাল দিবস’ (সাহসী শিশু দিবস) হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি সরকার।

১৬৯৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনস্থ প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের হাতে শিখ ধর্মগুরু গোবিন্দ সিংহের দুই শিশুপুত্রের মৃত্যু হয়। সেই ঘটনা স্মরণ করে দিনটিকে শহিদ দিবস হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছেন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। গত বছর জানুয়ারি মাসে গুরু গোবিন্দ সিংহের জন্মবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ২৬ ডিসেম্বর দিনটি ‘বীর বাল দিবস’ হিসাবে পালন করার কথা ঘোষণা করেন। আপত্তি জানায় শিরোমণি গুরদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটি কিংবা অকাল তখত-এর মতো শিখ সংগঠনগুলি। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর মহা সমারোহে বীর বাল দিবস পালন করেছে বিজেপি। দিল্লির ধ্যানচাঁদ ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে এ উপলক্ষে দীর্ঘ ভাষণও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

হঠাৎ শিখদের ইতিহাসে হস্তক্ষেপ কেন? আসলে মুঘল শাসকদের হাতে শিখ ধর্মগুরুর দুই শিশুপুত্রের হত্যার ঘটনাটিকে বিজেপি তার চরিত্র অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক রঙ দিতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের ভাষণেই সে কথা স্পষ্ট। কিন্তু ১৬৯৯-এর শিখ-মুঘল বিরোধের পিছনে আদৌ কি ধর্মের ভূমিকা ছিল?

কী বলছে ইতিহাস

১৬৯৯ সালে শিখ ধর্মগুরু গোবিন্দ সিংহ আনন্দপুর সাহিবে প্রতিষ্ঠা করেন ‘খালসা’ নামক প্রতিষ্ঠান। সেখানে এই ধর্মগুরু একটি সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন। সেই কারণে ‘খালসা’-কে বিপদ হিসাবে দেখেছিল পার্বত্য রাজ্যগুলির হিন্দু রাজারা। ১৭ শতাব্দীর শেষ দশকে এই পার্বত্য রাজ্যগুলির সঙ্গে শিখদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়, কিন্তু শিখরা কোনও মতেই আনন্দপুর সাহিব ছেড়ে যাননি। ইতিহাস বলছে, শিখদের পাশে নিজের অনুগত শিষ্যদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বদরুদ্দিন শাহ নামে এক মুসলমান পীর। শেষ পর্যন্ত খালসাকে বাগে আনতে পার্বত্য রাজারা মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে সাহায্য চায়। ১৭০৪ সালে মুঘল শাসকদের সাহায্য নিয়ে বিলাসপুর ও হাণ্ডুরিয়ার দুই হিন্দু রাজা ভীমচাঁদ ও হরিচাঁদ আনন্দপুর সাহিবকে চারিদিক থেকে সেনা দিয়ে ঘিরে ফেলেন। আশপাশের আরও কয়েকটি রাজ্যও শিখদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে যোগ দেয়। কয়েক মাস ধরে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় আনন্দপুর সাহিবকে। শেষ পর্যন্ত হিন্দু রাজারা ও মুঘল সুবেদাররা শিখদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। চুক্তিতে শপথ করা হয় যে, গুরু গোবিন্দ সিংহ আনন্দপুর সাহিব ছেড়ে চলে যেতে রাজি হলে এই যুদ্ধ বন্ধ করা হবে। শিরোমণি গুরুদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটির প্রকাশিত ইতিহাস অনুযায়ী, ১৭০৪-এর ২০ ডিসেম্বর গুরু গোবিন্দ সিংহ আনন্দপুর সাহিব ত্যাগ করেন। কিন্তু শত্রুরা শপথ ভঙ্গ করে শিখদের উপর আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে গুরু গোবিন্দ সিংহের বড় দুই পুত্রের মৃত্যু হয়। তাঁর ছোট দুই পুত্র এক হিন্দু রাঁধুনির বিশ্বাসঘাতকতায় মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক সুবেদারের হাতে প্রাণ হারান। ইতিহাস আরও বলে, গুরু গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও মুঘল সাম্রাজ্যেরই এক সেনাপতি নবাব শের মহম্মদ খান এই হত্যার বিরোধিতা করেছিলেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যের আরও এক রাজ্যপাল দেওয়া সুচা নন্দ নিজে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও শিশুদুটিকে হত্যা করার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।

সামন্তী যুগে যুদ্ধ, লুঠতরাজ, হত্যার ক্ষেত্রে ধর্ম দেখা হত না

ফলে ইতিহাস সাক্ষী, গুরু গোবিন্দ সিংহের দুই শিশুপুত্রের হত্যার সঙ্গে ধর্মীয় বিরোধের কোনও সম্পর্কই নেই। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই জানেন যে, সামন্তী যুগে সমস্ত রাজা-মহারাজারাই তলওয়ারের জোরে রাজ্য শাসন করেছেন। তাঁদের অনেকেই বহু যুদ্ধ করেছেন, নির্মম ভাবে বিদ্রোহ দমন সহ নানা জঘন্য অপরাধ করেছেন। বিরোধীরা কে কোন ধর্মের অনুসারী, এ সব ক্ষেত্রে তা কোনও বিচার্য বিষয়ই ছিল না। কয়েকজন অত্যাচারী মুসলমান শাসকের পাশাপাশি ইতিহাসে এমন সব হিন্দু রাজাদের উল্লেখ পাওয়া যায় যাঁরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও নাস্তিকদের উপর বর্বর আক্রমণ চালিয়েছেন। হিন্দু রাজারাও পরস্পরের মধ্যে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। শত্রু রাজার একই ধর্ম সেখানে কোনও বাধাই হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাসকদের লক্ষ্য ছিল হয় নিজেদের রাজত্বের সীমানা বাড়ানো, অথবা প্রজাদের উপর সর্বাত্মক আধিপত্য বিস্তার করা। শিখদের সঙ্গে মুঘলদের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার পিছনেও ছিল এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা।

মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোই বিজেপির লক্ষ্য

কিন্তু মুসলমান বিদ্বেষের প্রসার ঘটানোর লক্ষে্য সামান্য সুযোগটুকুও হাতছাড়া করতে রাজি নয় বিজেপি। এই লক্ষ্য থেকেই তারা মুসলমান ধর্মাবলম্বী মুঘলদের শত্রু হিসাবে খাড়া করে শিখ সংগঠনগুলির আপত্তি সত্ত্বেও শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের বিরোধের ঘটনায় ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার রঙ লাগাচ্ছে। এ দেশে নানা ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের যে দীর্ঘ সংস্কৃতি রয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে তা নষ্ট করার ষড়যন্তে্র মেতেছে বিজেপি-আরএসএস। এরই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম মৌলবাদও শক্তি সঞ্চয় করছে। ইতিহাস বিকৃত করে বিজেপি-আরএসএস এই মুসলিম মৌলবাদ তথা মুসলিম সন্ত্রাসবাদের শিকড় হিসাবে বার বার মুঘল শাসকদের চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ‘সাহিবজাদে শহিদ দিবস’-এর নাম পাল্টানোর পিছনে রয়েছে সেই একই চাল। এবারই প্রথম নয়। বাবরি মসদিজ ধ্বংসের সময় মুঘল সম্রাট বাবরের নাম নিয়ে মুসলমানদের ভারতছাড়া করার নোংরা স্লোগান তুলেছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীবাহিনী। নানা অজুহাতে তারা বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।

শিখ সম্প্রদায় বিজেপির ফাঁদে পা দিতে রাজি নয়

শিখ সম্প্রদায়ের দুই সংগঠন ঐতিহ্যবাহী ‘সাহিবজাদে শহিদ দিবস’-এর নাম পাল্টে ‘বীর বাল দিবস’ করার শুধু বিরুদ্ধতা করেছে তাই নয়, তারা সরাসরি অভিযোগ তুলেছে যে, বিজেপি সরকার শিখ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। কারণ, শিখ ঐতিহ্য অনুযায়ী গুরু গোবিন্দ সিংহের নিহত দুই পুত্রকে তাঁরা শিশু হিসাবে দেখেন না। শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের তাঁরা ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করেন। ফলে এই দিনটিকে ‘সাহসী শিশু দিবস’ হিসাবে পালন করায় আপত্তি জানিয়েছেন শিখরা। তাছাড়া, বিজেপি-আরএসএসের উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে নিজেদের জড়াতে রাজি নন শিখরা। এর আগে বহু বার এই অপশক্তির আক্রমণের লক্ষ্য কাশ্মীরি মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছে শিখ সংগঠনগুলি।

মুসলমানরা যখন নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধতা করেছেন, শিখ সংগঠনগুলি এগিয়ে এসেছে তাঁদের সাহায্যার্থে। গুরগাঁওয়ে যখন মুসলমানদের শুক্রবারের নমাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, শিখরা নিজেদের গুরদোয়ারার দরজা খুলে দিয়েছিলেন তাঁদের ধর্মাচরণের জন্য। এই উদারবাদী মনোভাব আরএসএস-বিজেপির সহ্য হয় না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিজেদের ভয়ঙ্কর ষড়যন্তে্রর সঙ্গে তারা শিখদের যুক্ত করে নিতে চায়। সেই ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে শিখদের ঐতিহ্য বিকৃত করতেও তাদের বাধছে না।

এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে

কালা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দিল্লি সীমান্তের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে শিখ, মুসলমান, হিন্দু সহ সমস্ত ধর্মের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এবং বহু বাধা অতিক্রম করে দীর্ঘ ও লাগাতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁরা ঐতিহাসিক জয় অর্জন করেছেন। এই জয় শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস কেন্দে্রর বিজেপি সরকারের বুকে কাঁপন ধরিয়েছে। সেই কারণেই তারা জনস্বার্থবিরোধী সরকারি নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ঐক্যবদ্ধ জনগণের মধ্যে যে কোনও সুযোগে ভাঙন ধরাতে চাইছে। একই সঙ্গে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দিতে বিজেপি সরকার প্রতি মুহূর্তে কোনও না কোনও সাম্প্রদায়িক ইস্যু খুঁচিয়ে তুলছে। ২৬ ডিসেম্বর দিনটিকে বীর বাল দিবস ঘোষণা করা তাদের সেই ষড়যন্ত্রেরই অঙ্গ।