প্রতিবাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করতেই শিক্ষকদের আচরণবিধি

সম্প্রতি কলকাতা গেজেটে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষাবিভাগের প্রধান সচিব দুষ্মন্ত নারিয়েলের দ্বারা প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তিকে কেন্দ্র করে শিক্ষামহল আলোড়িত৷ আলোচনা মূলত শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে আচরণবিধি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে৷

এই গেজেট বিজ্ঞপ্তি নং–৯৮৪–এস ই/এস/১–এ–১০–২০১৭–এর চার নম্বর ধারায় ‘কোড অফ কন্ডাক্ট অ্যান্ড ডিসিপ্লিন অফ টিচার অর নন টিচিং স্টাফ অফ দ্য রেকগনাইজড ইনস্টিটিউশন’ ২৪টি উপধারায় শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে সতর্ক করা ও এই বিধি লঙঘনে ৫ নং ধারায় শৃঙ্খলাজনিত কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলা আছে৷ শিক্ষামহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে আমাদের রাজ্য সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ও পোষিত বিদ্যালয়ে শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে চাকরির শর্তাবলি তো ইতিমধ্যেই ছিল, তা হলে কী কারণে সরকারকে নতুন করে আচরণবিধি প্রণয়ন করতে হচ্ছে?

আমাদের দেশের শিক্ষার অগ্রগতি ও বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শিক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কখনওই যথাযথ ছিল না৷ প্রাক স্বাধীনতা যুগে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গরজ ছিল না বলেই সে যুগে শিক্ষাপ্রেমী মানুষদের যথেষ্ট সরব হতে হয়েছিল৷ সে যুগেই রবীন্দ্রনাথকে বলতে হয়েছিল ‘দেশকে শিক্ষা দেওয়া স্টেটের গরজ’৷ লালা লাজপত রাই একই সুরে বলেছিলেন ‘শিক্ষাই জাতির প্রথম প্রয়োজন এবং রাজস্বের সিংহভাগই এই খাতে ব্যয় হওয়া উচিত’৷ কিন্তু দেখা গেল স্বাধীনতার পর শাসকরা পরাধীন দেশের ব্রিটিশ শাসকদের ভাবনার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে৷ যার পরিণামে একদিকে স্বাধীনতার পর থেকেই কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলি শিক্ষার বাজেট অবহেলার মনোভাব প্রকাশ করেছে এবং রাষ্ট্র দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে অভিভাবককুলের উপর আর্থিক দায়িত্ব ক্রমান্বয়ে চাপিয়ে দিয়েছে৷ অন্যদিকে কমিশনের পর কমিশন বসেছে, একের পর এক নির্দেশাত্মক নীতি এসেছে, প্রাথমিক শিক্ষা যা একটি দেশের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে, মেধা ও উৎকর্ষ যা প্রাথমিক স্তর থেকেই ক্রমবিকাশের পথে নিয়ে যেতে হয় তা পঙ্গু করে শিক্ষার ভিত দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দেওয়ার যজ্ঞ ক্রমশ বেড়েছে৷ ১৯৫০ সালে সংবিধানের নির্দেশাত্মক ধারায় ১০ বছরের মধ্যে সর্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা দেশজুড়ে সম্পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মৌলিক অধিকার হিসাবে শিক্ষাকে রাখার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে৷ দশ নয়, তেরো বছর পর এই ব্যর্থতা ঢাকতে ১৯৬৪–১৯৬৬ সালে কোঠারি কমিশনের মারফৎ গত দশকের শিক্ষার অগ্রগতি বিশ্লেষণে আকাঙিক্ষত উন্নতি সাধন না হওয়ার কথা বলে কল্পনা ও অভীষ্ট সাধনের উন্মাদনার কথা বলে শিক্ষা কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু সদর্থক সুপারিশ করা হয়েছিল৷ সরকারি অকর্মণ্যতা অবহেলা ও সদিচ্ছার অভাবে তাও ব্যর্থ হয়েছিল৷ এরও দশ বছর পর ১৯৭৬ সালে রাজ্যগুলির অক্ষমতার দোহাই দিয়ে ৪২তম সংবিধান সংশোধন করে শিক্ষাকে যুগ্ম তালিকায় নিয়ে আসা হয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার কেউই শিক্ষার ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করল না৷ এমনকী ভিজিলেন্স কমিটির সুপারিশ ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০ শতাংশ এবং রাজ্য সরকারগুলিকে বাজেটের ৩০ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে৷ সকলেই জানেন বাস্তবে তা হয়নি, কি কেন্দ্রীয় কি রাজ্য উভয় সরকারই শিক্ষার ক্ষেত্রে অবহেলাকেই প্রাধান্য দিয়েছে৷ তাই ১৯৭৬ থেকে দশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর ১৯৮৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পেশ করল জাতীয় শিক্ষানীতি ‘ন্যাশনাল পলিসি অফ এডুকেশন (এনপিই)’ যাতে ছিল অতীতের ভুলের স্বীকৃতি, নয়নভোলানো প্রতিশ্রুতি, মনোমুগ্ধকর বাক্যবিন্যাস৷ এস ইউ সি আই (সি)–র পক্ষ থেকে তখন জাতীয় শিক্ষানীতির প্রতিবাদ করে মুখোশের আড়ালে কীভাবে এই নীতি শিক্ষাসত্তাকে ধ্বংস করবে তা দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করা হয়েছিল৷

পরবর্তীকালে আমাদের দলের বিশ্লেষণ ফলতে দেরি হয়নি৷ অচিরেই এসেছিল ডিপিইপি (ডিসট্রিক্ট  প্রাইমারি এডুকেশন প্রজেক্ট) যার মূল উদ্দেশ্য ছিল গোটা দেশব্যাপী প্রাথমিক স্তরে পাশ–ফেল তুলে দেওয়া, অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাদের শিশুশিক্ষার দায়িত্বে নিয়ে আসা,  যার বিষময় প্রভাব শিশুশিক্ষায় অচিরেই দেখা গিয়েছিল৷ যদিও আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে আরও অনেক আগে ১৯৮১ সালে তৎকালীন সিপিএম পরিচালিত রাজ্য সরকার প্রাথমিক স্তরে পাশ–ফেল প্রথা তুলে দিয়েছিল৷ এনপিই ১৯৮৬–র পথ ধরে ১৯৯০ সালে ডি এফ আই ডি (ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্সট্রাকশনাল ডেভেলপমেন্ট)–এর কর্মসূচি হিসাবে ডিপিইপি এল, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পথ প্রদর্শক হিসাবে সিপিএম নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার খ্যাতি কুড়িয়েছিল৷ এন পি ই–র মূল দর্শন ছিল ‘এডুকেশন ইজ এ ইউনিক ইনভেস্টমেন্ট’৷ ডিপিইপি–র শিক্ষাদর্শনে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি পাওয়া গেল– (১) ফেলিং স্টুডেন্ট ইন দ্য ক্লাস উইল অ্যাড ফিনানসিয়াল লস’ অর্থাৎ ছাত্রদের ফেল করানো আর্থিক ক্ষতি৷ সুতরাং শিখুক না শিখুক ন্যূনতম জ্ঞানার্জন না হলেও উপরের ক্লাসে তুলে দাও৷

(২) ‘রিপ্রোডাকশন ডিসিশনস আর লেফট টু পেরেন্টস, জেনারেলি সো দ্য প্রাইমারি রেসপনসিবিলিটি ফর চাইল্ড লার্নিং অ্যান্ড এডুকেশন মাস্ট রিমেইন উইথ দেম’৷ জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাবা–মার, অতএব সন্তানের শিক্ষার দায়িত্বও তাদের – রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে অসুবিধা হয় কি?

(৩) ‘দ্য শিফট অফ রেসপনসিবিলিটি অফ প্রাইমারি এডুকেশন হুইচ আনটিল নাও ওয়াজ উইথ দ্য গভর্নমেন্ট টু পিপলস সোল্ডার’– শিক্ষার খরচ সরকারের ঘাড় থেকে জনগণের ঘাড়ে চাপাও৷

এরও দশ বছর পর ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ের রিপোর্টের দায়িত্ব দিয়েছিলেন দুই শীর্ষ শিল্পপতি কুমার মঙ্গলম বিড়লা এবং মুকেশ আম্বানির উপর (এ পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক ফর রিফর্ম ইন এডুকেশন)৷ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ঘটা করে পালন করার তিন বছরের মধ্যেই শিক্ষায় বেসরকারি পুঁজির অবাধ প্রবেশ ঘটানো হল৷ শিক্ষাকে  বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে লাভজনক ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করা হল৷ এল পিপিপি মডেল (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ), বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ তো বটেই এমনকী বিদ্যালয় স্তরেও৷ আরও পাঁচ বছর পর ২০০৫ সালে এল ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক (এনসিএফ), তৈরি করা হল একটা বাতাবরণ যা এলপিজি (লিবারালাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশন) নীতিতে আবদ্ধ করল শিক্ষাক্ষেত্রকে৷

স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যায়ে যে ভাবে দেশের শিক্ষার উপর একের পর এক আঘাত সরকারিভাবে এসেছে তা দেশের শিক্ষাপ্রেমী মানুষকে ক্রমান্বয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে৷ প্রকৃত শিক্ষার দাবিতে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ক্রমশ ফেটে পড়ছে শিক্ষাব্রতী মহলে৷ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এক রাজ্য থেকে এক রাজ্যে৷ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার বিস্তারের ইতিহাস যেমন গর্বের তেমনি শিক্ষার দাবিতে গণআন্দোলনেও পশ্চিমবঙ্গ প্রথম সারিতে৷ স্বাভাবিকভাবেই ’৮০–র দশকের গোড়া থেকে পশ্চিমবঙ্গের বরেণ্য শিক্ষাবিদ সহ সকল স্তরের মানুষ সরকারি শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সামিল হয়ে সৃষ্টি করেছিলেন ঐতিহাসিক ভাষা শিক্ষা আন্দোলন, যা শুরু হয়েছিল প্রাথমিকে ইংরেজি ভাষা–শিক্ষা ও পাশ–ফেল পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে৷ এই আন্দোলনে সামিল ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ, অধ্যাপক শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী সকলেই৷ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কর্তাকুল কী করে শিক্ষা আন্দোলনকে দমন করা যায় তার রূপরেখা তৈরিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন৷ কারণ দরিদ্র জনগণের সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার দায় তাঁদের ছিল না৷ এই সময়েই তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার আচরণবিধি প্রণয়ন করে গেজেট প্রকাশ করেন ১৪ জানুয়ারি ২০০৫ সালে৷ লক্ষ্য একটাই– শিক্ষকদের সরকারের অনুগামী করা ও অবাধ্য প্রতিবাদী শিক্ষকদের শায়েস্তা করা৷

