রেলে শূন্যপদে অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগ কী উদ্দেশ্যে?

নতুন কোনও নিয়োগ হবে না৷ জানিয়ে দিল রেল কর্তৃপক্ষ৷ অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদেরই কিছু পদে ‘এক্সটেনশন’ দিয়ে চলবে রেলের কাজ৷ গত সেপ্টেম্বর মাসেই অবসরের পর কর্মীদের কার্যকালের মেয়াদ দুবছর বাড়িয়ে দিয়েছিল রেল৷ তিন মাসের মধ্যেই সেটা বাড়িয়ে করা হল পাঁচ বছর৷ অর্থাৎ অবসর গ্রহণের পরে কর্মীরা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত কাজ করবেন৷ অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য শুধুমাত্র বেতন দেওয়া হবে৷ ওই সময়ের জন্য কোনও ‘পেনশন’ বা ‘গ্র্যাচুইটি’র টাকা দেওয়া হবে না৷ অথচ রেল সূত্রের খবর অনুযায়ী শুধুমাত্র গ্রুপ ডি স্তরেই আড়াই লক্ষেরও বেশি শূন্যপদ রয়েছে৷

শূন্যপদে নতুন কর্মী নিয়োগ না করে পুরনো কর্মীদের মাধ্যমেই কাজ করানোর সিদ্ধান্ত বারবার কেন নিচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ? প্রশ্নটি দীর্ঘদিনের এবং এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে অনেক গভীরে৷ দেশে ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার হিসাবটা সকলেরই জানা৷ দেশের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে লক্ষ লক্ষ বেকারের চাকরির কথাও ঘোষণা করছেন৷ চলছে নতুন কর্মসংস্থানের ঢক্কানিনাদ – ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি৷ কিন্তু সবই মরীচিকা৷ প্রতি বছরই লাফ দিয়ে বাড়ছে বেকার সংখ্যা, বন্ধ হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ৷ বন্ধ কলকারখানা খোলা, শ্রম নিবিড় নতুন কারখানা গড়ে তোলার পরিবর্তে প্রতিদিন একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে৷ চলছে লে অফ, লক আউট৷ অন্যদিকে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে যতটুকু কাজের সুযোগ ছিল, সেখানেও নতুন করে কোনও নিয়োগ হচ্ছে না৷ অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই কর্মহীন বেকার যুবকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জীবন্ত একটা ল্যাবরেটরিতে পরিণত হয়েছে রেল৷ চলছে কর্মীসংকোচন৷ বিভিন্ন বিভাগ (টিকিটিং, ক্লিনিং, ক্যাটারিং প্রভৃতি) ইতিমধ্যেই বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷ বিভিন্ন ডিভিশনে কর্মীর অভাবে রেলের কাজ পরিচালনা করার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে৷ প্রায়শই ঘটছে দুর্ঘটনা৷ রেল লাইন সহ পরিকাঠামোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও সময়োপযোগী মেরামতির যে চূড়ান্ত ব্যর্থতা রয়েছে তার মাসুল দিতে হচ্ছে যাত্রীদের এবং এর কোনটাই সরকারের অজানা নয়৷ অথচ নতুন নিয়োগের প্রশ্নে তারা আর্থিক সংকটের অজুহাত দেখাচ্ছেন৷ আসলে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিটাই এখানে মূল বিষয়৷ পূর্বতন কংগ্রেস বা বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপি সকলেই দেশজুড়ে রেল পরিষেবায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে সমগ্র ব্যবস্থাটিকে বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ পণ্য বিভাগগুলিকে তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি মালিকদের হাতে৷ এমনকী রেলের বিভিন্ন বিভাগে স্থায়ী কর্মচারীর পরিবর্তে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের পরিকল্পনাও শুরু হয়েছে৷ ভোটের মঞ্চে নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিলেও নতুন কর্মী নিয়োগ, তাদের দক্ষ করে তোলার কাজটা সরকারের কাছে বিরাট অঙ্কের টাকা খরচ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ রেল কর্তৃপক্ষ এও দেখিয়েছেন যে নতুন কর্মী নিয়োগ করলে সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা আসবে না৷ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে অনেক সময় লেগে যাবে৷ ফলে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা দক্ষ কর্মীর অভাব মেটাবে৷ রেলের এহেন ভাবনা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়৷ এটা বিজ্ঞানসম্মত যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যায়৷ ফলে প্রয়োজন কর্মক্ষম নতুন কর্মীর৷ যোগ্য নতুন কর্মীদের দক্ষ করে তুলে তাদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ করতে হয়৷ দায়িত্বটা রেল কর্তৃপক্ষেরই৷ এর সাথে স্তরে স্তরে বহু মানুষের কাজের সুযোগও যুক্ত হয়ে থাকে৷ আবার যে সমস্ত পুরনো কর্মীদের বাড়তি পাঁচ বছর কাজ করানো হবে, তাদের ওই বাড়তি সময়ের জন্য শুধু মূল বেতন দেওয়া হবে৷ কোনও পেনশন বা গ্র্যাচুইটি দেওয়া হবে না৷ বাড়তি সময়ের জন্য কাজ করেও ওই কর্মীরাও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে৷ আবার ওই কর্মীরা পেনশন গ্র্যাচুইটির টাকা ষাট বছরে পাবেন না, পাবেন পঁয়ষট্টি বছর বয়সে৷ ফলে, পাঁচ বছরের বিপুল অঙ্কের টাকা জমা থাকবে সরকারের কাছে বা অন্যত্র খরচ করা হবে এবং ওই খরচ থেকে যাঁর টাকা তাঁর উপকৃত হওয়ার কোনও সুযোগ থাকবে না৷ আবার নিয়োগ না হওয়ার জন্য নতুন কর্মীদের পেনশন গ্র্যাচুইটি দেওয়ার কোনও দায়বদ্ধতা সরকারের থাকবে না৷

ক্ষমতায় আসার পরে প্রধানমন্ত্রী প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রেলের পণ্যমাশুল ও যাত্রী ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ প্রতি বছর রেলের যে আয় হয় বা বিপুল পরিমাণ যে বাজেট বরাদ্দ করা হয় তা নেহাৎ কম নয়৷ আবার প্রতিবছর রেলের বিভিন্ন বিভাগে স্তরে স্তরে যে বিপুল পরিমাণ চুরি–দুর্নীতি হয় তা বন্ধ করতে পারলে কোষাগারে বিপুল অঙ্কের টাকা আসতে পারত৷ এই টাকা দিয়ে কর্মীদের বেতন দেওয়া, নতুন কর্মীদের দক্ষ করে তোলা অতি সহজেই করা যেত৷ সাথে সাথে যাত্রী মাশুল, পণ্যমাশুলও অনেকটা কম করা যেত৷ এটা না করে, নিয়োগ বন্ধ করে দিয়ে, পুরনো কর্মীদের পুনর্নিয়োগ করে আসলে রেল পরিষেবার সরকারি দায়িত্বকেই অস্বীকার করা হচ্ছে৷ আর্থিক বোঝার অজুহাতে, স্থায়ী কর্মীর বদলে ঠিকা কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে সমগ্র পরিষেবাটাকেই বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ দেশজুড়ে কম খরচে পণ্য পরিবহণ ও যাত্রী পরিবহণে রেলের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তা ধ্বংস করে সমগ্র পরিষেবাকে মালিকদের মুনাফা করার মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করা হচ্ছে৷ মোদি সরকারের এই ভূমিকায় বন্ধ হচ্ছে বেকার যুবকদের কাজ  পাওয়ার সুযোগ৷