ভারত হোক বা ইন্ডিয়া দেশের মানুষের জীবনের অন্ধকার ঘুচবে কি

সম্প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন দেশের নাম থেকে ইন্ডিয়া কথাটিকে একেবারে ছেঁটে ফেলতে। সদ্য শেষ হওয়া জি-২০ সম্মেলনের নেতাদের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ বাতিল করে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। ইন্ডিয়া শব্দটি নাকি বিদেশি শব্দ, এর গায়ে নাকি উপনিবেশবাদী গন্ধ লেগে রয়েছে। বিজেপি নেতারা আরও বলছেন, ইন্ডিয়া শব্দটি বিভিন্ন ভারতবিরোধী নাশকতামূলক শক্তির নামের সঙ্গেও যুক্ত। তাই দেশের নাম হিসাবে ইন্ডিয়া নাকি আর এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করা উচিত নয়।

বিজেপি নেতাদের এ হেন তৎপরতায় স্বাভাবিক ভাবেই দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন ধাক্কা দিচ্ছে যে, জনজীবনের গুরুতর সমস্যাগুলির কি সবই সমাধান করে ফেলেছে বিজেপি সরকার? মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, ছাঁটাই, শিক্ষা-চিকিৎসার সমস্যাগুলি কি তা হলে আর মানুষের জীবনের প্রধান সমস্যা নেই? তাই কি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এখন দেশের নাম পরিবর্তনের কাজে মেতেছে? মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে, সমাধান হওয়া দূরের কথা, যত দিন যাচ্ছে সরকারি নীতির কুফল হিসাবে সমস্যার বোঝা মানুষের ঘাড়ে আরও ভারি হয়ে চেপে বসছে এবং জনজীবনের এ সব সমস্যাগুলির কোনওটির সঙ্গেই দেশের নাম যুক্ত নয়। মানুষ তাদের ইচ্ছা এবং সুবিধামতো দেশের নাম হিসাবে ইন্ডিয়া বা ভারত দুটোকেই ব্যবহার করেছে বা করে। কখনও এটিকে একটি সমস্যা বলে তাদের মনে হয়নি। তবে বিজেপি নেতাদের কেন হঠাৎ সব ছেড়ে দেশের নাম নিয়ে পড়তে হল?

তা ছাড়া, গত ৯ বছরের শাসনকালে নরেন্দ্র মোদিরা নাম পরিবর্তনের ‘মহান’ কাজ তো কম কিছু করেননি! ভারতে মুসলমান শাসনের ঐতিহাসিক সত্যকে কালি ঢেলে ঢেকে দেওয়ার অপচেষ্টায় ঐতিহাসিক স্মৃতিজড়িত বহু স্থানের নাম তাঁরা বদলে দিয়েছেন। ইসলামি নামের বদলে হিন্দুধর্মীয় নামের পত্তন করে হিন্দুপ্রেমী সাজার চেষ্টার কিছু কসুর করেননি। কিন্তু কী হয়েছে তা দিয়ে? এ ভাবে ঐতিহাসিক সত্য মুছে দেওয়া যায় না, যাবেও না। সব চেয়ে বড় কথা, তাঁদের তথাকথিত এই হিন্দুধর্ম-প্রেমে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের জীবনেরই বা কতটুকু উন্নতি ঘটেছে? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশ হিসেবে অন্যান্য ধর্মের মানুষের মতো তাঁরাও তো জ্বলছেন খিদের আগুনে, বেকারত্বের যন্ত্রণায়। ঝলসে যাচ্ছেন মূল্যবৃদ্ধির আঁচে। ‘ইন্ডিয়া’ পাল্টে ‘ভারত’ নাম ব্যবহার করলে এই সব জ্বলন্ত সমস্যার একটিরও সমাধান হবে কি?

আসলে বিজেপি নেতাদের সমস্যাটা দেশের নাম নিয়ে নয়, দেশের মানুষকে নিয়ে, মানুষের মনে জমা হওয়া বিক্ষোভ নিয়ে। কেন্দ্র বিজেপির দু-দফার শাসনে জনজীবনের এমন কোনও সমস্যা নেই যেটির তারা কিছুমাত্র সুরাহা করতে পেরেছে। বরং মূল্যবৃদ্ধি থেকে বেকারত্ব, শিক্ষা থেকে চিকিৎসার সমস্যা সবই গুরুতর আকার নিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতাদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কিন্তু উত্তর দেওয়ার মতো ঝুলিতে তাঁদের কিছুই নেই। এই প্রতিটি বিষয় নিয়ে বিজেপি নেতারা বারে বারে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কোনওটিই কার্যকর করেননি। মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে, বেকারত্ব গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছে, ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে, নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার সামগ্রিক বেসরকারিকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মালিকদের মুনাফা অটুট রাখতে শ্রমিকদের সমস্ত অধিকারকে তাদের পায়ে বলি দিয়ে ৪৪টি শ্রম কোডকে ৪টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। দলিত সহ নিম্নবর্ণের মানুষের উপর উচ্চবর্ণের মানুষের অত্যাচার অতীতের সব সীমা ছাড়িয়েছে। মণিপুর সহ দেশের নানা প্রান্তে জাতিগত দাঙ্গা আগের থেকে অনেক বেড়েছে। মহিলাদের উপর অত্যাচার বিজেপি শাসনে অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। নানা অছিলায় মুসলিমদের ওপর অত্যাচার এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেড়েই চলেছে। দেশজুড়ে প্রশ্ন উঠছে, এই সব জনবিরোধী কাজ ছাড়া গত ৯ বছরে মোদি সরকার আর কী করেছে?

