পুঁজিবাদী মুনাফা-লালসায় সভ্যতা আজ বিপন্নঃ বিশ্ব উষ্ণায়ন

বিশ্ব-উষ্ণায়ন ও তার পরিণাম নিয়ে বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানী ও পরিবেশ-সচেতন মানুষ গত কয়েক বছর ধরেই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। সেই উদ্বেগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তঃসরকার সংগঠন আইপিসিসি-র একটি রিপোর্ট। ৯ আগস্ট প্রকাশিত এই রিপোর্টে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহ পরিণামের ছবি তুলে ধরে দেখানো হয়েছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞানীদের আগেকার হিসাব মতো তাপমাত্রার এই পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল ২০৪০ সাল নাগাদ। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করা হবে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে সেই সীমা দ্রুত অতিক্রান্ত হয়ে যাবে। পরিণামে মেরু অঞ্চলের বরফ ও হিমবাহগুলি গলবে। বাড়বে সমুদ্রের জলস্তর। এমনিতেই ১৯০১-১৯৭১ সাল পর্যন্ত সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ১.৩ মিমি। ২০০৬-২০১৮ সালের মধ্যে সেই হার বেড়ে হয়েছে বছরে গড়ে ৩.৭ মিমি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই হার স্বাভাবিক ভাবেই আরও বাড়বে। ফলে বিশ্ব জুড়েই উপকূলীয় অঞ্চলগুলি ধীরে ধীরে চলে যাবে জলের তলায়। শুধু তাই নয়, পরিবেশের এই পরিবর্তনের হাত ধরে পৃথিবীর বুকে আরও ঘন ঘন আছড়ে পড়তে থাকবে তাপপ্রবাহ, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো নানা বিপর্যয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব এই রিপোর্টকে ‘কোড রেড ফর হিউম্যানিটি’ বা মানবসভ্যতার পক্ষে ভয়ঙ্কর এক বিপদসঙ্কেত বলে উল্লেখ করেছেন।

দুনিয়া জুড়ে বিপর্যস্ত পরিবেশ

আইপিসিসি-র এই রিপোর্ট যখন এল, তখন বাস্তবিকই গোটা দুনিয়া জুড়ে আবহাওয়ায় যেন টালমাটাল চলছে। ২০১৯-এর শেষ দিকে একের পর এক দাবানলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। প্রাণ গেছে ১০০ কোটিরও বেশি জীবজন্তুর। গ্রিস ও তুরস্কে প্রবল দাবানল হাজার হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করেছে। উত্তর আমেরিকায় আগুনে ঝলসে গেছে একের পর এক শহর। ভয়াবহ খরায় এ বছর শুকিয়ে যেতে বসেছে ক্যালিফোর্নিয়ার বৃহত্তম হ্রদ সালটন সি। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইন্টারএজেন্সি ফায়ার সেন্টার’ ৮ আগস্ট দেশ জুড়ে ৩৯ হাজার ২৬৭টি দাবানলের ঘটনার হিসেব দিয়ে জানিয়েছে, এর ফলে দেশের ৩৫ লক্ষ একর জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি সাইবেরিয়ার মতো জায়গা যেটি ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডার জন্য সুপরিচিত, সেখানেও ১৫ লক্ষ হেক্টর জমি আগুনে পুড়ে খাক হয়ে গেছে। ব্রিটেন থেকে কানাডা–তাপমাত্রা বেড়েছে সর্বত্র। পাশাপাশি বেড়েছে বন্যার দাপট। গত বছর ইন্দোনেশিয়ায় বন্যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর হারিয়েছেন। জার্মানি, বেলজিয়ামের নানা অংশ প্লাবনে ভেসে গেছে। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড়। বিধ্বস্ত করে দিয়েছে জনজীবন। ভারতের পরিস্থিতিও ভাল নয়। আমরা দেখছি, ঘূর্ণিঝড় আয়লা, আমফান, ইয়াস ইত্যাদি একের পর এক ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। সমুদ্রে ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে স্থলভাগ। হিমালয় পর্বতে বরফ গলছে। হ্রদগুলিতে জলস্তর বেড়ে পাহাড়ি এলাকায় হড়পা বান আসছে, ধস নামার ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর, আরব সাগরে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে দ্রুত গতিতে, যা পরিবেশের দূষণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।

পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে কেন

প্রশ্ন হল, কেন ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। আইপিসিসি-র রিপোর্টে এর জন্য মানুষের কার্যকলাপকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষকে অভিন্ন সমগ্রতায় বিচার করা যায় না। গোটা দুনিয়া জুড়ে বর্তমানে যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা কায়েম রয়েছে, সেখানে মানুষ বিভক্ত শোষক ও শোষিত– এই দুটি শ্রেণিতে। শাসক-শোষক পুঁজিপতি শ্রেণি যতই গোপন করার চেষ্টা চালাক, বিজ্ঞান-গবেষণা ও পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের সংগৃহীত যাবতীয় পরিসংখ্যান থেকে এ কথা আজ এ কথা আজ স্পষ্ট যে, পরিবেশের এই বিপন্নতার মূলে রয়েছে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। কেন এ কথা বলা হচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করার আগে দেখে নেওয়া যাক, বিশ্ব-উষ্ণায়ন তথা পরিবেশ-সমস্যার পিছনে কোন কোন কারণকে পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন।

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রথম কারণটি হল ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’। ব্যাপারটা অনেকটা শীতের দেশে কাচের ঘর তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ চাষ করার মতো। কারণ, সূর্য থেকে আসা আলো সহজেই কাচের মধ্য দিয়়ে ঢুকে ঘরের ভিতরের সবকিছুকে গরম করে তোলে। কিন্তু গরম হয়ে ওঠা বস্তুগুলি যে তাপরি¬ বিকিরণ করে, সেগুলির তরঙ্গদৈর্ঘ্য হয় তুলনামূলক ভাবে বেশি। তাই ওই তাপরশ্মি কাচ ভেদ করে আর বাইরে চলে যেতে পারে না। আটকে পড়া তাপের কারণে গরম থাকে কাচের ঘর। একে বলে গ্রিনহাউস এফেক্ট। বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাসের কাচের মতো এই ধর্ম আছে। এরাই গ্রিনহাউস গ্যাস। কোনও কারণে বায়ুমণ্ডলে যদি এই গ্যাসগুলির অনুপাত বেড়ে যায়, তাহলে ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত তাপরশ্মি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে বাইরে যেতে পারে না। আটকে থাকা এই তাপের কারণে ক্রমে গরম হয়ে উঠতে থাকে পৃথিবী। উত্তপ্ত হতে থাকে জলভাগও।

এছাড়া, বায়ুমণ্ডলকে ঘিরে থাকে যে ওজোন স্তর, তা সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর অতিবেগুনি রি¬কে ভূপৃষ্ঠে আসতে বাধা দেয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখছেন, পরিবেশ দূষণের কারণে ওজোন স্তর ক্রমাগত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও এই স্তরে ছিদ্র পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে যেখান দিয়ে অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। পরিবেশ পরিবর্তনের অন্যতম কারণ ওজোন স্তরের এই ছিদ্র।

