ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক মতলবেই কাঠুয়ায় শিশুকন্যার নৃশংস হত্যা

ফাইল চিত্র

জম্মুর কাঠুয়ায় আট বছরের শিশুকন্যার নৃশংস গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সাঞ্জী রাম সহ তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল পাঠানকোটের বিশেষ আদালত৷ আরও তিন অপরাধীর জন্য বরাদ্দ হয়েছে পাঁচ বছরের জেল৷ প্রশাসন ও আদালতের এই পদক্ষেপে সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন দেশের মানুষ৷ যদিও এই রায়ে খুশি নন হতভাগ্য মেয়েটির শোকসন্তপ্ত মা–বাবা৷ তাঁরা অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড চান৷ স্বয়ং সরকারি আইনজীবীও তাদের আরও কড়া শাস্তির দাবিতে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন৷ মানুষের আশা, ভবিষ্যতে হয়তো ওই নরপিশাচগুলি কঠোরতর শাস্তি পাবে৷ কিন্তু শুধুমাত্র অপরাধীদের ধর্ম বিচার করে যারা তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফয়দা লোটার অপচেষ্টা চালিয়ে গেল, এই নৃশংসতায় শিউরে ওঠা শুভবুদ্ধির মানুষের উদ্বেগকে শুধু বিশেষ এক ধর্ম–সম্প্রদায়ের প্রতি তোষণমূলক মনোভাব বলে নিন্দার ঝড় তুলল, তাদের শাস্তি দেবে কে!

কাঠুয়ার নৃশংস ঘটনাটি সম্পূর্ণতই ধর্মকে হাতিয়ার করা অপরাজনীতির৷ সেই কারণেই অপরাধীদের শাস্তি বিধানের আগে অজস্র বাধা পেরোতে হয়েছে মৃত বালিকাটির পরিবারের পাশে দাঁড়ানো সাধারণ মানুষ, আইনজীবী, এমনকি পুলিশ–প্রশাসনকেও৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জম্মু থেকে মামলা সরিয়ে নিতে হয়েছে পাঞ্জাবে পাঠানকোটের আদালতে৷

গত বছর ১০ জানুয়ারি জম্মুর কাঠুয়া জেলার রসানা গ্রাম থেকে নিখোঁজ হয় আট বছরের বালিকা আসিফা৷ মেয়েটি মুসলমান যাযাবর বকরওয়াল সম্প্রদায়ের৷ পরে জঙ্গল থেকে উদ্ধার হয় তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ৷ তদন্তে বেরিয়ে আসে, একটি মন্দিরে তাকে আটকে রেখে ৭ দিন ধরে বাচ্চাটির উপর গণধর্ষণ চালানো হয়৷ শেষে পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে খুন করা হয়৷ জানা যায়, খুন করার ঠিক আগেও তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল৷ তদন্তে উঠে আসে, মুসলমান বকরওয়াল সম্প্রদায়ের মনে ভয় ধরিয়ে জম্মু থেকে তাদের তাড়াতেই এই নৃশংস ঘটনার ছক কষেছিল ওই মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক সাঞ্জী রাম, তার ছেলে, ভাইপো ও দুই বন্ধু, যাদের একজন আবার রাজ্য পুলিশের স্পেশাল অফিসার৷ রাজ্য পুলিশেরই আরও তিন কর্মী প্রমাণ লোপাটে সাহায্য করে সাঞ্জী রামদের৷

মর্মান্তিক এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসতেই গোটা দেশ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে৷ পাশাপাশি সক্রিয় হয়ে ওঠে ধর্মকে হাতিয়ার করা অপ–রাজনীতির কারবারিরা৷ অভিযুক্তদের হয়ে রাস্তায় নেমে গলা ফাটাতে থাকেন জম্মু–কাশ্মীরের তৎকালীন বিজেপি জোট সরকারের মন্ত্রী লাল সিংহ, চন্দ্র প্রকাশ গঙ্গা সহ বিজেপি নেতারা৷ ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’ সহ জম্মুর কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন প্রচার করতে থাকে, অভিযুক্তরা হিন্দু হওয়ায় তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে৷ পাশাপাশি অসম্ভব চাপ ও হুমকির মুখে ফেলা হয় মৃত বালিকাটির হতদরিদ্র মেষপালক পরিবারটিকে৷ ঢালাও মিথ্যা প্রচার করে উস্কানি দেওয়া হতে থাকে নোংরা সাম্প্রদায়িকতায়৷ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির প্রভাবশালী নেতাদের মদতে লোপাট করে দেওয়া হয় বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ৷ এমনকি চার্জশিট পেশ করতেও বাধা দেয় আইনজীবীদের একটি অংশ৷ সরকারি আইনজীবীর পাশাপাশি যে অসমসাহসী আইনজীবী দীপিকা সিংহ রাজাওয়াত সমস্ত বাধা ঠেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আইনি লড়াই চালান, রায় বেরনোর পর তিনি জানিয়েছেন, ‘‘মামলা হাতে নিয়ে আমাকেও হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় দিনের পর দিন আক্রমণ করা হয়েছে৷ এমনকি বাচ্চা মেয়েটির জন্য আইনি লড়াইয়ে অংশ নেওয়ায় এমনও শুনতে হয়েছে– আমি নাকি দেশদ্রোহী!’’