এই ব্যর্থতার কাঁটা বিজেপি নেতাদের ভালই বিঁধছে। কারণ তাদের সমর্থন যারা করে তারা তো সব টাটা-বিড়লা নয়। সাধারণ মানুষ– চাষি, মজুর, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত। অথচ নতুন কোনও প্রতিশ্রুতির স্তোক দিয়ে যে জনগণের ক্ষোভকে আর স্তিমিত করা যাচ্ছে না তাও তারা টের পাচ্ছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে যখন বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে ঠিক একই রকম ভাবে মানুষ প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, তখন সেই ক্ষোভকে বিপথে চালিত করতে বিজেপি নেতারা পুলওয়ামার ঘটনা এবং বালাকোটে সেনা অভিযানের আশ্রয় নিয়েছিলেন। একই তাস দু’বার খেলা যাবে না। তাই এ বার রামমন্দির উদ্বোধনের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি হঠাৎ দেশের নাম বদলের নাটক শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা, যাতে দেশ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগকে উস্কে তোলা যায়।

বিজেপি নেতারা যদি সত্যিই দেশের নাম বদল করতে চান তবে সবার আগে তো তাদের এই নিয়ে জাতীয় বিতর্কের ডাক দেওয়া দরকার ছিল। জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজন ছিল। বিরোধী দলগুলির মত নেওয়ার দরকার ছিল। এ সব কোনও কিছুই না করে একতরফা ভাবে বিজেপি নেতারা দেশের নাম বদলের সিদ্ধান্ত শুধু ঘোষণা করে দিলেন তাই নয়, আন্তর্জাতিক ফোরামে পর্যন্ত তা ব্যবহার করে দিলেন। এটা গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী। তা ছাড়া এই নাম বদল করতে হলে সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল এনে তা পাশ করাতে হবে। কারণ সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদেই রয়েছে, ‘ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত, শ্যাল বি এ ইউনিয়ন অফ স্টেটস’। কাজেই এই ইচ্ছামতো নাম পরিবর্তন সংবিধান বিরোধীও বটে।

ইন্ডিয়া নামটি ব্রিটিশের দেওয়া, বিজেপি নেতাদের এই অভিযোগেরও কোনও সারবত্তা নেই। প্রথমত, সংবিধান পরিষদের সভায় দেশের নাম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পরই ‘ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ, ভারত’ এই বাক্যাংশ সংবিধানে যুক্ত করা হয়। তাই স্বাধীন দেশের ইন্ডিয়া নামটি ব্রিটিশ নয়, ভারতীয়দেরই যুক্ত করা। দ্বিতীয়ত, যে বিজেপি নেতারা আজ ঔপনিবেশিকতা-সাম্রাজ্যবাদের ঘোরতর বিরোধী হওয়ার ভাব দেখাচ্ছেন, দেশ জুড়ে যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা জেলে যাচ্ছিলেন, পুলিশের অত্যাচার সহ্য করছিলেন, প্রাণ দিচ্ছিলেন, তখন সেই বিজেপির পূর্বসূরী হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএসের নেতারা অতি সন্তর্পণে আন্দোলন থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিলেন শুধু নয়, নানা ভাবে ব্রিটিশকে সহায়তা করেছিলেন। তাঁরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন বলেই মানতে চাননি। আজও বিজেপি নেতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে-ভাবে এ দেশের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি দেশগুলির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে চলেছেন, তাঁদের সাথে কোলাকুলি করছেন, তাতে কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, দেশের নামে বিদেশি শব্দ, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, এই সব গল্পের আসল উদ্দেশ্য তাদের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা থেকে দেশের মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিয়ে দেশের নামের মতো একটি আবেগপূর্ণ বিতর্কে জড়িয়ে ফেলা, তার মধ্য দিয়ে জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি, যেগুলি আসন্ন নির্বাচনের মূল ইস্যু হিসাবে এসে গিয়ে তাঁদের গুরুতর প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে, সেগুলিকে ভুলিয়ে দেওয়া এবং ‘বিদেশি ইন্ডিয়ার’ বিরুদ্ধে ‘স্বদেশি ভারত’কে লড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনে ফয়দা তোলা।

দেশের মানুষকে এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হতে হবে এবং বিজেপি সরকারের কাছে তাদের সমস্ত অপকর্মের কৈফিয়ত দাবি করতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে, দেশের নাম বদলের দ্বারা জীবনের কোন সমস্যাটার সমাধান তোমরা করবে? তোমরাই তো নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি এনে শিক্ষার সামগ্রিক বেসরকারিকরণ করে দেশের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার নামে শিক্ষার জগত থেকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে। দেশ বলতে তোমরা বোঝো শুধু আদানি-আম্বানিদের, তাই দেশের সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং দেশের সম্পদকে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছ। ভারত নামের প্রবক্তা তোমরাই তো বিলকিস বানোর ধর্ষণকারী ও তাঁর আত্মীয়দের খুনিদের সাজা শেষ হওয়ার আগেই জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছ। কাজেই, এই ‘ভারত বনাম ইন্ডিয়া’ তরজা যে ২০২৪ নির্বাচনের আগে তোমাদের হাতে আর একটি তুরুপের তাস, মানুষের তা বুঝতে বাকি নেই।