Breaking News

মুনাফা আর দখলদারির সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্যই শান্তির পথে প্রধান বাধা

তেলেঙ্গানার হায়দরাবাদে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দু-বছর পার হয়ে গেল। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল ইউক্রেন। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধও পাঁচ মাস হতে চলল। ২০২৩-এর অক্টোবর থেকে প্যালেস্টিনীয় জনগণের উপর লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। এক দিকে ইউক্রেনবাসী সাধারণ মানুষ, অন্য দিকে প্যালেস্টিনীয় জনগণ–যুদ্ধ উভয়ের জীবনেই নামিয়ে এনেছে সীমাহীন ধ্বংস আর মৃত্যু। ইউক্রেনে মৃত্যু হয়েছে সেনা সহ প্রায় ৩১ হাজার সাধারণ মানুষের। ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য জনপদ, বাড়ি, শিল্প-কারখানা। উদ্বাস্তু হয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রায় ২২ হাজার রুশ সেনারও মৃত্যু হয়েছে এই যুদ্ধে। প্যালেস্টাইনের স্বাধীন বাসভূমির দাবি ইজরায়েলি সেনার রাইফেল কামান মিসাইলে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার প্যালেস্টিনীয় মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যার বিরাট অংশ নারী ও শিশু।

বিশ্ব জুড়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, এই যুদ্ধ থামবে কবে? কয়েক দিন আগেই ইউক্রেনের অ্যাভভিবকা শহর দখল করে নিল রাশিয়া। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি বলেছেন, অস্ত্রের অভাবেই এই শহর তাদের হাতছাড়া হল। তিনি আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রনায়কদের কাছে অস্ত্র পাঠানোর আবেদন করেছেন। লক্ষ করার বিষয়, জেলেনেস্কি কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের কথা বলেননি, বলেননি যুদ্ধ বন্ধের প্রশ্নে রাশিয়ার উপর চাপ বাড়ানোর কথা। যার অর্থ, সংঘাত চলুক। বাস্তবিক ইউক্রেনে যুদ্ধ যে দু-বছর ধরে চলতে পারল তা অনেকখানিই আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ হিসাবে যুদ্ধকে ব্যবহার করার ফলেই। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনে ঘাঁটি গেড়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় বড় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। তারাই ইউক্রেনকে জুগিয়ে যাচ্ছে সব আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যা দিয়ে সে অনেকখানি ঠেকিয়ে রেখেছে রাশিয়াকে। উল্লেখ্য, মার্কিন সিনেটের বহু সদস্যের যেমন মার্কিন অস্ত্র কোম্পানিগুলির শেয়ার রয়েছে, তেমনই অনেকে অস্ত্র উৎপাদক কোম্পানির মালিক। বাস্তবিক আমেরিকার ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ আশীর্বাদস্বরূপ। প্রায় সব পুঁজিবাদী দেশই নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতাকে কাটাতে অর্থনীতির সামরিকীকরণের পথে হাঁটছে।