গ্রিনহাউস গ্যাসের অনুপাত বাড়ছে কেন

বায়ুমণ্ডলে কেন বাড়ছে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির অনুপাত? কেনই বা ফুটো হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ রক্ষাকারী ওজোন স্তর? এক কথায় বলা যায়, শিল্প কলকারখানার ব্যাপক প্রসার, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনারের মতো জীবনযাত্রার নানা আধুনিক উপকরণের বিপুল ব্যবহার, যান-বাহনের সংখ্যাবৃদ্ধি, নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস ইত্যাদির কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইড সহ গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির বাড়বাড়ন্ত ঘটছে। পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশের প্রথম যুগ থেকে, অর্থাৎ শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে কলকারখানায় প্রয়োজনীয় শক্তি জোগান দিতে শুরু হয়েছে কয়লা পোড়ানো। বিশ্ব জুড়ে আজও বিদ্যুৎ সহ অন্যান্য শক্তির অন্যতম জোগানদার কয়লা ও খনিজ তেল। সেই কারণে প্রকৃতির বুক থেকে নির্বিচারে বিপুল পরিমাণ কয়লা ও তেল আহরণ করে তা পোড়ানো হচ্ছে। বর্জ্য হিসাবে তৈরি হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড সহ বিষাক্ত নানা গ্যাস। রেফ্রিজারেটর কিংবা এয়ার কন্ডিশনারে ব্যবহৃত হয় ক্লোরোফ্লুরোকার্বন নামে একটি যৌগ যেটি ওজোন স্তরকে ফুটো করে দিচ্ছে। এরই পাশাপাশি চলছে ব্যাপক হারে অরণ্য নিধন। নানা প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় কাজে কাঠ ব্যবহার করতে নির্বিচারে গাছ কাটা চলছে। জমি-হাঙররা গ্রাস করে নিচ্ছে অরণ্যের পর অরণ্য। মাটির তলার খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য পাহাড়-জঙ্গল তছনছ করে প্রকৃতির বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশালাকার আধুনিক যন্ত্র।

এর পাশাপাশি চাষের কাজে অবাধে রাসায়নিক যৌগের প্রয়োগ, প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার, ই-বর্জ্যের বিপুল পরিমাণ ইত্যাদি পরিবেশ দূষণের মাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে বাড়িয়ে তুলছে। পরিবেশকে এমন নির্বিচারে লুঠ করা হচ্ছে যার ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বাস্তুতন্তে্রর শৃঙ্খল যা মানবসভ্যতার পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক।

পরিবেশ ধ্বংসের আসল কারণ

কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনের বিস্তার এবং তার প্রয়োজনে প্রকৃতির আরও বেশি ব্যবহার তো ঘটবেই! তা হলে, পরিবেশ রক্ষা করার জন্য কি উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে? না। সে প্রশ্ন উঠতেই পারে না। আসলে মূল সমস্যাটি লুকিয়ে আছে, যে পদ্ধতিতে এবং যে লক্ষ্য থেকে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন হচ্ছে, তার মধ্যে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণির লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। এই মুনাফা আসে প্রধানত শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে। পাশাপাশি, উৎপাদনের জন্য কত কম খরচে কাঁচামাল সংগ্রহ করা যায়, তা নিয়েও পুঁজিমালিকদের মধ্যে চলে বিপুল প্রতিযোগিতা। কারণ, কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য প্রকৃতিকে যত কম খরচে পুঁজিপতি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে পারবে, ততই তার মুনাফা বাড়বে। ফলে অতিরিক্ত মুনাফার তাড়নায় পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় চলতে থাকে প্রকৃতির অতিরিক্ত শোষণ। যেমন, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদিতে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি)-র ব্যবহার কমানো গেলে ওজোন স্তরকে রক্ষা করা যায়। ফসিল জ্বালানির বদলে যত দূর সম্ভব বিকল্প শক্তির উৎস ব্যবহারের পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন বিকল্প রাস্তার জন্য গবেষণা ও পরিকাঠামো নির্মাণ। কিন্তু তাৎক্ষণিক মুনাফা হবে না, এমন কোনও বিষয়ে টাকা ঢালতে রাজি নন শিল্পপতিরা। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ওজোন স্তরের বিপদ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বারবার বলে আসা সত্তে্বও অবাধে ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের ব্যবহার চলছে। অস্ট্রেলিয়ায় বারবার খরা এবং দাবানলের পিছনে রয়েছে উষ্ণায়ন, যার জন্য কয়লা পোড়ানো বহুলাংশে দায়ী। বিপুল পরিমাণে কয়লা উৎপাদিত হয় অস্ট্রেলিয়ায়। বহু কোটি ডলারের মুনাফা জড়িয়ে রয়েছে এই শিল্পের সঙ্গে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে এখানে কয়লা শিল্পে কাজ চলে, তাতে পরিবেশ ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবিলম্বে এই উৎপাদন পদ্ধতি পাল্টানো দরকার। কিন্তু পুঁজিপতিদের স্বার্থবাহী অস্ট্রেলিয়ার সরকার পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও কয়লাশিল্পে কোনও রকম নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে নারাজ। কারণ বিকল্প উৎপাদন পদ্ধতি সংক্রান্ত গবেষণা ও তার প্রয়োগের খরচ বহন করে মুনাফার পরিমাণ কমাতে রাজি নন পুঁজিপতিরা।

শুধু তাই নয়, শিল্প উৎপাদনে তৈরি হওয়া বর্জ্য পদার্থও প্রকৃতিকে দূষিত করে। পরিবেশের সুস্থিতি রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ব্যবস্থা করা। কিন্তু সে বাবদে পুঁজিমালিকরা মুনাফায় ভাগ বসিয়ে টাকা খরচ করতে তারা রাজি নয়। ফলে বিজ্ঞানী ও পরিবেশ-কর্মীদের বারবার সতর্কবার্তা সত্ত্বেও অবাধে কলকারখানার বর্জ্য নদীনালায় ফেলা হচ্ছে যা পরিবেশ ক্রমাগত দূষিত করে তুলছে। এছাড়া জমা হচ্ছে বিপুল প্লাস্টিক বর্জ্য। প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি জিনিসের বৈশিষ্ট্য এমন যে, ব্যবহারের পর ফেলে দিলে তা জীবাণু দ্বারা বিশ্লিষ্ট হয়ে বা অন্যভাবে কোনও দিনই প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায় না। প্লাস্টিক দূষণ আজ মারাত্মক আকার নেওয়া সত্তে্বও এর ব্যবহার ক্রমে এতটাই বেড়ে চলেছে যে আজ পৃথিবীর প্লাস্টিকনির্মিত বোতল ও পাত্রের মোট ওজন সমুদ্রে থাকা সমস্ত মাছের মোট ওজনকে ছাপিয়ে গেছে!

অন্যান্য দেশের মতো ভারতের বড় শহরগুলিও আজ সমস্ত ধরণের দূষণের শিকার। সরকারের হেলদোল নেই। শুধু তাই নয়, পরিবেশ ব্যাপক দূষিত হওয়া সত্ত্বেও অবাধে তারা চলতে দিচ্ছে স্পঞ্জ আয়রনের মতো মারাত্মক দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানা। পুঁজিমালিকদের মুনাফার স্বার্থে সরকার পাহাড়-জঙ্গল-নদ-নদী-খাল-বিল সহ সমগ্র প্রকৃতিকে লুঠ হয়ে যেতে দিচ্ছে অবাধে।

শুধু নিজের দেশেই নয়, আজ বহুজাতিক পুঁজির যুগে পুঁজিপতিরা বিশ্বের যেকোনও জায়গায় যেখানেই সুযোগ পায়, সেখানেই প্রকৃতিকে ধ্বংস করে কাঁচামাল লুট করার প্রক্রিয়ায় সামিল। এর ফলে বিশ্ব পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে চলেছে, পরিবেশ রক্ষার জন্যই বা কীভাবে কাজ করা প্রয়োজন– এসব নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর সময় বা ইচ্ছা কোনওটাই নেই। ভারতের প্রথম সারির শিল্পপতি আদানি, যিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর প্রবল স্নেহধন্য, অস্টে্রলিয়ায় কয়লাখনি ব্যবসায় মুনাফা লুটতে গিয়ে পরিবেশ দূষণের দায়ে সে দেশের জনসাধারণের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন গত বছর।

