কমরেড সনৎ দত্তের জীবনাবসান

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রবীণতম সদস্য এবং শ্রমিক সংগঠন এআইইউটিইউসি–র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রাক্তন সভাপতি এবং সর্বভারতীয় কমিটির প্রাক্তন সহ সভাপতি বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা কমরেড সনৎ দত্ত দীর্ঘ অসুস্থতার পর ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর৷

তাঁর মৃত্যুসংবাদে দলের কর্মী–সমর্থক–দরদি এবং শ্রমিকদের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে৷ এআইইউটিইউসি এবং এস ইউ সি আই (সি) রাজ্য দপ্তরে এবং বিভিন্ন পার্টি অফিসগুলিতে রক্তপতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় ও কমরেডরা কালো ব্যাজ পরিধান করেন৷ মৃত্যুসংবাদ পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সর্বভারতীয় শ্রমিক নেতা কমরেড শঙ্কর সাহা এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজ্য সম্পাদক কমরেড সৌমেন বসু৷ তাঁরা কমরেড সনৎ দত্তের মরদেহে মাল্যদান করেন৷ মাল্যদান করেন দলের রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য কমরেড সদানন্দ বাগল৷ এরপর তাঁর মরদেহ  কলকাতার ‘পিস ওয়ার্ল্ড’–এ রাখা হয়৷ ২৪ ডিসেম্বর সকালে তাঁর মরদেহ দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর ৪৮ লেনিন সরণিতে এবং এআইইউটিইউসি–র রাজ্য দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলে কমরেড সনৎ দত্তের মরদেহে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা ও বিপ্লবী অভিবাদন জ্ঞাপন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ, পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড রণজিৎ ধর ও কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সৌমেন বসু, কমরেড শঙ্কর সাহা, কমরেড গোপাল কুণ্ডু, কমরেড ছায়া মুখার্জী৷ উপস্থিত ছিলেন দলের অন্যান্য রাজ্য নেতৃবৃন্দ, গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ৷ এরপর তাঁর মরদেহ উত্তর ২৪ পরগণার আগরপাড়ায় দলের কার্যালয়ে পৌঁছলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়৷

প্রয়াত কমরেড সনৎ দত্ত বর্ধমানে কলেজ ছাত্র অবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটির প্রয়াত সদস্য কমরেড প্রীতীশ চন্দের মাধ্যমে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন৷ কৃতী ছাত্র হিসাবে তিনি বিএসসি–তে গোল্ড মেডেলও পেয়েছিলেন৷ কিন্তু সচ্ছল জীবনের আরাম আয়েস এবং কেরিয়ারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তা এবং শিক্ষার আধারে ‘দলই জীবন’ এই আদর্শকে পাথেয় করে এ দেশের মাটিতে একটি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন৷ ১৯৪৮ সালে জয়নগরে দলের প্রথম প্রতিষ্ঠা কনভেনশনে কমরেড সনৎ দত্ত উপস্থিত ছিলেন৷

১৯৫২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি বর্ধমানের রায়না বিধানসভা কেন্দ্রেদলের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন৷ এরপর তিনি দলের নির্দেশে চলে আসেন উত্তর ২৪ পরগণা জেলার আগরপাড়া কামারহাটি অঞ্চলে চটকল শ্রমিকদের মধ্যে থেকে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে৷ ১৯৫৫ সালে কমরেড শিবদাস ঘোষের পথনির্দেশে গঠিত হয় ‘বেঙ্গল জুট মিলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’৷ এই সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকেই কমরেড সনৎ দত্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দীর্ঘকাল পালন করেছেন৷ একই সাথে দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি দলের উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন৷ হাতে গোনা ৩–৪ জন কমরেডকে সঙ্গে নিয়ে তিনি জেলায় দলের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন৷ জেলায় দল এবং ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীদের কাছে কমরেড সনৎ দত্ত ছিলেন পিতৃতুল্য নেতা৷ স্নেহ–ভালবাসা এবং আদর্শবোধ দিয়ে দলের কর্মীদের এবং সাধারণ শ্রমিকদের তিনি উদ্বুদ্ধ করতেন৷ নিজেও অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন৷ শুরুর দিকে টিউশন পড়িয়ে অতিকষ্টে হলেও হাসিমুখে জীবন নির্বাহ করেছেন৷ শ্রমিক শ্রেণি বিশেষ করে চটকল শ্রমিকদের মধ্যে পড়ে থেকে তিনি সংগঠন গড়েছেন৷ আগরপাড়া জুটমিল, কামারহাটি জুটমিল, প্রবর্ত্তক জুটমিল এবং হিমানী কোম্পানি সহ বিভিন্ন কারখানায় কমরেড সনৎ দত্ত ইউনিয়ন এবং শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলেন৷ গঙ্গা নদীর দু’পারে উত্তর ২৪ পরগণা ও হুগলি জেলায় তিনি চটকলের গেটে গেটে যেতেন, শ্রমিকদের নিয়ে ক্লাস করতেন৷ তাঁর সময়ানুবর্তিতা, আদর্শগত চর্চা, সহজ সরল ভাষায় সমস্যাকে বোঝাতে পারার ক্ষমতায় শ্রমিকদের ক্লাসগুলি প্রাণবন্ত হয়ে উঠত৷ এই নিরলস সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কমরেড দত্ত চটকল শ্রমিক আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ চটকল শ্রমিকদের সমস্যাগুলিকে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝেছেন৷ অন্যান্য সরকারি কমিটিতেও তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন৷ তিনি ছিলেন নিরহঙ্কার, প্রচারবিমুখ, সবসময় চাইতেন নতুনদের দায়িত্ব দিতে এবং এগিয়ে দিতে৷ যতদিন শারীরিক দিক থেকে সমর্থ ছিলেন ততদিন তিনি দল এবং শ্রমিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন৷ জীবনের শেষের সাত–আট বছর তিনি নানা রোগজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়েন৷

কমরেড সনৎ দত্তের মৃত্যুতে দল হারাল একজন বিপ্লবী নেতাকে, শ্রমিক আন্দোলন হারাল এক বলিষ্ঠ নেতাকে৷

কমরেড সনৎ দত্ত লাল সেলাম