কাজ দেন না, ভাত দেন না মোদিজি, আপনি পরিবারের কেমন কর্তা

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে ৬ মার্চ দলের নেতৃত্বে রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ এবং প্রশাসনিক দপ্তরে ডেপুটেশন হয়। ছবিঃ বহরমপুর ডিএম অফিস

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বত্তৃতা শুনে দেশের ১৪০ কোটি মানুষের তো চক্ষুস্থির। সে কী! কবে থেকে তাঁরা আবার মোদির পরিবারের সদস্য হয়ে গেলেন?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি তেলঙ্গানার এক সভায় বত্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘১৪০ কোটি দেশবাসীই আমার পরিবার।’ বত্তৃতা শুনে মানুষ গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেছেন, প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ তাঁদের তাঁর পরিবারের সদস্য বলতে গেলেন কেন? আর কোন সুবাদেই বা তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য হলেন? দেশবাসীর আরও ভাবনা– দশ বছর সরকারে থাকার পর ঠিক ভোটের মুখে এসেই হঠাৎ তাঁর এমন ঢালাও পরিবারের সদস্যপদ বিলানো কেন? প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃতা শুনে সবারই মনে পড়ছে, এক সময় বিজেপি ঘোষণা করেছিল, যে কেউ নেতাদের ফোনে একটা ‘মিসড কল’ দিলেই বিজেপির সদস্য হতে পারবে। এ বার অবশ্য তেমন কিছু ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী সব দেশবাসীকে নিজের পরিবারের সদস্য করে নিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী এই পরিবারকে বলেছেন, ‘মোদি কা পরিবার’। মানে মোদির পরিবার। অর্থাৎ পরিবারের কর্তা তিনিই। তা কর্তামশাই যখন, তখন দেশবাসীর প্রতি নিশ্চয় তাঁর ভাল রকমই দায়িত্ববোধ আছে! দেখা যাক, গত দশ বছরে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর প্রতি কেমন দায়িত্ব পালন করেছেন।

ক্ষমতায় বসার দু’বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী ‘নোট বাতিল’ ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, এতে সাধারণ মানুষের যত অসুবিধাই হোক, দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ, জাল নোট এবং কালো টাকা চিরকালের জন্য দূর হয়ে যাবে। আজ সবাই জানেন, এর কোনওটাই হয়নি। নোট বদলানোর লাইনে দাঁড়িয়ে একেবারেই যাঁরা সাধারণ মানুষ, যাঁদের জাল নোট বা কালো টাকার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই তেমন শতাধিক মানুষেরই কেবল প্রাণ গিয়েছে। আর ছোট ছোট কারখানা এবং সংস্থাগুলি বাধ্য হয়েছে কারবারের ঝাঁপ বন্ধ করতে। বেকার হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। জাল নোট কিংবা কালো টাকার কারবারি কিন্তু একজনও ধরা পড়েনি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এই নাটকীয় ঘোষণায় দেশের একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা খুশি হয়েছিল। কারণ তাদের বাজার এর ফলে বেড়ে গিয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন। ২০২৪ সাল হয়ে গেল। কৃষকরা জানেন, দ্বিগুণ নয়, সার-বীজ-কীটনাশক-বিদ্যুতের দামে সরকার খরচ যা বাড়িয়েছে তাতে অর্ধেক হতে বসেছে তাঁদের রোজগার। প্রধানমন্ত্রী কখন এমন ঘোষণাটি করেছিলেন? যখন দেশের একচেটিয়া পুঁজির, বিশেষত আদানি-আম্বানিদের কৃষিপণ্যের ব্যবসায় বিপুল মুনাফার সুযোগ করে দিতে বিজেপি সরকারের আনা তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দেশের কৃষকরা মরণপণ লড়াই করছেন। মোদি সরকারের নীতিতে আজ দেশে প্রতি দিন গড়ে ৩০ জন কৃষক আত্মহত্যা করছেন। এর পরেও কৃষকদের নিজের পরিবারের সদস্য বলা তাঁদের প্রতি বিদ্রুপ ছাড়া আর কিছু হতে পারে কি?

৪৪টি শ্রম আইনকে ছেঁটে ৪টিতে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাতে শ্রমিকদের বহু সংগ্রামে অর্জিত অধিকারগুলি প্রায় সবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। স্থায়ী চাকরি প্রায় তুলেই দেওয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রের কোথাওই ন্যূনতম মজুরি বলে কিছু নেই। আট ঘণ্টার পরিবর্তে মালিকরা এখন শ্রমিক-কর্মচারীদের ইচ্ছামতো খাটাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই শ্রমজীবী মানুষকে পরিবারের সদস্য ভাবতেন, তা হলে তাঁদের এই হাল কি হতে দিতেন?

প্রধানমন্ত্রী এখন সব বত্তৃতায় নারীশক্তির কথা বলছেন। দেশের সেই নারীদের জন্য তাঁর সরকার কী করেছে? তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাটে যেখানে বছরের পর ধরে সরকারে বিজেপি, সেখানে গত পাঁচ বছরে নারীর ওপর অত্যাচারের ঘটনা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। শিশুদের ওপর অত্যাচার বেড়ে হয়েছে পাঁচগুণ (নিউ ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস, ১৬.১.২৪)। দেশের ৫০ শতাংশ নারী অপুষ্টির শিকার। পণের জন্য নির্যাতন এবং বধূহত্যা ভারতে একটি গুরুতর সমস্যা। এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা ২০২২-এর তুলনায় ২০২৩-এ প্রায় ৪ শতাংশ বেড়েছে। বাল্যবিবাহ এবং নারী পাচার আজও গুরুতর সমস্যা হিসাবে থেকে গেছে। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত কমছে। তাঁর দলের সাংসদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছেন অলিম্পিক পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিররা। তা হলে ভারতের নারীরা কোন ভরসায় নিজেদের প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য বলে মনে করবেন!