দায়ী পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা

বহুদিন আগে মহান এঙ্গেলস তাঁর ‘দ্য পার্ট প্লেড বাই লেবার ইন দি ট্রানজিশন ফ্রম এপ টু ম্যান’ বইয়ে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন, ‘… বিজয়ী বীর যেভাবে অন্য দেশের ওপর শাসন কায়েম করে– তেমন ভাবে, প্রকৃতির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও মানুষের মতো করে প্রকৃতির ওপর আমরা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারি না। আমাদের রক্ত-মাংস-মস্তিষ্ক নিয়ে আমরা প্রকৃতির মধ্যেই বেঁচে থাকি … আমাদের যাবতীয় দক্ষতা শুধু এটুকুই যে, সমস্ত প্রাণীর মধ্যে একমাত্র আমরাই প্রকৃতির নিয়ম জানতে ও সঠিকভাবে সেই নিয়ম প্রয়োগ করতে সক্ষম।’ কিন্তু সর্বোচ্চ মুনাফা-লুঠের সর্বগ্রাসী লোভে পুঁজিপতি শ্রেণি ক্রমাগত তাকে ব্যবহার করছে মানবকল্যাণের বদলে বাড়তি মুনাফা নিংড়ে নিতে। আগুপিছু না ভেবে, প্রকৃতির নিয়ম নির্বিচারে অমান্য করে চরম অবিবেচকের মতো প্রতি মুহূর্তে তারা ধ্বংস করে চলেছে প্রকৃতির ভাণ্ডার।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কর্মপ্রণালীই এমন। তাৎক্ষণিক মুনাফার লোভে পুঁজিপতিদের প্রকৃতি ধ্বংসকারী চরম অবিবেচক আচরণের একটি উদাহরণ মহান এঙ্গেলসের রচনাতেই পাওয়া যায়। কিউবায় কফি উৎপাদন করে বিপুল মুনাফা লুটতে স্পেনীয় প্ল্যান্টাররা যে পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলগুলি পুড়িয়ে দিয়েছিল, সেই উদাহরণটি উল্লেখ করে তিনি দেখিয়েছেন, এতে সারের জোগান বাড়ায় কফি-চাষিদের একটি প্রজন্ম প্রচুর লাভের মুখ দেখেছিল। কিন্তু পরের বারই প্রবল বর্ষায় ধুয়ে গিয়েছিল পাহাড়ের উপরের স্তরের আলগা মাটি। পড়ে থেকেছিল কেবল চাষের অযোগ্য ন্যাড়া পাথর!

অন্যায় শোষণের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক, পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার সরকারগুলি দেশে দেশে চোখ বুজে চলতে দিচ্ছে এই ভয়াবহ ধ্বংসকাণ্ড। মুনাফা লুঠের তাড়না তাদের এমনই যে তারা ভুলতে বসেছে– এই ভয়াবহ দূষণ গোটা মানবসভ্যতাকেই কী দ্রুততার সঙ্গে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলিই সবচেয়ে বেশি দূষণ সৃষ্টি করছে

বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, পরিবেশ দূষিত করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্য উন্নত তথা ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলির দায় সবচেয়ে বেশি। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দূষণ সৃষ্টি করার পিছনেও পৃথিবীর ধনীতম ব্যক্তিদের অবদান বাকি অংশের মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। অ’ফ্যামের একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ মোট দূষণের ৪৯ শতাংশের জন্য দায়ী। আরেকটি গবেষণার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের তিনভাগের দু’ভাগই নিঃসরণ করেছে মাত্র ১০০টির মতো সংস্থা।

