রাষ্ট্র ও বিপ্লব (৩)– লেনিন

এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে গণদাবীতে তাঁর ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। এবার তৃতীয় কিস্তি।

 

‘সশস্ত্র বিপ্লব’ ও রাষ্ট্রের ‘বিলুপ্তি’

রাষ্ট্রের ‘বিলুপ্তি’ সম্পর্কে এঙ্গেলসের বক্তব্য সবাই জানে। প্রায়শই তা বিভিন্ন জায়গায় উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহারও করা হয়। মার্ক্সবাদের মূল কথাটিকে সুবিধাবাদ হিসেবে চালাবার প্রচলিত কারচুপিটি তার দ্বারা এতটাই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে, যে তা নিয়ে একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। কথাটি যেখান থেকে নেওয়া হয়েছে তার পুরো বক্তব্যটা আমরা তুলে দিচ্ছিঃ

‘সর্বহারাশ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে প্রথমেই উৎপাদনের উপায়গুলিকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করে। কিন্তু তার মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণি, শ্রেণি হিসেবে তার নিজেরও বিলুপ্তি ঘটায়, সেই সাথে সমস্ত শ্রেণি বৈষম্য ও শ্রেণি বিরোধেরও অবসান ঘটায়, রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রকেও বিলুপ্ত করে। এতদিন পর্যন্ত সমাজ শ্রেণি বিরোধের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হয়েছে। এই সমাজে রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়েছে নির্দিষ্ট শোষক শ্রেণিটির আবশ্যিক সংগঠন হিসেবে, উৎপাদনের বাহ্যিক শর্তগুলিকে বজায় রাখতে এবং বিশেষত সেই নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা নিরূপিত শোষিত শ্রেণিকে গায়ের জোরে দমন করে ওই শোষণ প্রক্রিয়াটি (দাসব্যবস্থা, ভূমিদাসপ্রথা বা মজুরিভিত্তিক শ্রমব্যবস্থা) বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র হল সরকারিভাবে গোটা সমাজেরই প্রতিনিধি, একটি দৃশ্যগোচর সংস্থায় যার পুঞ্জীভূত প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু যে শ্রেণি তার যুগে নিজেই গোটা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে, রাষ্ট্র ছিল যে-পরিমাণে সেই শ্রেণিরই রাষ্ট্র, সেই-পরিমাণেই অবশ্য রাষ্ট্রকে গোটা সমাজের সরকারি প্রতিনিধি বলা চলত– প্রাচীনকালে তা ছিল দাস মালিকদের রাষ্ট্র, মধ্যযুগে সামন্তী প্রভুদের এবং আমাদের সময়ে পুঁজিপতি শ্রেণির বা বুর্জোয়াদের। কিন্তু যখন শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র সত্যি সত্যিই গোটা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে, রাষ্ট্র হিসেবে তখন তার প্রয়োজনই ফুরিয়ে যাবে। যখন দমিয়ে রাখা হয়েছে এমন কোনও শ্রেণি আর থাকবে না, যখন শ্রেণি শাসনের অবসান ঘটে যাবে এবং আজকের উৎপাদন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য থেকে জন্ম নেওয়া ব্যক্তির অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রাম ও সেই সংগ্রামের ফলে সৃষ্ট সংঘর্ষ ও অমিতাচারের যখন নিরসন ঘটবে, সমাজে দমন করার মতো কোনও কিছুই তখন আর থাকবে না। ফলে দমন করার শক্তি হিসেবে রাষ্ট্রেরও প্রয়োজনীয়তা তখন ফুরিয়ে যাবে। গোটা সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হল সমাজের নামে উৎপাদনের উপকরণগুলির দখল নেওয়া, আবার এটাই রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রের শেষ স্বাধীন কাজ। সামাজিক সম্পর্কের বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তখন একটার পর একটা ক্ষেত্রে অনাবশ্যক হয়ে পড়বে এবং নিজে থেকেই তখন তা অবলুপ্ত হয়ে যাবে। ব্যক্তির উপর শাসন বলবৎ রাখার বদলে তখন প্রশাসনের মূল কাজ দাঁড়াবে প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিচালনা। মানে রাষ্ট্রকে উৎখাত করা হয় না, ক্ষয় পেতে পেতে তার বিলুপ্তি ঘটে। ‘স্বাধীন গণরাষ্ট্র’ এই কথাটির অর্থ এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের বুঝতে হবে। সাময়িক ভিত্তিতে প্রচারমূলক দিক থেকে এর কিছু মূল্য থাকলেও, শেষ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে এই ধারণা অচল, সেটাও বুঝতে হবে এই দৃষ্টিকোণ থেকে। তথাকথিত নৈরাজ্যবাদীরা যে রাষ্ট্রকে রাতারাতি উচ্ছেদ করার ডাক দিয়ে থাকেন– এই দাবিরও বিচার করতে হবে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই। (হের অয়গেন ড্যুরিং-এর বিজ্ঞানে বিপ্লব (অ্যান্টি-ড্যুরিং), পৃঃ ৩০১-৩০৩, ৩য় জার্মান সংস্করণ)