দেশে বেকারত্ব গত ৪৫ বছরে শীর্ষে পৌঁছেছে। লক্ষ লক্ষ পদ শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারে। লাখে লাখে যুবকরা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে শ্রমিকের কাজের জন্য। এমনকি ভাড়াটে সেনায় নাম লিখিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে প্রাণ পর্যন্ত দিচ্ছেন। দেশে এখন কর্মহীন বেকার যুবকরা প্রতি ঘণ্টায় দু’জন করে আত্মহত্যা করছেন। এই সব কিছু দেখেও যে প্রধানমন্ত্রী নীরব, তিনি কেমন পরিবারের কর্তা? বাস্তবে দেশের কোনও শ্রমজীবী সাধারণ মানুষই মোদির পরিবারের সদস্য হতে পারেন না।

পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বত্তৃতা দেওয়া প্রধানমন্ত্রী সরকারের পরিচয়, দলের পরিচয়কে পিছনে ঠেলে নিজের পরিচয়কেই সামনে এনেছেন। দলের নেতারা বাধ্য ছাত্রের মতো সেই তালেই তাল দিচ্ছেন মাত্র। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণে নতুন কিছু নেই। সব স্বৈরশাসকই এমন আচরণ করেন। এর আগে দেশের মানুষ দেখেছেন ‘ইন্দিরা গান্ধী ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা গান্ধী’ স্লোগান। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আচরণ দেখলেও তার খানিকটা মালুম হয়।

তা এই ‘মোদি কা পরিবারের’ সদস্য সত্যিই কারা দেখে নেওয়া যাক। প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃতার পর বিজেপি মন্ত্রী-নেতা-সাংসদরা সমাজমাধ্যমে তাঁদের নামের পাশে ‘মোদির পরিবার’ লিখতে শুরু করে দিয়েছেন। তার মধ্যে আছেন কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিংহ থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনি-ও, যাঁর ছেলে লখিমপুর খেরিতে কৃষকদের গাড়ির চাকায় পিষে মেরেছিল।

আচ্ছা, মণিপুর তো দেশেরই একটি অঙ্গরাজ্য, কিন্তু সেখানকার বাসিন্দাদের কি প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরিবারের সদস্য বলে মনে করেন না? মাসের পর মাস সেখানে যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ চলছে, বিপন্ন হচ্ছে জনজীবন, তা নিয়ে তাঁর কোনও হেলদোল নেই কেন? এত দিনে এক বারের জন্যও তিনি সেখানে যেতে পর্যন্ত পারলেন না, সংঘর্ষ থামাতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা!

তাঁর স্বঘোষিত পরিবারের সদস্য দেশের সাধারণ মানুষ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাইয়ের আগুনে প্রতি মুহূর্তে পুড়ছে। মোদির সরকার এবং প্রশাসন পরিবারের সদস্যদের এমন দুর্বিষহ অবস্থা দেখেও ঠুঁটো হয়ে রয়েছে। আসলে তারা ব্যস্ত দেশের একচেটিয়া পুঁজির সেবা করতে। সেই সেবারই ফল হিসাবে ভারতে অতি ধনী মানুষের (মোট সম্পদ প্রায় ২৫০ কোটি টাকার) সংখ্যা ২০২২-এর তুলনায় ২০২৩-এ ৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩,২৬৩ জন। সমীক্ষার দাবি, পাঁচ বছরে (২০২৩-২০২৮) ভারতে সংখ্যাটা ৫০ শতাংশ বেড়ে হতে পারে ১৯,৯০৮ জন। অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে– মাত্র ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে রয়েছে ভারতের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ, আর নীচের ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ। এরপরও বুঝতে অসুবিধা হয় কি মোদির পরিবারের আসল সদস্য কারা?

তা হলে প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের ফাঁকা কথাগুলি বলে চলেছেন কেন? আসলে লোকসভা নির্বাচন মুখে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝেছেন, দেশের ৯৯ ভাগ মানুষের জন্য তিনি এমন কিছু করেননি যাতে তাঁরা খুশি হয়ে তাঁকে বা তাঁর দলকে সমর্থন করতে পারেন। তাঁদের ধোঁকা দিতে তাই তাঁকে নিত্যনতুন বাগাড়ম্বরের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। এর আগে কখনও তিনি ‘আচ্ছে দিনে’-র স্লোগান তুলেছেন, কখনও ‘বিকাশ পুরুষ’ সেজেছেন। এ বার প্রতারণার নতুন স্লোগান ‘মোদি কা পরিবার’। প্রধানমন্ত্রীকে দেশের মানুষের প্রশ্ন, ভাত দেন না, কাজ দেন না, মহিলাদের নিরাপত্তা দেন না, মোদিজি, তা হলে পরিবারের কেমন কর্তা আপনি?