দূষণ সৃষ্টির পিছনে মূলত রয়েছে খনিজ জ্বালানি পোড়ানোর বিষয়টি। এর সঙ্গে আবার সরাসরি যোগ রয়েছে বিশ্বের ধনীতম মানুষগুলির বিপুল সম্পদবৃদ্ধির। একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১০-এ কোপেনহেগেনে এবং ২০১৫-তে প্যারিসে যে দুটি জলবায়ু সম্মেলন হয়েছিল, সেই সময়কালের মধ্যে ফোর্বস তালিকায় নাম থাকা খনিজ জ্বালানি নিয়ে ব্যবসা করা শতকোটিপতির সংখ্যা ৫৪ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৮৮। পরিবেশবিদ-বিজ্ঞানীদের শত আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে পুঁজিপতিরা কেন প্রকৃতিকে এমন নির্মম ভাবে লুঠ করে চলেছে– এ প্রশ্নের জবাব এসব ঘটনা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় না কি?

খুব স্বাভাবিক কারণেই তাই পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষাকারী ধনী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রর সরকারগুলি বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তায় কান না দিয়ে অবাধে চলতে দিচ্ছে প্রকৃতি লুঠ। সামান্যতম লাগাম পরানোরও চেষ্টা করছে না দূষণ সৃষ্টিকারী কাজ-কারবারগুলিতে। দূষণ রোধে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে জলবায়ু সংক্রান্ত শীর্ষবৈঠক হয়েছে। সেখানে সুস্থায়ী উন্নয়ন (সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট) নিয়ে বহু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যাতে পরিকল্পিত ভাবে প্রকৃতি থেকে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের সাথে সাথে নতুন সম্পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা হয়। দেখা গেছে, বৈঠক থেকে ফিরে গিয়ে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির কর্ণধাররা সে সব সিদ্ধান্ত তালাবন্ধ সিন্দুকে তুলে রেখে আগের মতো করেই সবকিছু চলতে দিয়েছেন। গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের ওপর রাশ টানার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এ, ১৯৯৭ সালে। মার্কিন সরকার তাতে স্বাক্ষর করতেই রাজি হয়নি। জোহানেসবার্গে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জলবায়ু সংক্রান্ত দ্বিতীয় বসুন্ধরা সম্মেলন। সেখানে ধনী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনা উঠে আসে যে, তাদের পরিবেশ ধ্বংসের কারণে বিশ্বের গরিব দেশগুলির মানুষকে চরম বিষাক্ত পরিবেশে বাস করার খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ শুধু যে এই সম্মেলনে যোগ দিতে রাজি হননি তাই নয়, সেখানে যখন সুস্থায়ী উন্নয়নের রূপরেখা তৈরির চেষ্টা চলছে তখন তিনি মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণের হুমকি দিচ্ছেন। এ কথা তখনই জানা ছিল আর এখন তো নানা তথ্য প্রমাণে আরও পরিষ্কার যে, ইরাক আক্রমণের পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের খনিজ তেলের বিপুল ভাণ্ডারের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা, মুনাফা-লুটেরারা যে তেলের অবাধ ও অপরিকল্পিত ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীটাকে ধ্বংসের দিকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে দিতে থাকবে।

নতুন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা ছাড়া মানবসভ্যতাকে রক্ষার অন্য উপায় নেই

বিজ্ঞানী জেমস হানসেন, যিনি বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে সচেতনতা প্রসারের জন্য অক্লান্ত লড়াই করে যাচ্ছেন, ২০০৬ সালে ‘দি থ্রেট টু প্ল্যানেট’ নামে এক নিবন্ধে বলেছেন, আমরা এখন প্রজাতিগুলির গণ-বিলুপ্তির এমন এক সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিশ্ব-ইতিহাসের বিগত পর্বে, এমন পরিস্থিতিতে ইতিপূর্বে অনেকবার ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ জীবিত প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলার ফলে সমুদ্রতল যেভাবে উঠে আসছে তা সামলানোর জন্য আমাদের হাতে সময় খুবই সামান্য– বড়জোর বছর দশেক। বলেছেন, মানবসভ্যতাকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে চাইলে এই দশ বছরে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের গতিপথ একেবারে বদলে ফেলতে হবে।

