জনগণের দাবি নিয়ে ১১ দফা দাবিতে ১৩ নভেম্বর নবান্ন ও উত্তরকন্যা অভিযান

জনগণের দাবি নিয়ে পথে নেমেছে এসইউসিআই (সি), স্বাক্ষর দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করুন

১১ দফা দাবিতে ১৩ নভেম্বর নবান্ন ও উত্তরকন্যা অভিযান

দেশ জুড়ে সর্বাত্মক সংকট৷ গরিবি বেকারিতে জর্জরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবনের পরতে পরতে আজ অন্ধকার৷ কোনও সরকার– কী কেন্দ্র, কী রাজ্য– কারওরই এতটুকু উদ্বেগ নেই৷ ফুঁসে ওঠা ক্ষোভ সামাল দিতে মাসে মাসে কিছু খয়রাতির দাক্ষিণ্য জনগণের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তারা ব্যস্ত ভোটের হিসাব কষতে৷ অথচ ভোটে সরকার পাল্টে যে মানুষের জীবনের সমস্যাগুলির সুরাহা হবে না তা আজ জলের মতো পরিষ্কার৷ অভিজ্ঞতা বলছে, কোনও শাসকই জনজীবনের দুর্দশা ঘোচাতে কাজের কাজ কিছু করবে না৷ তাই নিজেদের সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে জনগণকেই৷ ন্যায্য দাবি আদায়ের একমাত্র রাস্তা দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে তা মানতে বাধ্য করা৷ সংকটে জর্জরিত সব স্তরের মানুষকেই সেই আন্দোলনে সামিল হতে হবে৷ এস ইউ সি আই (সি) সেই গণআন্দোলনেরই ডাক দিয়েছে৷ সাড়া দিচ্ছে মানুষ৷ রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে ১১ দফা দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান৷ কয়েক কোটি মানুষের সই নিয়ে ১৩ নভেম্বর রাজপথ অনুরণিত হবে নবান্ন এবং উত্তরকন্যার উদ্দেশে মহামিছিলের পদধ্বনিতে৷

কী দাবি তুলেছে মানুষ? সকলেরই স্মরণে আছে, অবিলম্বে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর দাবিতে ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই সারা বাংলা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল এস ইউ সি আই (সি)৷ দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলনের পর ডাকা এই ধর্মঘটকে সফল করতে সেদিন এ রাজ্যের কোটি কোটি মানুষ সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন৷ আন্দোলনের চাপে শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা দ্রুত পাশ–ফেল চালু করবেন৷ অথচ গভীর বিস্ময়ে মানুষ লক্ষ করছে, প্রথম শ্রেণি থেকে তো দূরের কথা, আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাশ–ফেল চালু করার যে ঘোষণা করেছে, তাও এ রাজ্যে চালু করতে কোনওরকম উদ্যোগ তৃণমূল সরকার নেয়নি৷ প্রাথমিক স্তরে পাশ–ফেল না থাকায় প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে– বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে বারে বারে সামনে আসা সত্ত্বেও সরকারের কোনওরকম সদর্থক ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না৷

নারী নির্যাতন–নারীপাচারে পশ্চিমবঙ্গ দেশে প্রথম স্থানের অধিকারী৷ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত অন্যান্য রাজ্যের মতোই এ রাজ্যে ঘটে চলেছে অসংখ্য নারীধর্ষণ, শিশু ধর্ষণের ঘটনা, চলছে অবাধে নারীপাচার৷ প্রায় সমস্ত ধর্ষণের ঘটনার সাথে যুক্ত দুষৃক্তীদের মদ্যপ অবস্থায়  থাকার বিষয়টি সামনে এলেও, মদ বা মাদক নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে নতুন করে মদের দোকান খোলার সরকারি ছাড়পত্র দিয়ে চলেছে রাজ্য সরকার৷ গ্রাম–শহর সর্বত্র এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেও চলছে মদের রমরমা ব্যবসা, যা ছাত্র–যুবদের অনৈতিক, মূল্যবোধহীন নিকৃষ্ট জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশের মতোই  এ রাজ্যেও ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে অসংখ্য ঋণগ্রস্ত চাষি৷ তৃণমূল সরকারের সময়কালে এ রাজ্যে ২০০০–এর বেশি ঋণগ্রস্ত চাষির মৃত্যু ঘটেছে৷

বন্যা–খরায় লক্ষ লক্ষ চাষি প্রতিবছর সর্বস্বান্ত হচ্ছেন৷ সার–বীজ–কীটনাশক সহ জ্বালানি তেল বা কৃষি বিদ্যুতের দাম কমানোর প্রশ্নে কেন্দ্র ও রাজ্য কোনও সরকারেরই কোনও চেষ্টা নেই৷

পূর্বতন সিপিএম সরকারের ৩৪ বছরের অপশাসনের বিরুদ্ধে এ রাজ্যের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন৷ গড়ে উঠেছিল সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের ইতিহাস তৈরি করা প্রতিরোধ আন্দোলন৷ যাকে ভিত্তি করে বহু আশা–ভরসা নিয়ে মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিল৷ আশাহত সেই মানুষগুলোই আজ আবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন৷ কাটমানি, চিটফান্ড, নিয়োগ–দুর্নীতি সহ বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত শাসকদলের নেতা–মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে চলছে প্রবল গণবিক্ষোভ৷ রাজ্য সরকার শিক্ষা–স্বাস্থ্যের বেহাল পরিকাঠামো সহ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির স্থায়ী সমাধানের উপযুক্ত পদক্ষেপ না করে, ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানোর লক্ষ্যে কন্যাশ্রী–যুবশ্রী–রূপশ্রী মতো শুধুমাত্র কিছু প্রকল্প গ্রহণ করে দান–খয়রাতির রাজনীতিকেই লালন–পালন করে চলেছে৷

রাজ্যের এই যখন হাল, তখন পুনরায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়ে বিজেপি একদিকে ধর্ম বর্ণ জাত পাতকে কেন্দ্র করে কোথাও এনআরসি করে জাতিগত কোথাও ভাষাগত বিভেদ তৈরি করে মানুষে মানুষে সংঘাত বাধাচ্ছে৷ পাশাপাশি একের পর এক সর্বনাশা নীতি ও আইন চালু করে জনজীবনের সংকট বাড়িয়ে তুলছে৷ এর বিরুদ্ধে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে একজোট করার বদলে তৃণমূল সরকারও নরম হিন্দুত্ববাদের প্রতিযোগিতার ক্ষতিকর রাস্তায় নেমেছে৷ বিজেপিকে রুখতে তারা ইমাম ও পুরোহিত ভাতা চালু করা, হনুমান পুজো, রামনবমী পালন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই উৎসাহিত করছে যা আদতে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেই শক্তিশালী করতে সাহায্য করছে৷ এর বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন গড়ে তোলার পরিবর্তে সিপিএম–সিপিআই–এর মতো বামদলগুলি পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পেতে বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির দল কংগ্রেসকে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আখ্যা দিয়ে তার সাথে সুবিধাবাদী নির্বাচনী জোট গড়ে তোলার মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ মানুষের জীবনের সংকট দূর করা নয়, তাদের একমাত্র লক্ষ্য যে কোনও ভাবে হোক ভোটে জেতা৷

এই অবস্থায় একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) একদিকে রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতি, অন্যদিকে কেন্দ্রের আর্থিক ও সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন সংগঠিত করে চলেছে৷ পাশ–ফেল চালু করা, মূল্যবৃদ্ধি রোধ, শ্রমিক–কৃষকের জীবনের সমস্যা, বেকারি দূর করা, নারী নির্যাতন ও মদের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ সহ ১১ দফা দাবিতে রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান৷ ১৩ নভেম্বর দক্ষিণবঙ্গে নবান্নে ও উত্তরবঙ্গে উত্তরকন্যাতে মহামিছিল করে দাবিপত্র পেশ করবে লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ তারা জানিয়ে দেবে লক্ষ মানুষের এই বজ্রনির্ঘোষকে উপেক্ষা করার চেষ্টা হলে আন্দোলন হয়ে উঠবে অপ্রতিরোধ্য৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৮ সংখ্যা)