এঙ্গেলসের এই অসাধারণ সমৃদ্ধ চিন্তা সংবলিত বক্তব্য সম্পর্কে এটুকু বলা নিরাপদ যে, এর মধ্যে থেকে যে বিষয়টি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দলগুলির সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে পড়েছে– তা হল মার্ক্সের মতে রাষ্ট্রের ‘বিলুপ্তি’ ঘটবে, তা, নৈরাজ্যবাদীরা যে বলে থাকে রাষ্ট্রকেই ‘উৎখাত’ করতে হবে, তার থেকে পৃথক ধারণা। মার্ক্সবাদকে কেটেছেঁটে নিয়ে এইরকমের কোনও ব্যাখ্যার অবতারণা করা মানে তাকে সুবিধাবাদে পর্যবসিত করা। কেন না এই ব্যাখ্যার ফলে যা পড়ে থাকে তা হল উলম্ফন, ঝঞ্ঝা এবং বিপ্লব ছাড়াই সমাজের কেবল ধীরগতিতে সমহারে পরিবর্তনের একটা ঝাপসা ধারণা। রাষ্ট্রের ‘বিলুপ্তি’র যে বর্তমান বহুপ্রচলিত ধারণাটি আজ জনপ্রিয়, বাস্তবে বিপ্লবের কথা পুরোপুরি নাকচ না করলেও এক অর্থে তাকে ধামাচাপা দেয়।

এ রকম ব্যাখ্যা আসলে মার্ক্সবাদের অতি স্থূল বিকৃতি। যার ফলে একমাত্র বুর্জোয়াদেরই সুবিধা হয়। তত্ত্বের দিক থেকে বলতে হয়, এঙ্গেলসের রচনা থেকে যে অনুচ্ছেদ আমরা পুরোপুরি উদ্ধৃত করেছি তার মধ্যে এঙ্গেলসের বক্তব্য ‘সংক্ষেপে’ বিবৃত হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি ও বিষয়গুলি বিবেচনার কথা সংক্ষেপে তুলে ধরেছে, তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেই একমাত্র এইরকম কোনও ব্যাখ্যায় উপনীত হওয়া সম্ভব।

তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই এঙ্গেলস বলেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণি ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটায়’। এর অর্থ কী, তা নিয়ে ভাবা হয় না। হয় বক্তব্যের এই অংশটিকে উপেক্ষা করে যাওয়া হয়, নতুবা ভাবা হয় এটা বোধহয় এঙ্গেলসের দিক থেকে কোনও ‘হেগেলীয় দুর্বলতার’ নিদর্শন। আসলে কিন্তু এই কথাগুলির মধ্য দিয়ে সংক্ষেপে বেরিয়ে এসেছে মহত্তম এক সর্বহারা বিপ্লবের অভিজ্ঞতার কথা, ১৮৭১ সালের প্যারি কমিউনের অভিজ্ঞতার কথা। পরে উপযুক্ত স্থানে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা যাবে। বাস্তবে এখানে এঙ্গেলস বলেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উচ্ছেদ ঘটায়। অন্য দিকে, যে রাষ্ট্রের ‘বিলুপ্তি’র কথা বলা হয়েছে তা হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে সর্বহারা শ্রেণি রাষ্ট্রের অবশেষটুকু। এঙ্গেলসের মতে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ‘বিলুপ্তি’ ঘটে না, তাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উচ্ছেদ করতে হয়। বিপ্লবের পরে ক্ষয় পেতে পেতে যা বিলুপ্ত হয়ে পড়ে, তা হচ্ছে সর্বহারা রাষ্ট্র বা আধা-রাষ্ট্র।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র হল এক বিশেষ ‘দমনমূলক’ শক্তি। এঙ্গেলস এখানে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রের এক অত্যন্ত গভীর ও চমৎকার সংজ্ঞা উপস্থাপিত করেছেন। এর মানে দাঁড়ায় এই যে, বুর্জোয়াদের হাতে সর্বহারা শ্রেণিকে দমনের যে ‘দমনমূলক’ ব্যবস্থা, মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে কোটি কোটি মেহনতি মানুষকে শোষণের এই ‘দমনমূলক’ ব্যবস্থা, তাকে হটিয়ে আনতে হবে এমন এক ‘বিশেষ দমনমূলক’ ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণি বুর্জোয়া শ্রেণিকে দমন করতে পারবে (সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব)। ‘রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি’র প্রকৃত অর্থ এই। সমাজের পক্ষ থেকে উৎপাদনের উপায়গুলির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা বলতে ঠিক এটাকেই বোঝায়। এবং এটা স্বতঃসিদ্ধ যে একটি ‘বিশেষ শক্তি’কে (বুর্জোয়া) এভাবে হঠিয়ে আরেকটি ‘বিশেষ শক্তি’-কে (সর্বহারা) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তা নিছক ‘ক্রমবিলোপে’র পথে সম্ভব নয়।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের ‘ক্রমবিলুপ্তি’ বা আরও সাজিয়ে গুছিয়ে রঙ চড়িয়ে বললে রাষ্ট্রের ‘নিজেকে নিজে বিলুপ্ত করা’ বলতে এঙ্গেলস অত্যন্ত স্পষ্ট করে সেই সময়কার কথাই বলেছেন, যখন রাষ্ট্র সমগ্র সমাজের হয়ে উৎপাদনের উপায়গুলির দখল নেবে, তার মানে তা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরের সময়ের কথা। আমরা সবাই জানি, সে সময় ‘রাষ্ট্রের’ রাজনৈতিক রূপটা হল পূর্ণতম গণতন্ত্র। কিন্তু যাঁরা নির্লজ্জভাবে মার্ক্সবাদের বিকৃতি ঘটিয়ে চলেছেন, সেইসব সুবিধাবাদীদের মাথায় এটা ঢোকেনি যে এঙ্গেলস এখানে একই সাথে বলেছেন এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের ‘বিলুপ্তি’র কথাও। প্রথম শুনলে আশ্চর্য হওয়ারই কথা। কিন্তু যাঁরা ভেবে দেখেন না যে, গণতন্ত্রও আসলে রাষ্ট্রেরই একটি রূপ, যে কারণে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটলে গণতন্ত্রেরও বিলুপ্তি ঘটাই স্বাভাবিক, এই কথাটা একমাত্র তাঁদের কাছেই অবোধ্য ঠেকবে। একমাত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়েই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উচ্ছেদ সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্র একটি ব্যবস্থা হিসেবে, একমাত্র পরিপূর্ণ বিকশিত অবস্থাতেই ‘ক্রমবিলুপ্তি’র পথে যেতে পারে।

চতুর্থত, ‘রাষ্ট্রের বিলুপ্তি’ সংক্রান্ত এই চমৎকার প্রতিপাদ্যটি রচনার সময়ই এঙ্গেলস পরিষ্কার করে দেন এর মূল লক্ষ্য সুবিধাবাদী ও নৈরাজ্যবাদীরা উভয়েই। এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এঙ্গেলস দেখান– প্রতিপাদ্যটি থেকে উপনীত রাষ্ট্র বিলুপ্তির সিদ্ধান্তটি সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধেই বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

কিন্তু বাজি রেখে বলা যায়, যদি ১০ হাজার জন ‘রাষ্ট্রের বিলুপ্তি’ সংক্রান্ত এই তত্ত্বটি পড়ে থাকেন বা শুনে থাকেন, দেখা যাবে তাঁদের মধ্যে ন’হাজার নশো নব্বই জনই হয় বোঝেনইনি অথবা মনে করতে পারছেন না যে, প্রতিপাদ্যটি থেকে টানা এঙ্গেলসের সিদ্ধান্তটি শুধুমাত্র নৈরাজ্যবাদীদেরই বিরুদ্ধে প্রযোজ্য নয়। আর যে ১০ জন বাকি রইলেন, দেখা যাবে তাঁদের মধ্যেও ৯ জনই হয়তো জানেন না ‘মুক্ত গণরাষ্ট্র’ কথাটির মানে কী এবং কেন এই শব্দবন্ধটিকে আক্রমণ করলে তার মাধ্যমে সুবিধাবাদীদের আক্রমণ করা হয়। এইভাবেই ইতিহাস লেখা হয়! এইভাবেই মহান বিপ্লবী শিক্ষাকেও অজান্তেই মিথ্যা ও কায়েমি স্বার্থের অনুকূলে গতানুগতিকতার মধ্যে টেনে নামানো হয়। প্রতিপাদ্যটি থেকে নৈরাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যাওয়া সিদ্ধান্তটি হাজারবার আওড়ানো হয়ে থাকে, এভাবে বারবার পুনরুক্তির মাধ্যমে সেটাকে প্রায় ছেঁদো কথায় পর্যবসিত করা হয়, কথাটির অতি সরলীকরণ ঘটানো হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে একধরনের পক্ষপাতদুষ্ট কুসংস্কারের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়, অন্যদিকে সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে যাওয়া সিদ্ধান্তটিকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়, তাকে নিক্ষেপ করা হয় এক অন্ধকার কোণে!

‘মুক্ত গণরাষ্ট্র’ ছিল ‘৭০-এর দশকের (১৮৭০-এর দশক) জার্মান সোসাল ডেমোক্র্যাটদের একটি কর্মসূচিগত দাবি ও চলতি স্লোগান। কিন্তু এই স্লোগানের মধ্যে রাজনৈতিক সারবত্তা কিছু ছিল না, যা ছিল তাকে বলা যেতে পারে গণতন্ত্রের নামে একধরনের বাগাড়ম্বর। যতদূর পর্যন্ত তা একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কথা তুলে ধরত, এঙ্গেলস প্রতিবাদী আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাময়িকভাবে এতদূর পর্যন্ত স্লোগানটি মেনে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু বস্তুত স্লোগানটি ছিল সুবিধাবাদীসুলভ, কারণ তার মাধ্যমে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উপর রঙের প্রলেপই শুধু দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু সাধারণভাবে রাষ্ট্র সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিক সমালোচনার অভাব তার মধ্যে বড়ই প্রকট। আমরা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পক্ষে, কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে রাষ্ট্র হিসাবে এটাই শোষিত শ্রেণির পক্ষে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়ার কোনও অধিকার নেই যে, সর্বাপেক্ষা গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রেও শেষ পর্যন্ত সেই মজুরি-দাসত্বই সাধারণ মানুষের ভবিতব্য। তাছাড়া রাষ্ট্র মাত্রেই হল নিপীড়িত শ্রেণিকে দমন করে রাখার একটি ‘বিশেষ’ যন্ত্র। ফলে রাষ্ট্র কখনও স্বাধীন বা ‘মুক্ত’ হতে পারে না, ‘জনরাষ্ট্রও’ হতে পারে না। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এ কথা ‘৭০-এর দশকে তাঁদের পার্টি কমরেডদের কাছে বারেবারে ব্যাখ্যা করে বলেছেন।

পঞ্চমত, এঙ্গেলসের যে রচনাটিতে সকলের মনে রাখার মতো এই ‘রাষ্ট্রের বিলুপ্তি’র কথাটি আছে, সেই একই রচনায় সশস্ত্র বিপ্লবের তাৎপর্যের কথাও আছে। এখানে এঙ্গেলস সশস্ত্র বিপ্লবের ঐতিহাসিক ভূমিকা বিশ্লেষণ তুলে ধরতে গিয়ে যা বলেছেন, তা আসলে তার প্রশংসাই। কিন্তু এই অংশটি কেউ মনে রাখে না। আধুনিক সমাজতান্ত্রিক পার্টিগুলোতে এর তাৎপর্য নিয়ে কথা বলা বা এমনকি ভাবারও খুব একটা চল নেই, জনগণের মধ্যে তাদের দৈনন্দিন প্রচার ও আন্দোলনে এই ভাবনাটির কোনও ভূমিকাই দেখা যায় না। অথচ ‘রাষ্ট্রের বিলুপ্তির’ সাথে এই ধারণাটিও অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত এবং দুয়ে মিলেই একটি সমগ্র ধারণায় পৌঁছানো সম্ভব।

এঙ্গেলস বলেছেনঃ ‘‘… ইতিহাসে বলপ্রয়োগের (ধ্বংসাত্মক ভূমিকা ছাড়াও) অন্য আরও একটি ভূমিকা রয়েছে, বিপ্লবী ভূমিকা। মার্ক্সের ভাষায়, প্রতিটি পুরাতন সমাজের গর্ভে নতুন সমাজ জন্ম নেওয়ার সময় বলপ্রয়োগ ধাত্রীর ভূমিকা পালন করে। এই হল সেই শক্তি, যার বলে সামাজিক আন্দোলন ফসিলে পরিণত হওয়া মৃত রাজনৈতিক আধারটিকে চূর্ণ করে নিজের পথ করে নেয়– কিন্তু এ সম্পর্কে হের ড্যুরিং একটি কথাও বলেননি। অনেক দীর্ঘশ্বাস ও কাতরোক্তির সাথে ড্যুরিং শুধু এই সম্ভাবনাটির কথা মেনেছেন যে, শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উচ্ছেদের জন্য হয়তো বা বলপ্রয়োগের দরকার হবে, কিন্তু সেটা তাঁর খেদের কথা। কেন না বলপ্রয়োগ মাত্রেই, তাঁর মতে, বলপ্রয়োগকারীর নীতিবোধকে কলুষিত করে। এই কথা তিনি বলেছেন জার্মানি সম্পর্কেও, যেখানে গত ত্রিশ বছরের যুদ্ধের হীন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জাতীয় চেতনায় গড়ে ওঠা দাসত্বের মনোবৃত্তি দূর হতে পারে একমাত্র কোনও সশস্ত্র সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই, এমনকি তা যদি মানুষের উপর চাপিয়েও দেওয়া হয় তা হলেও এটা সম্ভব। অথচ ড্যুরিংয়ের এমন একটা স্থবির, নিষ্প্রভ ও অক্ষম ধারণা কিনা চেপে বসার কথা বলছে এমন একটি দলের চিন্তার উপর, যারা কিনা ইতিহাসে সর্বাধিক বিপ্লবী দল হিসেবে পরিচিত! (পৃঃ- ১৯৩, ৩য় জার্মান সংস্করণ, ২য় খণ্ড, ৮র্থ পরিচ্ছেদের শেষ)

১৮৭৮ থেকে ১৮৯৪ সাল, অর্থাৎ আমৃত্যু এঙ্গেলস যে জার্মান সোসাল ডেমোক্র্যাটদের উদ্দেশ্যে একরোখার মতো সশস্ত্র বিপ্লবের তাৎপর্য তুলে ধরে তার প্রশস্তি গেয়ে চলেন, তার সাথে এখন ‘রাষ্ট্রের বিলুপ্তির’ তত্ত্বকে মেলানো যায় কী করে?

সাধারণত এ দু’টি তত্ত্বকে মেলানো হয় পল্লবগ্রাহিতায়, নিজের খুশিমতো (অথবা ক্ষমতাসীনদের তোষণার্থে) নীতিহীন বা কূটতার্কিকের মতো কখনও এ যুক্তিকে, কখনও-বা ও যুক্তিকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে তারা শেষ পর্যন্ত যেখানে উপনীত হয়, দেখা যায় সামনে তুলে ধরা হয় ওই ‘রাষ্ট্রের বিলুপ্তি’র কথাটুকুকেই। দ্বান্দ্বিকতার স্থান নেয় পল্লবগ্রাহিতা– এই হল আজকের সোসাল ডেমোক্র্যাট সাহিত্যে মার্ক্সবাদ সম্পর্কে চলতি ও বহুল ব্যবহৃত আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত মত। এইরকমের বদল অবশ্য নতুন কিছু নয়, চিরায়ত গ্রিক দর্শনের ক্ষেত্রেও এরকম পরিলক্ষিত হয়। মার্ক্সবাদের নামে সুবিধাবাদী কারচুপি চালাতে গিয়ে দ্বান্দ্বিকতার বদলে পল্লবগ্রাহিতা চালালে মানুষকে ঠকানো সহজ হয়, এতে আপাতদৃশ্য একটা তৃপ্তি মেলে– যেন প্রক্রিয়াটির সব দিক, বিকাশের সব প্রবণতা, সমস্ত বিরোধাত্মক প্রভাব প্রভৃতির হিসেব নেওয়া হয়েছে, অথচ সমাজ বিকাশ প্রক্রিয়ার কোনও সামগ্রিক বা বৈপ্লবিক উপলব্ধি তা থেকেই মেলে না।

আমরা আগেই বলেছি এবং পরে আরও বিশদে দেখাব, সশস্ত্র বিপ্লবের অনিবার্যতা সম্পর্কে মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মতবাদ বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বুর্জোয়া রাষ্ট্র কখনও রাষ্ট্রের বিলুপ্তির প্রক্রিয়ায় সর্বহারা রাষ্ট্রে (সর্বহারার একনায়কত্ব) পরিণত হতে পারে না, তার জন্য দরকার ‘সশস্ত্র বিপ্লব’। এঙ্গেলস সশস্ত্র বিপ্লব সম্পর্কে যা বলেছেন এবং মার্ক্সের একাধিক জায়গায় বলা উক্তির সাথেও যা মেলে (স্মরণ করা যাক ‘দর্শনের দারিদ্র’ ও ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার-এর শেষাংশের কথা, যেখানে সশস্ত্র বিপ্লবের অনিবার্যতা নিয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, বা তার প্রায় তিরিশ বছর পরে ১৮৭৫ সালে রচিত গোথা কর্মসূচির সমালোচনা, যেখানে মার্ক্স এ কর্মসূচির সুবিধাবাদকে নির্মমভাবে কষাঘাত করেছেন) –এই প্রশস্তি কোনও আবেগের প্রকাশ নয়, কোনও বাগাড়ম্বরও নয়, কোনও কথার চাল ভাবারও কোনও কারণ নেই একে।

মার্ক্স ও এঙ্গেলসের সমগ্র মতবাদের শিকড়ই হল সশস্ত্র বিপ্লবের এই রূপ এবং ঠিক সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই মানুষকে নিয়মিত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা আবশ্যক। অথচ বর্তমানে বহুল প্রচলিত ও ক্ষমতাশালী সোসাল শভিনিস্ট ও কাউটস্কিপন্থী ধারাগুলির তাঁদের এই মতবাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা প্রকট হয়ে ওঠে যখন আমরা দেখি, সেরকম কোনও প্রচার বা আন্দোলনের কথাই এই ধারাগুলি ভেবেও দেখে না।

বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বদলে সর্বহারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া সম্ভবই নয়। আবার সর্বহারা রাষ্ট্রের বিলোপ অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার অবলুপ্তি ক্রমবিলোপের পথেই একমাত্র ঘটতে পারে। এই বিষয়টির উপর মার্ক্স ও এঙ্গেলস আলাদা আলাদা করে প্রতিটি বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বিচার করে, পৃথক পৃথক প্রতিটি বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বিশদ আলোচনা ও বাস্তব বিশ্লেষণ রেখে গেছেন। তাঁদের মতবাদের এই অংশ নিঃসন্দেহেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এরপর সেই আলোচনায় ঢুকব। (চলবে)