আজ ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে আইপিসিসি-র রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সেই সতর্কবাণীতে পুঁজিবাদী দুনিয়ার বড়কর্তারা কান দিতে রাজি নন। ফলে দ্রুতগতিতে আমরা এগিয়ে চলেছি ধ্বংস ও বিলুপ্তির দিকে।

এই পরিস্থিতিতে মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে ‘গ্রিন মুভমেন্ট’ নামের এক আন্দোলন। বহু দেশে তৈরি হয়েছে ‘গ্রিন পার্টি’। তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও আছে। এরা পরিবেশ সংরক্ষণের কথা প্রচার করে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষা করতে গেলে পরিবেশধ্বংসের মূল কারণ সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদনের যে নীতি ত্যাগ করা দরকার, সে বিষয়ে তাদের প্রায় কারওরই কোনও বক্তব্য বা কার্যক্রম নেই। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সরকারি ক্ষমতা ভোগ করতে পরিবেশ নিয়ে মানুষের উদ্বেগকে ভোটবাক্স ভরে তোলার কাজে লাগান এঁরা। আরও এক ধরনের চিন্তা সমাজে দেখা যায়, যাকে বলা হয় অতি-পরিবেশবাদ। অতি-পরিবেশবাদীরা সমস্ত ধরনের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা যেমন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বা রেললাইন সম্প্রসারণ ইত্যাদির বিরোধিতা করেন। তাঁদের এই চিন্তাও সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞানবিরোধী।

বিজ্ঞানসম্মত সঠিক চিন্তা হল, প্রকৃতিকে যথাসম্ভব সংরক্ষণ করে মানবজাতির সামগ্রিক স্বার্থে উৎপাদন করা। তা করতে গেলে উৎপাদনকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য থেকে বের করে আনা দরকার। অর্থাৎ প্রয়োজন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে উন্নততর সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা কায়েম করা যেখানে উৎপাদন হয় জনসাধারণের সামগ্রিক স্বার্থে, ব্যক্তিমালিকের সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে নয়। জনসাধারণের সামগ্রিক স্বার্থ যেহেতু প্রকৃতির স্বার্থের সাথে সম্পূর্ণভাবে জড়িত, তাই এই ব্যবস্থায় প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে, তার নিয়মগুলি বুঝে তাকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়। সর্বোচ্চ মুনাফা নয়, মানুষের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি সেখানে লক্ষ্য থাকে প্রকৃতির ক্ষতি সর্বনিম্ন রাখা এবং মূল উৎপাদনের সাথে সাথে উৎপন্ন দূষিত পদার্থগুলির পরিমাণ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, সেগুলিকে যথাযথ শোধন করা ও পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা।

পরিবেশ ধ্বংসের ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে তাই আমাদের দাবি তুলতে হবে, সর্বোচ্চ মুনাফার উদ্দেশ্যে নয়, মানুষের সামগ্রিক স্বার্থে উৎপাদন চাই। অবিলম্বে প্রকৃতির নির্বিচার ধ্বংস বন্ধ করার লক্ষে্য ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। সেই লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী গণআন্দোলন। এই আন্দোলনগুলিই পুঁজিপতি শ্রেণির সর্বোচ্চ মুনাফা লুটের অন্যায় সমাজব্যবস্থাটিকে উচ্ছেদের পরিপূরক হিসাবে কাজ করবে। এই পথেই গড়ে তোলা যাবে পরিবেশবান্ধব সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে প্রকৃতির সন্তান হিসাবে অবস্থান করবে মানুষ। মানবসমাজের সামগ্রিক স্বার্থে প্রকৃতির অঢেল সম্পদ সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করার সাথে সাথে প্রকৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য সংগ্রাম করবে মানুষ।