কমরেড শিবদাস ঘোষ বহু আগেই দেখিয়েছেন, বর্তমানে ছোট-বড় সব পুঁজিবাদী দেশের মধ্যেই অর্থনীতির সামরিকীকরণে ঝোঁক বাড়ছে। ধনকুবের গোষ্ঠীর অস্ত্রকারখানায় তৈরি অস্ত্র হয় রাষ্ট্রকে, না হয় রাষ্টে্রর সহায়তায় অন্য দেশে বিক্রি করে অর্থনীতিকে কিছুটা চাঙ্গা রাখার চেষ্টা আজ প্রায় সব দেশেই।ফলে হাজার হাজার ইউক্রেনবাসীর প্রাণ এবং বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তিক্ষয়ের বিনিময়ে মার্কিন এবং ইউরোপীয় ধনকুবেররা বিপুল মুনাফা ঘরে তুলছে এই যুদ্ধ থেকে। অন্য দিকে ইউক্রেন সহ পূর্বতন সোভিয়েত দেশগুলিকে ন্যাটোর সদস্য করে রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদকে যে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল আমেরিকা, তা আটকানো এবং একই সঙ্গে নিজের প্রভাবাধীন এলাকা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েই ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপে কমিউনিজমের বিস্তার আটকাবার জিগির তুলে আমেরিকা পশ্চিম ইউরোপের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিকে নিয়ে ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) যুদ্ধজোট তৈরি করে। বাস্তবে ইউক্রেনকে মাঝে রেখে যুদ্ধ চলছে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্রাজ্যবাদীদের। সামরিক যুদ্ধের পিছনে বাস্তবে কাজ করছে এক বিরাট বাণিজ্য-যুদ্ধ। লক্ষণীয় হল, যুদ্ধ রাশিয়ার পুঁজিপতিদের পক্ষেও লাভজনক হয়েছে। আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়াতে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে যে ভেবেছিল রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করে তাকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করবে, তা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। ইউরোপ তেল আমদানি বন্ধ করে দিলে চিন, ভারত, ব্রাজিলের মতো দেশগুলিতে সস্তায় তেল রফতানি করতে থাকে রাশিয়া। চিনের সঙ্গে ডলারের পরিবর্তে চিনের মুদ্রা ইউয়ানে লেনদেন শুরু করে দেয়। ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলি, যাদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে, সেই দেশগুলির সঙ্গে আর্থিক লেনদেন, বিশেষত ড্রোন, ত্রুজ মিসাইল এবং অন্যান্য অস্ত্র আমদানি বাড়িয়ে দেয়।

ভারত সরকারের ভূমিকাটিও লক্ষ করার মতো। বিশ্বগুরুর দাবিদার নরেন্দ্র মোদি মুখে বলে চলেছেন, প্রয়োজনে ভারত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাস্তবে সে-ও এই যুদ্ধ থেকে বিপুল সুবিধা লুটে চলেছে। আমেরিকা এবং বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাশিয়ার উপর চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে সুযোগ হিসাবে নিয়েছে ভারত। ইউরোপ জুড়ে রাশিয়ার যে বিরাট বাজার ছিল আপাতত তা হাতছাড়া হওয়ায় তার উৎপাদিত পণ্য পূর্ব এশিয়ার বাজারে বিক্রি করছে রাশিয়া। এর মধ্যে জ্বালানি তেল থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলি। গত দু-বছর ধরে জলের দামে তেল কিনে সেই তেল আন্তর্জাতিক বাজারের দামে ইউরোপকেই বিক্রি করেছে ভারতীয় কোম্পানিগুলি। যদিও দেশের বাজারে তেলের দাম এতটুকুও কমায়নি তেল কোম্পানিগুলি। ফলে দেশের মানুষ এই সস্তা তেলের কোনও সুবিধাই পায়নি। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজির কাছেও এই যুদ্ধ আশীর্বাদ হিসাবেই এসেছে। তাই শান্তির প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা ঠিক—ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো। তা ছাড়া ভারতের জনগণ সব সময়ই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, কিন্তু সরকারের ভূমিকা তা নয়।

প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের কার্যত একতরফা আক্রমণের পিছনেও আমেরিকা মদত দিয়ে যাচ্ছে প্রকাশ্যে। এখানেও কাজ করছে তার অস্ত্র ব্যবসার স্বার্থ। যদিও দেশে দেশে ইজরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। লন্ডন সহ ইউরোপের দেশে দেশে শান্তির দাবিতে বিশাল বিশাল মিছিল-সমাবেশ হচ্ছে। ‘আইকর’ (ইন্টারন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশন অফ রেভোলিউশনারি পার্টিজ)-এর মতো আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠন বিশ্ব জুড়ে বিক্ষোভ সংগঠিত করেছে। ইজরায়েলের ভেতরে গণবিক্ষোভ যেমন বাড়ছে তেমনই পড়শি দেশ কাতার ও মিশর গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছে ইজরায়েলের উপর। সম্প্রতি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা বলেছেন, গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলি বাহিনী যা করছে, তা আসলে হিটলারের হলোকাস্ট অভিযানের সমান। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কিউবা আন্তর্জাতিক আদালতে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনে গণহত্যার অভিযোগ দায়ের করেছে। বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দা ক্রমাগত বাড়লেও ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে বিজেপি সরকার ইজরায়েলের এই গণহত্যার কোনও নিন্দা করছে না শুধু নয়, তার সাথে অস্ত্রশস্তে্রর আমদানি-রপ্তানি সহ ব্যবসায়িক লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে। অস্ত্র উৎপাদনকারী ভারতীয় পুঁজিপতিরা এই সুযোগে একদিকে ইজরায়েলকে অস্ত্র বেচে মুনাফা করছে, তেমনই অন্য নানা ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করছে।

স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্ব জুড়ে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, এই যুদ্ধ কি চলতেই থাকবে? হাজার হাজার সাধারণ মানুষ এবং সেনার মৃত্যুর মিছিল কি চলতেই থাকবে? উদ্বাস্তু হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ কি এ ভাবে উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটাতে থাকবে? এই যুদ্ধ বন্ধের উপায় কী?

বিশ্বে যতদিন সমাজতান্ত্রিক শিবির তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে অবস্থান করছিল, তত দিন যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের উপর একটা নিয়ন্ত্রণ কাজ করছিল, তত দিন সীমিত ক্ষেত্রে হলেও সমাজতান্ত্রিক শিবির সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধচক্রান্তের বিরুদ্ধে শান্তির রক্ষক হিসাবে আক্রান্ত দুর্বল দেশগুলির পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের শক্তি জুগিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক শিবির ভেঙে যাওয়ার পর যুদ্ধের বিপদ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এক মেরু বিশ্বের সুযোগ নিয়ে একের পর এক আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান প্রভৃতি দেশে নানা অজুহাতে দখলদারি, লুণ্ঠন, হত্যা এবং ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। অন্য দিকে রাশিয়া ও চিনের মতো পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি, যারা সমাজতন্তে্রর আদর্শ থেকে সরে গিয়ে পুঁজিবাদের পথে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে তারা আজ বিশ্ববাজারে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে বাজার দখল নিয়ে যুদ্ধের বিপদও অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

গত শতকের সূচনাতেই বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা, শ্রমিক শ্রেণির শিক্ষক লেনিন দেখিয়েছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ যত দিন থাকবে, যুদ্ধের সম্ভাবনাও তত দিন থাকবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বাজার দখলের লড়াই প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

অত্যন্ত আশার কথা, যুযুধান দেশগুলির অভ্যন্তরে যুদ্ধের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে তীব্র জনমত। সাধারণ মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন। রাশিয়ার অভ্যন্তরে যেমন যুদ্ধবিরোধী মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন, তেমনই ইজরায়েলের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে পথে নামছেন। ঠিক তেমনই ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থ ঢালার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন মার্কিন জনগণ। তাঁরা বলছেন, যুদ্ধে অস্ত্র উৎপাদক মার্কিন পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়লেও সাধারণ মানুষের করের টাকা যুদ্ধের পিছনে ব্যয় হওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে তাঁদের। ইউরোপ জুড়েও জনগণ ইউক্রেন যুদ্ধে টাকা না ঢালার জন্য রাষ্ট্রনায়কদের কাছে দাবি জানাচ্ছেন। ভিয়েতনামে মার্কিন হানাদারির বিরুদ্ধে আমেরিকার অভ্যন্তরে প্রবল গণবিক্ষোভ বাধ্য করেছিল যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রকে যুদ্ধ বন্ধ করতে। আজ গোটা ইউরোপ জুড়ে পুঁজিবাদী খোলাবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে, বেকার সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-চিকিৎসার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুব-শ্রমজীবী মানুষ আন্দোলনে ফেটে পড়ছে। সঠিক নেতৃত্বে শ্রমজীবী মানুষের বাঁচার আন্দোলনকে এই যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যেমন যুক্ত করতে হবে, তেমনই শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনকেও আরও শক্তিশালী করতে হবে। সম্মিলিত এই আন্দোলনই পারবে যুদ্ধের মুখে লাগাম পরাতে।