প্রবল বাধার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে কাঠুয়া মামলায় একমাত্র মহিলা পুলিশ অফিসার ডিএসপি শ্বেতাম্বরী শর্মাকেও৷ রায় শুনে তিনি বলেন, ‘‘তদন্তে এত বাধা আসছিল যে আমরা মাঝে মাঝে হতাশ হতাম৷ … তদন্ত ব্যর্থ করতে সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু আমরা দমে যাইনি৷’’ কাঠুয়া মামলা ঘিরে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের অপচেষ্টা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘অভিযুক্তেরা সকলেই হিন্দু৷ অনেক ভাবে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে, তারা আর আমরা একই সম্প্রদায়ের৷ তাই মুসলিম মেয়ের ধর্ষণ–খুনের জন্য নিজের সম্প্রদায়ের কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক নয়৷ এমনকী ঘুষ দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে৷’’ কোনও মতেই তাঁকে দমাতে না পেরে হিন্দুত্বের চ্যাম্পিয়ন সাজা বিজেপি–আরএসএসের দুষ্কৃতীরা হুমকি দেওয়া থেকে শুরু করে ব্ল্যাকমেলের চেষ্টাও ছাড়েনি৷

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বলি কাঠুয়ার ছোট্ট মেয়েটির নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যায় শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ৷ অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে মুখর হয়ে উঠেছিল৷ সেই ফুঁসে ওঠা জনরোষের চাপে শেষপর্যন্ত জেলের ঘানি টানতে হল সাঞ্জী রাম সহ অন্যান্য দুষ্কৃতীদের৷ অপরাধীদের শাস্তি হওয়ায় আপাতত চুপ করেছে সাঞ্জী রামদের স্যাঙাৎ উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা৷ কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ ছড়ানোর কাজে তাদের ভাটা পড়েনি৷ এখন তারা বেছে নিয়েছে অন্য হাতিয়ার যা স্পষ্ট হল উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে আড়াই বছরের এক শিশুকন্যা হত্যার সাম্প্রতিক ঘটনায়, যেখানে অভিযুক্তরা মুসলমান সম্প্রদায়ের৷

মাত্র ৫০০০ টাকা ধার শোধ না করায় আলিগড়ে এক দম্পতির শিশুকন্যাকে নৃশংস ভাবে খুন করেছে দুই নরপিশাচ৷ এদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য৷ কিন্তু এ–ও সত্য যে এই মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে সম্প্রদায়গত বিরোধের কোনও যোগসূত্র নেই৷ তা সত্ত্বেও, যেহেতু অভিযুক্ত দু’জন মুসলমান ধর্মাবলম্বী, তাই ঘটনা সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার ঝড় তোলার প্রবল অপচেষ্টা চালায়৷ শুধু তাই নয়, আলিগড়ের যে টপ্পল এলাকার এই ঘটনা, সেখানে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বজরং দল এক মহা–পঞ্চায়েত ডেকে বসে৷

এর আগেও এ ধরনের ঘটনা দেখা গেছে৷ গত বছর জুন মাসে মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে একটি সাত বছরের বালিকাকে ধর্ষণ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের এক দুষ্কৃতী৷ এলাকার মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষই অপরাধীকে পুলিশে দেয়৷ তা সত্ত্বেও ঘটনাটিতে সাম্প্রদায়িকতার রঙ চড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালায় বিজেপি ও সংঘ পরিবার৷ যদিও সে অপচেষ্টা সফল হয়নি৷ একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে রাজস্থানের বারমেরে৷

নানা ধর্ম, নানা ভাষার এই দেশে সংস্কৃতির মূল সুরটি চিরদিনই ঐক্যের তারে বাঁধা৷ সাধারণ মানুষ সম্প্রদায় নির্বিশেষে মিলেমিশে শান্তিতেই থাকতে চেয়েছে৷ একে অপরের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধাই করেছে৷ কিন্তু ইদানীং মাঝে মাঝেই সেই সুর ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতার তীব্র হুঙ্কার৷ এ দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিনশো শিশু যৌন নির্যাতন সহ নানা ধরনের অত্যাচারের শিকার– যা ভারতবাসী হিসাবে প্রত্যেকের কাছে অত্যন্ত লজ্জার৷ কিন্তু ইদানীং শিশু নির্যাতনের মতো মর্মান্তিক ঘটনাকে কিছু মতলববাজ অপশক্তি চরম নির্লজ্জের মতো ব্যবহার করছে মানুষে মানুষে বিরোধ বাধিয়ে দেওয়ার জঘন্য অপচেষ্টায়৷ হতভাগ্য শিশুগুলির জন্য বুকভাঙা যন্ত্রণার বদলে, অপরাধী নরপশুগুলির প্রতি দুর্দান্ত ঘৃণা ও ক্রোধের বদলে বড় হয়ে উঠছে তাদের ধর্মগত, সম্প্রদায়গত পরিচয়৷ এ তো আরও ভয়ঙ্কর নৃশংসতা!

এ ঘটনা শুধু লজ্জার নয়, গভীর উদ্বেগেরও৷ এই মুহূর্তেই দেশের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এক মানুষ হয়ে এই ধর্মীয় অন্ধতা, এই হিংস্র পাশবিক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সম্প্রদায়গত সহাবস্থান, মানুষে মানুষে ঐক্যের সংস্কৃতি প্রসারে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন৷ সেই রাস্তা ধরেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলির সাথে পাঞ্জা লড়ে সাঞ্জী রামদের শাস্তি দিতে সক্ষম হলেন শুভবুদ্ধির মানুষ৷ কাঠুয়া মামলার রায় সেই শুভশক্তির জয়ের কথাই ঘোষণা করে গেল৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা)