আমৃত্যু বিপ্লবী কমরেড রণজিৎ ধরের জীবনাবসান : কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রদ্ধার্ঘ্য

দীর্ঘ রোগযন্ত্রণার অবসান হল৷ ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালের চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, কমরেড রণজিৎ ধরের মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ খবর এল ১৩ জুন– বিকাল ৪টায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন৷ ৯০ বছর বয়সে তাঁর সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটল৷ কিন্তু এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটবুরো সদস্য কমরেড রণজিৎ ধরের স্মৃতি থেকে যাবে সারা ভারতে দলের অসংখ্য নেতা–কর্মীর হৃদয়ে৷

কমরেড রণজিৎ ধর দীর্ঘদিন ধরেই হাইপারটেনশন, মূত্রনালীর সমস্যার সাথে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন৷ এজন্য শেষ দিকে তাঁর ডায়ালিসিস শুরু হয়েছিল৷ মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়৷

কমরেড রণজিৎ ধর পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) ময়মনসিংহ জেলায় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর দেশভাগের আগেই কলকাতায় চলে আসেন৷ কলকাতায় সহায়–সম্বলহীন অবস্থায় অসীম কষ্টের মধ্যে প্রথম দিকে তাঁর জীবন কেটেছিল৷ দক্ষিণ কলকাতার উজ্জ্বলা সিনেমা হলের কেবিনে কাজ করেছেন, ফুটপাতে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন৷ প্রাইভেট টিউশন করে সামান্য অর্থোপার্জন করেছেন৷

ওই সময়ই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক কমরেড সুধীর ব্যানার্জীর ভাই সুকুমার ব্যানার্জীর সাথে আলাপের সূত্রে দক্ষিণ কলকাতায় ‘কালচার ক্লাবে’র সাথে যোগাযোগ হয়৷ ওখানেই কমরেড রণজিৎ ধর মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের সান্নিধ্যে আসেন, যাঁর চিন্তা ও চরিত্রের প্রভাবেই কমরেড ধর জীবনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য খুঁজে পান৷ জীবনের এই পর্বকে স্মরণ করে তিনি নিজেই বলেছেন, কমরেড শিবদাস ঘোষের সান্নিধ্য এবং এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের সাথে যুক্ত হতে না পারলে তাঁর জীবন দিশাহীন স্রোতে ভেসে যেত৷

কমরেড রণজিৎ ধর সাধারণ মানুষ, বিশেষত গরিব মেহনতি ও বঞ্চিত অসহায় মানুষের সাথে মিশতেন অনায়াসে, সহজেই তাঁদের আপনজন হতে পারতেন৷ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের সাধারণ মানুষ, বিশেষত গরিব অবহেলিতদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ ছিল তাঁর৷ এই সূত্রেই তিনি ১৯৬৯ সালে কালীঘাট অঞ্চলের তৎকালীন ৮৭ নং ওয়ার্ড থেকে কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন৷ কর্পোরেশনের কলকাতা টাউন প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তিনি দক্ষতার সাথে পালন করেন৷

ওই সময় গঙ্গার জলস্ফীতিতে এলাকায় দুর্যোগ দেখা দিলে তিনি নিজ হাতে ও পার্টিকর্মীদের সাহায্যে দুর্গত মানুষদের উদ্ধার ও ত্রাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন৷ কালীঘাটে অবস্থিত শরৎ পাঠাগার সংস্থাটির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা৷ ১৯৫০ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে যত বামপন্থী গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছিল, তার প্রতিটিতেই প্রথমে কর্মী হিসাবে ও পরে নেতা রূপে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন৷

কমরেড রণজিৎ ধরের লেখনী ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁর নিজের বহু ভাষণ সম্পাদনার দায়িত্ব কমরেড রণজিৎ ধরকে দিতেন৷ কেন্দ্রীয় কমিটির ইংরেজি মুখপত্র প্রোলেটারিয়ান এরার সম্পাদকমণ্ডলীর তিনি সদস্য ছিলেন৷ গণদাবী পত্রিকায় তিনি বহু নিবন্ধ লিখেছেন৷ পত্রিকা সাপ্তাহিক হওয়ার পর তিনি প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যপদে তিনি দীর্ঘকাল ছিলেন৷ ওই সময় পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় তিনি ঘুরেছেন, সংগঠনের বিকাশে সাহায্য করেছেন৷ ২০০৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটবুরোর সদস্য নির্বাচিত হন৷ তিনি কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান পদেও নির্বাচিত হন৷ দলের আন্তর্জাতিক বিভাগের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি৷ আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফোরামের কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসাবে তিনি ফিলিপাইন্স, লেবাননে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন৷ ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারেও তিনি দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন৷

কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তিনি উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে দলের সংগঠন দেখভাল করেছেন অশক্ত শরীর নিয়েও৷ তিনি প্রথমে অখিল মিস্ত্রি লেন পার্টি–সেন্টার, হাতিবাগান পার্টি–সেন্টার ও সর্বশেষে সল্টলেক পার্টি–সেন্টারেই জীবন অতিবাহিত করেছেন৷ দলের সর্বস্তরের নেতা–কর্মীদের সাথে তাঁর মেলামেশার ধরন ছিল বন্ধুর মতো৷ ছোটদের প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল অপরিসীম৷ বস্তুত মার্কসবাদ–লেনিনবাদ কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সর্বহারা বিপ্লব ও শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থরক্ষার কাজে নিজের সমগ্র জীবন সমর্পণ করেছিলেন এবং আমৃত্যু বিপ্লবী জীবনেই অটল ছিলেন৷ তাঁর মৃত্যুসংবাদ আসতেই কেন্দ্রীয় কমিটি তিন দিনের শোকপালনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ সেই অনুসারে কলকাতায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় সহ দেশের সকল কার্যালয়ে রক্তপতাকা তিন দিনের জন্য অর্ধনমিত করা হয় এবং নেতা–কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করেন৷

এই আমৃত্যু বিপ্লবীর জীবনাবসানে সর্বহারা বিপ্লবী আন্দোলন হারাল একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে৷ তাঁর মৃত্যুতে এ দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের ও একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি এস ইউ সি আই (সি)–র ক্ষতি তো হলই, তার সাথে বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও অপূরণীয় ক্ষতি হল৷

আমৃত্যু বিপ্লবী কমরেড রণজিৎ ধর লাল সেলাম

কমরেড মানিক মুখার্জী
কমরেড অসিত ভট্টাচার্য

 

 

 

কমরেড শঙ্কর সাহা

 

 

 

 

কমরেড গোপাল কুণ্ডু
কমরেড সৌমেন বসু

 

 

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা)