রাষ্ট্র ও বিপ্লব (১৯) —ভি আই লেনিন

বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার ঊনবিংশ কিস্তি।

সাম্যবাদী সমাজের উচ্চতর পর্যায়

মার্ক্স আরও বলেছেনঃ ‘‘সাম্যবাদী সমাজের উচ্চতর পর্যায়ে, শ্রম বিভাগের দাসত্ব থেকে মানুষ যখন মুক্তি পাবে, এবং তার ফলে মানসিক ও কায়িক শ্রমের বিরোধিতাও যখন অদৃশ্য হবে, যখন শ্রম আর শুধু জীবনধারণের উপায় থাকবে না, হয়ে যাবে জীবনের প্রধান প্রয়োজন, ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশের পথ বেয়ে উৎপাদিকা শক্তিরও বৃদ্ধি হবে এবং যৌথ সম্পদ নানা উৎস থেকে অবিরাম ধারায় আরও বেশি বেশি করে প্রবাহিত হবে, তখন, একমাত্র তখনই, বুর্জোয়া অধিকারের সংকীর্ণ দিগন্তকে সম্পূর্ণভাবে অতিক্রম করা সম্ভব হবে এবং সমাজ তার পতাকায় এই নীতি খোদাই করে দেবেঃ ‘প্রত্যেকে দেবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী, প্রত্যেককে দেওয়া হবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী’!’’

‘রাষ্ট্র’ ও ‘স্বাধীনতা’, এই দুটো শব্দকে একত্রে জুড়ে দেওয়াকে এঙ্গেলস অবাস্তব বলে ক্ষমাহীন চিত্তে উপহাস করেছেন। তাঁর এই মন্তব্য যে কত সঠিক তা এখন আমরা উপলব্ধি করতে পারি। যতদিন রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন স্বাধীনতা থাকবে না। যখন স্বাধীনতা থাকবে, তখন রাষ্ট্র থাকবে না।

রাষ্ট্র সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি, সাম্যবাদের বিকাশের এত উচ্চ স্তর যে, সেখানে কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিরোধ অন্তর্হিত হয়। তাই, সেখানে এখনকার সামাজিক অসাম্যের অন্যতম প্রধান উৎস আর থাকে না। এ ছাড়াও, শুধু পুঁজিপতিদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে, শুধু উৎপাদনের উপকরণকে সামাজিক সম্পদে পরিণত করে তৎক্ষণাৎ এই উৎসকে দূর করা যাবে না।

এই ভাবে পুঁজিপতিদের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার দ্বারা উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপক বিকাশের রাস্তা উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। যখন দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদ ইতিমধ্যেই এই বিকাশকে কী ভয়ঙ্কর মাত্রায় মন্দীভূত করছে, দেখা যাচ্ছে ইতিমধ্যেই প্রযুক্তির যে বিকাশ হয়েছে তার ভিত্তিতেই কত বিশাল অগ্রগতি ঘটতে পারত! তাই পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে আমরা এ কথা বলতে পারি—পুঁজিপতিদের কাছ থেকে সম্পদ কেড়ে নিলে মানব সমাজের উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপক বিকাশ ঘটবে। কিন্তু কত দ্রুত গতিতে এই অগ্রগতি ঘটবে, কত তাড়াতাড়ি তা শ্রম বিভাজনকে অতিক্রম করার জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে, কত তাড়াতাড়ি কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিরোধ দূর হবে, কত তাড়াতাড়ি শ্রম ‘জীবনের মুখ্য প্রয়োজনে’ রূপান্তরিত হবে, আমরা জানি না, আমরা বলতে পারব না।

এই কারণে শুধু এই কথাটাই বলতে পারি, রাষ্ট্র অতি অবশ্যই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জোর দিয়ে বলতে পারি, এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলবে এবং তা নির্ভর করছে সাম্যবাদী সমাজের উচ্চ স্তরের বিকাশের উপর। কিন্তু রাষ্ট্র বিলুপ্ত হতে কত সময় লাগবে এবং কোন সুনির্দিষ্ট রূপে তা ঘটবে এই বিষয়টা আমরা পরবর্তী আলোচনার জন্য ছেড়ে রাখতেপারি। কারণ, এই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো মালমশলা আমাদের হাতে নেই।

রাষ্ট্র তখনই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যখন সমাজ এইসব নিয়ম চালু করবেঃ ‘‘প্রত্যেকে দেবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী, প্রত্যেককে দেওয়া হবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী’’। অর্থাৎ, যখন মানুষ সামাজিক মেলামেশার মৌলিক নিয়মগুলো পালনে খুবই অভ্যস্ত হবে এবং তাদের শ্রম এত উৎপাদনশীল হবে যে, তারা স্বেচ্ছায় তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে। ‘বুর্জোয়া অধিকারের সংকীর্ণ দিগন্ত’ তখন মানুষ অতিক্রম করে যাবে। তখন মানুষ শাইলকের মতো শীতল হৃদয়ে হিসাবনিকাশ করতে বসবে না, কেউ আর একজনের তুলনায় আধঘণ্টা বেশি কাজ করল কি না বা কেউ অন্যের তুলনায় কম বেতন পেল কি না। কে কতটা দ্রব্য নিল তা নিয়ন্ত্রণ করার তখন কোনও প্রয়োজন সমাজের থাকবে না, অবাধে সবাই তার ‘প্রয়োজন অনুযায়ী নেবে’।

বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে সহজেই বলে দেওয়া যায়, এই ধরনের সমাজব্যবস্থা ‘একেবারেই কাল্পনিক’। সমাজ থেকে নেওয়ার অধিকার থাকবে সকলের, এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য ওরা সমাজতন্ত্রীদের ব্যঙ্গ করবে। প্রতিটি ব্যক্তি-নাগরিকের শ্রমের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রত্যেকটি ব্যক্তিরই প্রয়োজনমতো খাদ্য, মোটর গাড়ি, পিয়ানো ইত্যাদি সমাজ থেকে নেওয়ার অধিকার থাকবে, সমাজতন্ত্রীরা এই প্রতিশ্রুতি দেয় বলে বুর্জোয়ারা তাদের বিদ্রুপ করে। এমনকি, এখনও বড় বড় বুর্জোয়া ‘পণ্ডিতরা’ এইভাবে বিদ্রুপ করে। আর এর দ্বারা দেখিয়েদেয়, তারা কতটা অজ্ঞ, তারা কীভাবে পুঁজিবাদের ভাড়াটে রক্ষী হিসাবে কাজ করছে।

নিতান্তই অজ্ঞতা। কোনও সমাজতন্ত্রীর মাথায় এমন ‘প্রতিশ্রুতি’-র কথা কখনও আসেনি যে, সাম্যবাদের সর্বোচ্চ স্তর আপনা আপনি এসে যাবে। মহান সমাজতন্ত্রীরা ভবিষ্যতকে বিচার করে বলেছেন, এই ধরনের ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বর্তমান পর্যায়ে থাকলে এবং জনসাধারণের বর্তমান অতি সাধারণ জীবন যাপন চলতে থাকলে হবে না। যেখানে তারা পমিয়ালভস্কির গল্পের সেমিনারি স্কুলের ছাত্রদের মতো ‘নিছক মজার ছলে’ সামাজিক সম্পদের ভাণ্ডার ধ্বংস করে বা অসম্ভব সব দাবিদাওয়া পেশ করে, তা থাকলে চলবে না।

সমাজতন্ত্রীরা দাবি করেন, যতদিন উচ্চস্তরের সাম্যবাদ না আসবে, ততদিন সমাজ ও রাষ্ট্রকে শ্রমের ও ভোগের পরিমাণের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। কিন্তু পুঁজিপতিদের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার মধ্য দিয়েই এই নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করতে হবে, পুঁজিপতিদের উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতভাবেই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র দিয়ে হবে না, এই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে সশস্ত্র শ্রমিকের রাষ্ট্র দিয়ে।

পুঁজিবাদের ভাড়াটে সেবাদাস বুর্জোয়া পণ্ডিতদের (এবং তাদের তল্পিবাহক, সেরেতেলি, চারনভ ও অন্যান্যরা) কাজ হল বর্তমান দিনের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন্ত সমস্যার পরিবর্তে সুদূর ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে চর্চা করা ও বিতর্ক জুড়ে দেওয়া। বর্তমানের এই সব গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন্ত কাজ হল, পুঁজিপতিদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া, রাষ্ট্র-রূপ বিশাল সিন্ডিকেটের অধীনে সমস্ত নাগরিকদের শ্রমিক ও কর্মচারীতে রূপান্তরিত করা, এবং যথার্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, শ্রমিক সৈনিক সোভিয়েতের ডেপুটিদের সম্পূর্ণ অধীনে সিন্ডিকেটের সমস্ত কাজকর্মকে নিয়ে আসা।

বস্তুত, যখন একজন পণ্ডিত, তাঁর অনুগামী একজন কূপমণ্ডুক, এবং তাঁর অনুগামী সেরিতেলি ও চারনভপন্থীরা বলেন, বলশেভিকরা অযৌক্তিক কল্পনাবিলাসী, ওরা লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি দেয়। ওঁরা বলেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। ওঁরা যখন এই সব কথা বলেন, তখন ওঁদের মাথায় থাকে সাম্যবাদের উচ্চ স্তরের কথা। সাম্যবাদের উচ্চস্তরের প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া দূরে থাক, প্রতিষ্ঠার কথা কেউ ভাবেওনি। কারণ, সাধারণভাবে তা ‘চালু’ করা যায় না।

এখন এই প্রশ্নটা এসে যায়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলতে গেলে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের মধ্যে পার্থক্য কী? ‘সোস্যাল ডেমোক্র্যাট’ নামটা কেন সঠিক নয়, এই বিষয় নিয়ে এঙ্গেলসের যে আলোচনা আগে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে তিনি এই প্রশ্নটা উল্লেখ করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে প্রথম অর্থাৎ নিম্নস্তরের সাম্যবাদের সাথে উচ্চস্তরের সাম্যবাদের পার্থক্য সম্ভবত সময়ের গতিপথে বিশাল হয়ে উঠবে। কিন্তু এই পার্থক্য নিয়ে বর্তমানে আলোচনা করা অর্থহীন। শুধু কোনও কোনও নৈরাজ্যবাদী সম্ভবত এর উপর প্রাথমিক গুরুত্ব আরোপ করতে পারেন। (অবশ্য যদি নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে এমন কেউ এখনও থাকেন, যারা ক্রপটকিন, গ্রেভ, কর্ণেলিসেন ও নৈরাজ্যবাদের অন্যান্য জ্যোতিষ্কদের প্লেখানভ সদৃশ সোস্যাল শভিনিস্ট বা ‘শেষ পর্যন্ত নৈরাজ্যবাদী’তে রূপান্তর থেকে কোনও শিক্ষাই লাভ করেননি। যে কয়েকজন নৈরাজ্যবাদীর বিবেক ও আত্মসম্মানবোধ এখনও বজায় আছে, তাদের অন্যতম গে ‘শেষ পর্যন্ত নৈরাজ্যবাদী’ এই নামকরণ করেছেন)।

কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে দেখতে গেলে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার। সাধারণত আমরা যাকে সমাজতন্ত্র বলি মার্ক্স তার নামকরণ করেছেন ‘প্রথম’ বা নিম্নস্তরের সাম্যবাদী সমাজ। যতদূর পর্যন্ত উৎপাদনের উপকরণ জনসাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়, ততদূর পর্যন্ত ‘সাম্যবাদ’ শব্দটি এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অবশ্যই আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এটা পূর্ণাঙ্গ সাম্যবাদ নয়। মার্ক্সের ব্যাখ্যার সুমহান তাৎপর্য হল, এখানেও তিনি সুসংগতভাবে বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্ব ও বিকাশের তত্ত্বকে প্রয়োগ করেছেন। এবং দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদ থেকে বিকশিত হয়েই সাম্যবাদের জন্ম হয়। পণ্ডিতি কায়দায় ‘মনগড়া’ সংজ্ঞা উদ্ভাবন করা বা শব্দ নিয়ে অর্থহীন বিতর্কের মধ্যে (সমাজতন্ত্র কী? সাম্যবাদ কী?) তিনি যাননি। এর পরিবর্তে মার্ক্স বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সাম্যবাদের অর্থনৈতিক পরিপক্কতার বিভিন্ন স্তর কী হতে পারে।

প্রথম পর্যায়ে, সাম্যবাদ অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি সুপরিণত হয় না, পুঁজিবাদের ঐতিহ্য ও চিহ্ন থেকেও পুরোপুরি মুক্ত থাকতে পারে না। দেখার বিষয় যে, প্রথম পর্যায়ের সাম্যবাদে ‘বুর্জোয়া অধিকারের সংকীর্ণ দিগন্ত’ থেকে যায়। অবশ্যই ভোগ্যপণ্যের বন্টনের ক্ষেত্রে বুর্জোয়া অধিকারের জন্য প্রথমেই আবশ্যিকভাবে মেনে নিতে হয় বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে। কারণ, অধিকারের মানদণ্ডটিকে মান্যতা দেওয়ানোর ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য কোনও যন্ত্র ছাড়া অধিকার অর্থহীন।

এর থেকে বোঝা যায়, সাম্যবাদে কিছুকালের জন্য শুধু বুর্জোয়া অধিকার থেকে যায় না, বুর্জোয়াদের ছাড়াই বুর্জোয়া রাষ্ট্রও থাকে!

একে স্ববিরোধী বা একটা সাধারণ দ্বন্দ্বমূলক ধাঁধা বলে মনে হতে পারে। মার্ক্সবাদের অসাধারণ মর্মবস্তুকে অনুধাবন করার জন্য এতটুকুও কষ্ট করেন না, তাঁরাই মার্ক্সবাদকে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।

কিন্তু বাস্তব হল, নতুনের মধ্যে পুরাতনের যে অবশেষ রয়ে যায়, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে আমরা তার সম্মুখীন হই। সমাজজীবন ও প্রকৃতি, দুই ক্ষেত্রেই এই ঘটনা ঘটে। মার্ক্স খেয়ালখুশি মতো সাম্যবাদের মধ্যে ‘বুর্জোয়া’ অধিকারের একটা ছোট্ট টুকরো ঢুকিয়ে দেননি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া একটা সমাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোন কোন বিষয়গুলি অবশ্যম্ভাবী।

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মুক্তির জন্য সংগ্রামে সর্বহারা শ্রেণির কাছে গণতন্ত্রের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু গণতন্ত্র এমন একটা অলঙ্ঘ্য সীমা নয় যা পার হওয়া যাবে না। গণতন্ত্র হল সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদ এবং পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে পৌঁছনোর রাস্তার একটা ধাপ মাত্র।

গণতন্ত্র বলতে বোঝায় সাম্য। সাম্যের জন্য সর্বহারা শ্রেণির সংগ্রাম ও সাম্যের জন্য স্লোগানের মহত্তম তাৎপর্য তখনই আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যদি আমরা সাম্য কথাটাকে সঠিকভাবে শ্রেণি অবলুপ্তির অর্থে বুঝি। কিন্তু গণতন্ত্র মানে হল শুধু বাহ্যিক সাম্য। উৎপাদন উপকরণের মালিকানার প্রশ্নে যখনই সমাজের সমস্ত মানুষের জন্য সাম্য অর্জন করা যাবে, অর্থাৎ শ্রমের সাম্য ও মজুরির সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, তখনই মানবজাতি বাহ্যিক সাম্য থেকে বাস্তব সাম্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কর্তব্যের সম্মুখীন হবে। তাকে এই নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ‘‘প্রত্যেকে দেবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী, প্রত্যেককে দেওয়া হবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী’’। সমাজের কোন স্তরে, কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের দ্বারা, মানব জাতি এই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে তা আমরা জানি না, আমাদের জানা সম্ভবও নয়। কিন্তু সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বুর্জোয়াদের চালু ধারণা হল, সমাজতন্ত্র প্রাণহীন, অনড় অচল, পরিবর্তনহীন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বুর্জোয়াদের এই সরলীকৃত ধারণার ভ্রান্তি কী বিশাল তা উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বাস্তবে একমাত্র সমাজতন্তে্রই সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে অগ্রগতির যথার্থ সংগ্রাম এগিয়ে যেতে পারে। প্রথমে এই সংগ্রামে যুক্ত হবে সমাজের অধিকাংশ মানুষ, তারপর সমগ্র জনগণ।

গণতন্ত্র হল রাষ্ট্রের বহু বিচিত্র রূপের মধ্যে একটা রূপ। এর ফলে, এই রাষ্ট্র অন্য সব রাষ্ট্রের মতো, একদিকে মানুষের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন, সংগঠিত নিপীড়ন চালায়, অন্যদিকে এ হল বাহ্যিকভাবে সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে সাম্য ও রাষ্ট্রের পরিচালনা ও রাষ্ট্রের কাঠামো ঠিক করার ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান অধিকারের স্বীকৃতির নিদর্শন। এর পরিণতিতে যে ফল হয়, তা হল এই—গণতন্ত্র তার বিকাশের একটা স্তরে প্রথমে সর্বহারা শ্রেণিকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিপ্লবী শ্রেণি হিসাবে ঐক্যবদ্ধ করে। সর্বহারা শ্রেণিকে সেই ক্ষমতা দেয় যাতে সে পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে, চূর্ণ বিচূর্ণ করে, দুনিয়ার বুক থেকে বুর্জোয়াদের, এমনকি প্রজাতান্ত্রিক বুর্জোয়াদেরও মুছে দিতে পারে। বুর্জোয়া রাষ্ট্র-যন্ত্র, স্থায়ী সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আমলাতন্ত্রকে ধ্বংস করে তার জায়গায় অধিকতর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু যতই গণতান্ত্রিক হোক, তা রাষ্ট্রই। এই রাষ্ট্রের রূপ হল সশস্ত্র শ্রমিকদের সংগঠিত বিপুল বাহিনী যা সমগ্র জনগণের মিলিশিয়ায় পরিণত হয়।

এখানে ‘পরিমাণ গুণে রূপান্তরিত হয়’। গণতন্ত্রের এই স্তরে পৌঁছানোর অর্থই হল, বুর্জোয়া সমাজের সীমানা অতিক্রম করে, সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা। যদি সমস্ত জনগণ বাস্তবে রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনার কাজে অংশগ্রহণ করে, তাহলে পুঁজিবাদ তার কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারবে না। পুঁজিবাদের বিকাশ নিজেই এই পূর্বশর্ত সৃষ্টি করে যেখানে ‘সকলেই’ রাষ্টে্রর প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। এই পূর্বশর্তের কয়েকটা দিক হলঃ সর্বজনীন স্বাক্ষরতা, যা ইতিমধ্যেই অনেকগুলি অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশে অর্জন করা গেছে। এ ছাড়াও আছে, ডাক বিভাগ, রেলওয়ে, বড় বড় কারখানা, বড় বড় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ক ইত্যাদির মতো জটিল, বিশাল, সামাজিক প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কাজ করার ব্যবস্থা।

এই অর্থনৈতিক ভিত্তির ফলে পুঁজিপতি ও আমলাদের উচ্ছেদের পরে তখনই সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের অতিক্রম করা সম্ভব। তখন শ্রমের ও উৎপাদিত দ্রব্যের হিসাব নিকাশ রাখবে সশস্ত্র শ্রমিক ও সমগ্র সশস্ত্র জনগণ। (নিয়ন্ত্রণ ও হিসাব রাখার বিষয়টা ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ প্রভৃতির মতো বিজ্ঞাসম্মতভাবে প্রশিক্ষিত লোকেদের সাথে গুলিয়ে ফেলা উচিৎ হবে না। এরা বর্তমানে পুঁজিপতিদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের অধীনে কাজ করছে। আগামী দিনে এই ভদ্রলোকেরা সশস্ত্র শ্রমিকদের নির্দেশ মেনে তাদের অধীনে আরও ভালভাবে কাজ করবে)।

সাম্যবাদী সমাজের প্রথম স্তরের কাজ চালু করা এবং সঠিক ও মসৃণভাবে তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য হিসাব রাখা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রধানত জরুরি। এখানে সমস্ত নাগরিকরাই সশস্ত্র শ্রমিকদের রাষ্টে্রর বেতনভুক কর্মচারীতে রূপান্তরিত হবে। সমস্ত নাগরিকই দেশব্যাপী একটিমাত্র রাষ্ট্রীয় ‘সিন্ডিকেটের’ শ্রমিক ও কর্মচারীতে পরিণত হবে। যা দরকার তা হল, তারা সমানভাবে কাজ করবে, নিজের নিজের কাজের সঠিক অংশটা করবে, এবং সেই ভাবেই বেতন পাবে। এর জন্য যে নিয়ন্ত্রণ ও হিসাবের ব্যবস্থা থাকা দরকার পুঁজিবাদ তার চূড়ান্ত সরলীকরণ ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে। একে পুঁজিবাদ অত্যন্ত সরল কাজে পরিণত করেছে। এই কাজ যে কোনও একটা স্বাক্ষর লোক করতে পারবে। দেখভাল করা আর রেকর্ড রাখার জন্য, রশিদ দেওয়ার জন্য, পাটিগণিতের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ জানলেই চলবে।

যখন সব জায়গায়, স্বাধীনভাবে অধিকাংশ মানুষ এই ধরনের হিসাব রাখতে পারবে এবং পুঁজিপতিদের উপর (এখন কর্মীতে রূপান্তরিত) ও যারা পুঁজিবাদী অভ্যাস লালন পালন করেন সেইসব বুদ্ধিজীবী ভদ্রমহোদয়দের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারবে, তখন এই নিয়ন্ত্রণ সার্বজনীন, সাধারণ ও দেশব্যাপী বিষয়ে পরিণত হবে। তখন এর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় থাকবে না, ‘কোথাও যাওয়ার জায়গাও’ থাকবে না।

সমগ্র সমাজ একটা অভিন্ন অফিস ও অভিন্ন কারখানায় পরিণত হবে, যেখানে শ্রমের সাম্য ও বেতনের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

কিন্তু, পুঁজিপতিদের পরাজিত করার পর, শোষকদের উচ্ছেদ করার পর, সর্বহারা শ্রেণি সমস্ত সমাজ জুড়ে যে ‘কারখানা’ সুলভ শৃঙ্খলা চালু করবে, তা কোনও মতেই আমাদের আদর্শ নয়, কোনও মতেই তা আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না। সমাজ দেহ থেকে পুঁজিবাদী শোষণের সমস্ত কলঙ্ক ও ঘৃণ্য বিষয়কে একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়ার জন্য এবং সমাজের আরও অগ্রগতি ঘটাবার জন্য এটা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ মাত্র।

যে মুহূর্ত থেকে সমাজের সমস্ত মানুষ বা অন্তত অধিকাংশ মানুষ নিজেরাই রাষ্টে্রর কাজ পরিচালনা করতে শিখবে, এই কাজকে নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে পারবে, যে অতি অল্প সংখ্যক পুঁজিপতি তখনও থাকবে, যে সমস্ত ভদ্রমহোদয়েরা পুঁজিবাদী অভ্যাস লালন পালন করতে চাইবে তাদের উপর এবং পুঁজিবাদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নীতিভ্রষ্ট হওয়া শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সেই মুহূর্ত থেকে সব ধরনের সরকারের প্রয়োজনীয়তা একেবারে ফুরিয়ে যেতে থাকবে। গণতন্ত্র যত পূর্ণাঙ্গ হবে, গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ার সময়টা ততই কাছে আসতে থাকবে, সশস্ত্র শ্রমিকের রাষ্ট্র, যাকে আর যথার্থ অর্থে ‘রাষ্ট্র’ বলা যায় না, তা যত বেশি বেশি করে ‘গণতান্ত্রিক’ হতে থাকবে, তত দ্রুতই সমস্ত ধরনের রাষ্ট্রই বিলীন হয়ে যেতে শুরু করবে।

যখন সবাই সামাজিক উৎপাদনকে পরিচালনা করতে শিখেছে, বস্তুত স্বাধীনভাবেই সামাজিক উৎপাদনকে পরিচালনা করতে সক্ষম, স্বাধীনভাবেই হিসাব রাখা এবং ‘পুঁজিবাদী ঐতিহ্যের অভিভাবক’ কুঁড়ে, তথাকথিত ভদ্রলোক ও প্রতারকদের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারবে, তখন এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও হিসাবের ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠবে।। যদি কেউ এড়িয়ে যায়ও, তবে তা হবে খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। আর সম্ভবত এ ক্ষেত্রে খুব দ্রুত ও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে (কারণ, সশস্ত্র শ্রমিকরা বাস্তব বোধ সম্পন্ন মানুষ। তারা আবেগসর্বস্ব বুদ্ধিজীবী নয় এবং তারা কাউকে শ্রমিকদের তুচ্ছ বলে ভাবতে দেবে না)। সমাজের মানুষের সাথে আদানপ্রদান মেলামেশার এই সহজ সরল মৌলিক নিয়ম পালনের প্রয়োজনীয়তা খুব তাড়াতাড়ি মানুষের অভ্যাসে পরিণত হবে।

একমাত্র তখনই প্রথম স্তরের সাম্যবাদ থেকে উচ্চস্তরের সাম্যবাদে যাওয়ার দরজা একেবারে খুলে যাবে এবং এর সাথে সাথে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে। (চলবে)