শিক্ষকতা শুধু চাকরি বা পেশা নয়৷ একটা ব্রত, একটা আদর্শ– আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত না হলে মহৎ শিক্ষক হওয়া যায় না৷ যুগ–যুগান্তর ধরে বিভিন্ন সমাজে শিক্ষকরা নিজস্ব ভূমিকার মধ্য দিয়ে এই গৌরব অর্জন করেছেন৷ সমাজও শিক্ষকদের সেই মর্যাদার আসনে বসিয়েছে৷ অভিভাবকরাও যুগে যুগে তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের কাছ থেকে নীতি–নৈতিকতা–আদর্শ ইত্যাদি মানবিক মূল্যবোধগুলি আয়ত্ত করে যথার্থ মানুষ হয়ে উঠবে এই আশায় নিশ্চিন্তে ভরসা করেই তাঁদের সন্তানদের শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়েছেন৷ শিক্ষাপ্রেমী জনগণ এলাকায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছেন৷ শিক্ষিত তরুণ যুব সম্প্রদায় বছরের পর বছর কোথাও অর্থ না নিয়ে কোথাও নামমাত্র অর্থ নিয়ে সেই মহান ব্রত পালন করে গেছেন৷ গড়ে তুলেছেন আমাদের রাজ্যের প্রান্তে প্রত্যন্তে বিদ্যালয় সমূহ৷ আজকে পশ্চিমবঙ্গে যে ১২,৫০০ সরকার পোষিত বিদ্যালয় আছে তার মধ্যে শুধুমাত্র সরকারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা স্কুলের সংখ্যা একশোরও কম৷ শিক্ষা নিয়ে স্কুল গড়ে ব্যবসা করা যায়– এই ধারণা শিক্ষানুরাগী মানুষ কিছু দিন আগেও কল্পনা করতে পারতেন না৷ সিপিএম সরকারের আমলে ভ্রান্ত শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ও পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার ফলেই আমাদের রাজ্যে স্কুল ব্যবসায়ীদের আবির্ভাব ঘটেছে৷ সরকার অবাধে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের অনুমোদন দিয়েছেন ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় তৈরি করার৷ ব্যবসায়িক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই বিদ্যালয়গুলির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অভিভাবকদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, ছাত্রদের প্রকৃত শিক্ষা প্রদান করা নয়৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল ভাবনা ‘আর্ন ম্যাক্সিমাম প্রফিট’ শিক্ষা ব্যবসাতেও থাবা বসিয়েছে৷ ফলে ব্যবসায়িক বিদ্যালয়ের মালিকরা সেইসব শিক্ষকদের নিযুক্ত করে যাদের দিয়ে অর্থের লোভ দেখিয়ে নীতিহীন আদর্শহীন কাজও বাগিয়ে নেওয়া যায়৷ এই সব আদর্শহীন শিক্ষকদের দু–একজনের অসামাজিক কার্যকলাপকে সামনে রেখে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে লাগাতার কুৎসা–কটূক্তি, অসম্মানজনক উক্তি আমদানি হয়েছে বিগত সরকারের আমল থেকে৷ জনমানসে শিক্ষক সমাজকে হেয় করে শিক্ষকদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আচরণবিধি চালু করেছিল৷ এমন সব বিষয় ওই কোড অফ কন্ডাক্ট–এ ছিল যা অত্যন্ত অসম্মানজনক৷ উল্লেখ ছিল, স্কুলের ভিতরে মদ্যপান করা চলবে না৷ গোটা শিক্ষক সমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন৷ প্রশ্ন উঠেছিল বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে এর কোনও নজির আছে কি? এই উল্লেখ কি শিক্ষকদের পক্ষে সম্মানজনক? উল্লেখ ছিল, রিফ্রেন ফ্রম অ্যাকসেপটিং এনি গিফট৷ এ তো ঘুষের অভিযোগ স্কুলে স্কুলে এসব ঘটছে না কি? এতো সমস্ত শিক্ষক সমাজকে অসম্মান করা৷ ওই কোড অফ কন্ডাক্ট–এ একটা ধারাই ছিল প্রোহিবিশন রিলেটিং টু গ্যাম্বলিং অর কনসাম্পশন অফ ইনটক্সিক্যান্ট৷ ঘটনা কি তাই? স্কুলে স্কুলে জুয়া, মদ এসব চলছে? আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন শিক্ষকরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন৷

প্রতিবাদী শিক্ষকদের মুখ বন্ধ করতেই কি বর্তমান সরকার বিগত সরকারের প্রশস্তি গেয়ে নতুন মোড়কে কয়েকটি বিষয় জুড়ে দিয়ে নবরূপে আচরণবিধি আনলেন? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে৷ সম্প্রতি গেজেট বিজ্ঞপ্তির পর শিক্ষামন্ত্রী না দেখে না শুনে কিছু বলবেন না বলে জানালেন৷ পরে আধিকারিকদের কাছ থেকে শুনে প্রতিক্রিয়া দিলেন, সিপিএম–ফ্রন্ট সরকার যে আচরণবিধি এনেছিল বেশিরভাগটাই এক আছে৷ যিনি সিপিএম–ফ্রন্ট সরকারের ভ্রান্ত শিক্ষানীতি সহ প্রায় সকল প্রশ্নেই এককালে বিরোধী ছিলেন আজ শিক্ষকদের আচরণবিধি প্রণয়নের প্রশ্নে তিনি তাঁদের কাজের সাফাই গাইছেন কেন? আসলে বিগত দিনের বিরোধী দলনেতাও আজ শাসককুলের অন্যতম শিরোমণি৷ আমরা জানি শাসকের কাজই হল বিরুদ্ধ কণ্ঠকে স্তব্ধ করা৷ তারা চিরকাল চেষ্টা করেছে প্রতিবাদীদের থেকে প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নিতে৷ এই প্রশ্নে তৃণমূল সরকারের সাথে অতীতে সিপিএম সরকারের কোনও পার্থক্য নেই৷ তাই শিক্ষামন্ত্রী অবলীলায় বলেছিলেন, এ তো বামফ্রন্টই এনেছিল, তাঁরা শুধু আরও কয়েকটি বিষয় যোগ করেছেন মাত্র৷ এ বারের আচরণবিধিতে নতুন করে এল কোনও শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বা সরকারের অনুমতি বিনা কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না৷

শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের প্রতি বছরের সম্পত্তির খতিয়ান এবং আয়–ব্যয়ের হিসাব ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরকারের কাছে জমা দিতে হবে৷ সবচেয়ে মারাত্মক যে ধারাটি এসেছে, তা হল ‘নো টিচার অর নন–টিচিং স্টাফ শ্যাল মুভ এগেইনস্ট দ্য গভর্নমেন্ট অর দ্য কমিশন অফ স্কুল (সেকেন্ডারি) এডুকেশন অর দ্য বোর্ড অর দ্য ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর অফ স্কুলস সেকেন্ডারি এডুকেশন, অর দ্য অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর অফ স্কুলস (এস ই) অ্যাজ দ্য কেস মে বি, টু এনি কোর্ট অফ ল, উইদাউট সার্ভিস অফ রিটন রিপ্রেজেনটেশন আপন দ্যা কনসার্নড অথরিটি অ্যান্ড অ্যাফোর্ডিং সাচ অথরিটি৷ এ রিজনবল অপরচুনিটি টু ডিসপোজ অফ দ্য সেম৷ এ তো মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার সামিল কোনও শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী যদি অধিকার থেকে বঞ্চিত হন তা হলেও যাঁরা তাঁকে বঞ্চিত করেছেন তাঁদেরই কাছে আবেদন করতে হবে ও জানাতে হবে৷ মানসিক পীড়ন সহ্য করেও সময় দিতে হবে অথচ আইনের দ্বারস্থ হতে পারবেন না৷ এ কী হয় এ ছাড়াও নতুন আচরণবিধিতে  অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে ছাড় দেওয়া হয়নি৷ অবসরের দিন থেকে তিন বছর পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে৷ কোথায় নামাচ্ছেন তাঁরা প্রবীণ শিক্ষকদের৷ নাকি এইসব নিয়ম করে ভয় দেখিয়ে শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে তাঁরা নিজেদের তাঁবে আনতে চাইছেন?

এমনভাবে বিষয়গুলি আসছে যেন মনে হচ্ছে গোটা দেশ জুড়ে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা কোনও নিয়ম নীতি মানছেন না৷ শিক্ষকদের মধ্যে ছাত্র–ছাত্রীদের প্রতি কোনও রকম স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা নেই, সর্বত্রই তাঁরা যেন সমাজবিরোধী গুন্ডা বদমায়েশের প্রতিমূর্তি৷ আসলে এই মরণ্মোমুখ অবক্ষয়িত পুঁজিবাদ সুপরিকল্পিত ভাবে তার সংকট জর্জরিত অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে এই নোংরা পথ বেছে নিচ্ছে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যে সুন্দরতম সম্পর্ক ছাত্র–শিক্ষক সম্পর্ককে নষ্ট করতে চাইছে, কালিমালিপ্ত করছে গোটা শিক্ষক সমাজকে৷ এ এক ভয়ানক অবস্থা৷ নবজাগরণের মহান মনীষী রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ সহ যাঁরা এ দেশে কূপমণ্ডুক চিন্তা–ভাবনা, অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস, কুসংস্কার দূর করে গণতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার ভিত্তিমূল প্রতিষ্ঠা করার জন্য শিক্ষকদের উপর সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব ও প্রচেষ্টায় ব্রতী করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই মহৎ প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে আনা হচ্ছে একের পর এক আচরণবিধি৷ কালিমালিপ্ত করে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আটকে দেওয়া হচ্ছে প্রেরণাদায়ক জীবনসংগ্রামে নিবিষ্ট আদর্শ শিক্ষককুলকে৷ অথচ আজও পেশাগত নৈতিকতার মানদণ্ডে অসাধারণ অনুকরণযোগ্য উদাহরণের অভাব নেই৷ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সেই উদাহরণগুলিকে সামনে আনা হচ্ছে না৷

শাসক শ্রেণি পুঁজিবাদের স্বার্থে এ কাজ করবে না, এ দায়িত্ব ঐতিহাসিকভাবেই  বর্তাবে সেইসব  শিক্ষকদের উপর যাঁরা পেশাগত নৈতিকতায় প্রশ্নহীন, আচরণ ও অনুপ্রেরণায় ছাত্রদের কাছে শ্রদ্ধার যোগ্য, সত্য প্রতিষ্ঠায় জীবন দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷ তাঁরা কখনওই সরকারের এই ধরনের কর্মকাণ্ড সমর্থন করবেন না, বরং গড়ে তুলবেন তীব্র আন্দোলন৷